মত-মতান্তর

নাম হলো তার বঙ্গোপসাগর

গাজী মিজানুর রহমান

২০ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার, ৫:৪৫ অপরাহ্ন

‘বঙ্গোপসাগর’ নামটা বাঙালির কাছে একটু গর্বের বই কি! মাদ্রাজ (চেন্নাই), হায়দারাবাদ, ভুবনেশ্বরের মত বড় বড় নগর যে-সব এলাকায় বা রাজ্যে, তাদের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উপকূলে হলেও তাদের নামে সাগরের নাম হয়নি। আবার আরব সাগরের নামের আদলে একটা অঞ্চলের নামেও এর নাম হয়নি, হয়েছে বঙ্গ বা বাংলার নামে। তাই বিশ্ববাসীকে এখন মাঝে মাঝে বাংলার নাম স্মরণ করতে হচ্ছে। মায়ানমার, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, বাঙ্গলাদেশ ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ ভূভাগের মাঝখানে ২১ লক্ষ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার জলাধারটির নাম বাংলার নামে। সে বঙ্গোপসাগর হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। এর সর্ব-উত্তরে দুই বাংলা হাত ধরাধরি করে সুন্দরবনকে তুলে ধরেছে যৌথভাবে – যেন একটা শিল্ড পেয়েছে সমুদ্রের কাছ থেকে। সংসার আলাদা হলেও দুই ভাই মিলে শিল্ডখানা ভারত মহাসগরকে দেখানোর জন্য মেলে রেখেছে এমনভাবে, যাতে বুঝা যায় একদিন একটা সংসার ছিল তাদের।

