মত-মতান্তর

আশরাফ গণি: একালের 'পার্সন নন গ্রাটা’ এবং 'শিখণ্ডী'

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৯ আগস্ট ২০২১, বৃহস্পতিবার, ২:৪৪ অপরাহ্ন

আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হলেও তালেবান কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি বিভিন্ন দেশের দ্বারে দ্বারে ধর্না দেওয়া এমন এক প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা, যাঁর গায়ে ‘পার্সন নন গ্রাটা’ তকমা সেঁটে গিয়েছে। কূটনীতির ভাষায় 'পার্সন নন গ্রাটা’-এর অর্থ, এমন এক রাষ্ট্রনেতা, বিশিষ্ট ব্যক্তি অথবা কূটনীতিবিদ, সব দেশে যাঁর প্রবেশে অনুমতি নেই। সহজ কথায় যিনি 'বরণযোগ্য/গ্রহণযোগ্য' নন, 'অনাহুত', 'অবাঞ্ছিত'।

একই সঙ্গে আশরাফ গণির আরেক পরিচয় হলো 'শিখণ্ডী'। 'শিখণ্ডী' মূলত পৌরাণিকী কাহিনীর এক চরিত্র, যাকে ময়ূর কিংবা দ্রুপদরাজকুমার নামেও শনাক্ত করা হয়েছে। যার আড়ালে থেকে অর্জুন অন্যায়ভাবে ভীষ্মকে পরাস্ত করেছিলেন। ফলে যার আড়ালে থেকে অন্যায় কাজ করা যায়, তাক 'শিখণ্ডী' বলা হয়। আমেরিকার জন্য আফগানিস্তানে যাবতীয় অপকর্ম ও বর্বরতার 'শিখণ্ডী' ছিলেন আশরাফ গণি।

অন্যদিকে, কূটনীতির পরিভাষায় 'পার্সন নন গ্রাটা' বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি গ্রাহক রাষ্ট্র কর্তৃক অগ্রহণযোগ্য ও অবাঞ্ছিত হয়েছেন। এমন তালিকার ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া যায় কিংবা দেশে না-ঢুকতে দেওয়া যায়। ১৯৬১ সালের কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আচরণ বিষয়ক 'ভিয়েনা কনভেনশন'-এর ২৩ অনুচ্ছেদে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত রয়েছে।

ক্ষমতাচ্যুত ও পলাতক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশে ও উপসাগরীয় রাষ্ট্র ওমানে জায়গা পাওয়ার চেষ্টা করেও সফল হন নি। অবশেষে তিনি আশ্রয় পেয়েছেন আরব আমিরাতে। অথচ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে প্রথম তালেবান শাসনকে সমর্থন করেছিল যে তিনটি দেশ, আমিরাত ছিল তাদের অন্যতম। বাকি দুই দেশ ছিল সৌদি আরব এবং পাকিস্তান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, ২০ বছর পর দ্বিতীয় তালেবানদের তাড়ায় একদার প্রথম তালেবান সমর্থক দেশে অবশেষে জায়গা পেলেন আশরাফ গণি।

আশ্রয়ের জন্য ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর পরিস্থিতি শুধু যে আশরাফ গণির হয়েছে, তা নয়। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইংলুক শিনাওত্রা নানা জায়গায় ঘুরে দুবাইয়ে আশ্রয় পান। স্পেনের রাজা হুয়ান কার্লোস গত বছর (২০২০) আমিরাতে আশ্রয় লাভ করেন। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগে দীর্ঘ আট বছর পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোও আমিরাতের আশ্রয়ে ছিলেন।