পৃথিবীতে শত শত উপসাগরের মধ্যে সবচেয়ে বড় উপসাগরের নাম এই বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রের মাঝখানে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ একটা আড়াল সৃষ্টি না করলে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গগাপুর পর্যন্ত জলের তালুক হতে পারতো পুরোটা বঙ্গোপসাগরের। এখন আন্দামানের পূর্বের জলাধারের নাম আন্দামান সাগর। মাত্র ৭,৯৭,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সমুদ্রটির নামের সাথে সাগর; কিন্তু এর চেয়ে তিনগুণ বড় হয়েও বঙ্গোপসাগর উপ-সাগর নামের মায়া কাটাতে পারেনি। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে বঙ্গোপসাগরের নাম এটা ছিল না। প্রাচীন সংস্কৃতি ভাষায় রচিত সাহিত্যে এর নাম ছিল মহোদধি। জে.বি. বি. ডি’ এনভিল কর্তৃক ১৭৬২ সালে প্রণীত এবং লন্ডন থেকে ১৭৯৪ সালের প্রকাশিত প্রাচীন বিশ্বের মানচিত্রে এর নাম রয়েছে ‘গ্যাঞ্জেটিকা সাইনাস’ বা গঙ্গার সমুদ্র। বুঝুন ঠেলা! বাঁশের চেয়ে কঞ্চি মোটা! সমুদ্রের মালিক হচ্ছে নদী! যাহোক, পরে এর নাম হয়েছে বঙ্গোপসাগর বা বাংলার উপসাগর।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বাংলা একটি সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল। ঐতিহাসিক মাউন্টস্টুয়ার্ট এলফিনেস্টন মনে করেন, প্রাচীন কাল থেকে আরব দেশগুলির সাথে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল সমুদ্রপথে। তখন চট্টগ্রাম এবং সপ্তগ্রাম নামে বাংলায় দুটি বড় বড় বন্দর ছিল। সপ্তগ্রাম থেকে সরে এসে বন্দরটি প্রথমে হুগলি এবং পরে কোলকাতায় থিতু হয়। চট্টগ্রাম সেই একই জায়গায় আছে। প্রাচীন আমল থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য মানুষের সাথে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষ লস্করের কাজ করতো। অধিক সংখ্যক বাংলাদেশের মানুষ যে জাহাজী পেশায় নিয়োজিত ছিল, তার প্রমাণ আমরা পাই বৃটিশ নৌবাহিনীর জাহাজে এবং বৃটিশ বাণিজ্য জাহাজে হাজার হাজার বাঙালির কাজ করার সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখে। এদের অনেকে পরে সপরিবার লন্ডনের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ আবার শেতাঙ্গ নারীদের বিয়ে করে একটা শঙ্কর জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছেন। এরূপ জনগোষ্ঠীর সন্তান এলবার্ট মোহামেত একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। তিনি তার পুস্তক ‘ফ্রম স্ট্রীট আরব টু প্যাস্টর ’ এর জন্য বিখ্যাত। ইংরেজ কর্তৃক ‘বে অব বেঙ্গল’ ইংরেজি নাম দেয়ার জন্য তাদের মননের উপর তাদের জাহাজে কাজ করা বাঙালি লস্করদের প্রভাব ছিল, তা বললে অত্যূক্তি হবে না। প্রথমদিকে এরাই তো ছিল ইংরেজের ঘনিষ্ঠজন, ঘরের লোক। ষোড়শ শতাব্দীতে তারা যখন এ দেশে ব্যবসা করতে এসে বঙ্গোপ্সাগরের পাড়ে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে, তখন তাদের জাহাজে কর্মরত এ দেশীয় লস্করেরাই তাদের পথঘাট-জনপদ চিনিয়ে দিত। অপরদিকে যে বাংলা থেকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের উত্থান, সমুদ্রের নামটা ‘বে অব বেঙ্গল’ রেখে ইঙ্গরেজ তার প্রতি খানিকটা সুবিচার করতে চেয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের ছবির দিকে তাকালে সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়, এর সর্ব-উত্তর সীমানা একটা সমান্তরাল মেখলা তৈরি করেছে। মনে হয়, যেন একটি দেশ তার করপুটে একটা জলের মানচিত্র ধরে বাইরের দিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। হাতের বাইরের দিকে থাকা দুইদিক ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে একদিকে উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ আর তামিলনাড়ুতে গিয়ে শেষ হয়েছে। অন্যদিক আরেক প্রান্ত মায়ানমার থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ হয়ে সুমাত্রার সাথে মিশে গিয়ে ডাইনে বাঁক নিয়ে শ্রীলংকায় মিশেছে। বঙ্গোপসাগর নামের সাথে আরো কিছু রেকর্ড গেঁথে আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সৈকত কক্সবাজার, সবচেয়ে বড় নিরবচ্ছিন্ন ম্যানগ্রোভ জঙ্গল সুন্দরবন, আর পৃথিবীর সুস্বাদুতম মাছ-প্রজাতির অন্যতম মাছ, ইলিশের আবাসস্থল এই বাঙ্গলার নামের সাথে মিশে আছে। এরা সমুদ্রের সন্তান। তাই এ সমুদ্রের নাম বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কি হতে পারে ?
বিংশ শতাব্দির শুরুতে বঙ্গোপসাগরে যন্ত্রচালিত জাহাজের আবির্ভাবের আগে পালের জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দেয়া হতো। বঙ্গোপসাগরে চলাচলের ক্ষেত্রে দুটি মৌসুমি বায়ুর উপর নির্ভর করে বাণিজ্য জাহাজগুলি চলতো। উত্তর-পূর্বমুখি মৌসুমী বায়ু নির্ভর করে জাহাজগুলি পশ্চিম দিক বা দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-এশিয়া বা পূর্ব-এশিয়ায় আসতো, আর ফিরতি পথে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখি মৌসুমী বায়ু ব্যবহার করতো তারা। পালতোলা জাহাজ দিয়েই বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে যোগাযোগ এবং বাণিজ্য চালাতো। ‘স্টার অব বেঙ্গল’ নামের একটা বৃটিশ পালতোলা জাহাজ ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা-লন্ডন চলাচল করেছে। ওই বছর জাহাজটি আমেরিকান এক কোম্পানি কিনে নেয়। পরে জাহাজটি সানফ্রান্সিস্কোতে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে ডুবে যায় এবং ১৩৮ জন নাবিকের মৃত্যু ঘটে। এই জাহাজের ক্যাপ্টেন নিকোলাস ওয়েগনারের কন্যা জোয়ান লাওয়েল ১৯২৯ সালে দুর্ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ‘ দ্য ক্রেডল অব দ্য ডিপ’ নামের একটা সাড়াজাগানো উপন্যাস লেখেন। কাজেই বলা যায় টাইটানিকের মত একটা ট্রাজিক জাহাজের নামও বাংলার নামের সাথে জুড়ে আছে।
বঙ্গোপসাগরের উপকূলে যে সব বন্দর অবস্থিত তার শরীরে শতাব্দির পর শতাব্দি জুড়ে রাজনীতি, ধর্ম ও অর্থনীতির টানাপড়েনের ছাপ বিদ্যমান। প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত আরব সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরের পাড়ে অবস্থিত বন্দরে আরব ব্যবসায়ী এবং ধর্ম-প্রচারকদের আনা-গোনা চলতো। ভাস্কো-দা গামা কর্তৃক বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপথ আবিষ্কারের পর ইউরোপ থেক পর্তুগিজ, ফরাসী, দিনেমার, ডাচ, ইংরেজ কোম্পানিগুলির আনাগোনা শুরু হয়। বঙ্গোপ্সাগরের তীরবর্তী এলাকায় তারা গড়ে তোলে তাদের কোম্পানির দফতর এবং দুর্গ। এ সময় থেকে ইউরোপীয় বণিকদের নিজেদের মধ্যে এবং ভারতীয় দেশীয় রাজাদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এই সংঘাতের শেষ প্রান্তে এসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের পৌনে দুইশত বছরের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। সাগর-তীরবর্তী এ উপ-মহাদেশের শাসকেরা যথা কলিকটের জামুরিন রাজারা, বাংলার নবাব এবং মহীশূরের সুলতানেরা ইউরোপীয় আগ্রাসনের প্রথম শিকার। সমুদ্রে প্রতিপত্তি স্থাপন করে তারপর তারা দখল করেছে স্থলভাগ। এ দেশের সমুদ্রপথ কখনোই সুরক্ষিত ছিল না।

(প্রাক্তন সিভিল সার্ভেন্ট ও লেখক)

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status