অন্যদের সঙ্গে আশরাফ গণি পার্থক্য এই যে, তিনি শুধু প্রতিপক্ষ দ্বারা আক্রান্ত নন, স্বপক্ষের দ্বারাও নিন্দিত। সদ্য-সাবেক আফগান সরকারের পক্ষে তালেবান বিরোধী তৎপরতায় অংশগ্রহণকারীরা আশরাফ গণিকে 'কাপুরুষ' ও 'বিশ্বাসঘাতক' বলে অভিহিত করেছেন। গণি অনুপস্থিতিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহ তালেবানদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অথচ গত রবিবার (১৫ আগস্ট) তালেবানরা কাবুল দখল করার সঙ্গে সঙ্গেই কাউকে কিছু না জানিয়ে অতি সন্তর্পণে সপরিবারে দেশ ছাড়েন ভারতের প্রিয়ভাজন বলে পরিচিত আশরাফ গণি, যার সঙ্গে আগের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং মন্ত্রীসভার অধিকাংশেরই বিস্তর দূরত্বের কথা সর্বজনবিদিত।

আশরাফ গণি আহমদজাই নামের পশতু ভাষী এই ভদ্রলোক প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ছিলেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্সেলর এবং বিশ্বব্যাঙ্কের কর্মকর্তা। মূলত বিদেশে চাকরি করেই কেটেছে তাঁর জীবন। তিনি এবং তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যরাও আমেরিকান সিটিজেন। আফগানিস্তানে আমেরিকান দখলদারিত্ব মজবুত করতে অনুগতদের বিশ্বের নানা জায়গা থেকে তুলে এনে কাবুলে যে তাবেদার সরকারে চালানো হয় গত ২০ বছর ধরে, তাতে এক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী হন গণি। তারপর এক সময় পান প্রেসিডেন্টের পদ।

আগের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই থেকেও ঢের মার্কিন অনুগত বলে পরিচিত আশরাফ গণি। কারজাই সন্ত্রাসী দমনের নামে পরিচালিত মার্কিন বিমান হামলায় স্কুল, হাসপাতাল ধ্বংস এবং সাধারণ নাগরিক, নারী ও শিশু নিহত হলে প্রতিবাদ করতেন। আশরাফ গণি তা-ও করতেন না। এজন্যই কারজাইকে সরিয়ে তাঁকে ক্ষমতার শীর্ষে বসানে হয়, যার একমাত্র কাজ ছিল আমেরিকার অন্ধ, নিঃশর্ত, অবারিত আনুগত্য ও তাবেদারি এবং ভারতের মনযোগান । এমন মন্তব্য করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, 'দেশের ভেতরে এবং ভারত ছাড়া অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতে তাঁর আদৌ কোনও জনপ্রিয়তা ছিল না।'

বাস্তবেও তা প্রমাণিত হয়েছে। আবদুল্লাহ সালেহ যেমন দেশের ভেতরে থেকেই তালেবানদের বিরোধিতা ও প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন, আশরাফ গণির ততটুকু করারও ক্ষমতা নেই। সালেহ আফগান বীর শহিদ আহমদ শাহ মাসুদের অনুগত 'নর্দার্ন অ্যালায়েন্স' প্রত্যক্ষ সমর্থন পাচ্ছেন এবং পানশির উপত্যকায় নিজেদের নিরাপদ বলয় তৈরি করেছেন। আশরাফ গণি দেশের কোথায় আহুত হন নি। এখানেও তিনি ছিলেন একজন অঘোষিত 'পার্সন নন গ্রাটা’, পক্ষ ও বিপক্ষের সবাই তাঁর বিচার ও শাস্তি দাবির পাশাপাশি গ্রেফতার করে আনার আওয়াজও তুলছে।

তবে পালিয়ে গিয়ে যতই নিন্দিতই হোন, প্রাণে বেঁচে গেছেন আশরাফ গণি। সেই সুযোগ হয়নি আফগানিস্তানের আরেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ নাজিবুল্লাহর। ঠিক তিন দশক আগে যখন কাবুল ঘিরে ধরেছিল প্রথম তালেবান বাহিনী, সেই সময় প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগের পরিকল্পনা করেছিলেন নাজিবুল্লাহও। কিন্তু যাদের ওপর বিশ্বাস করে জীবন বাজি রেখেছিলেন, তারাই বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর সঙ্গে। শেষে সুসজ্জিত প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিদ্যুতের খুঁটিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ।

পাছে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে, এই আশঙ্কায় আশরাফ পলায়নের বিষয়ে কাউকে কিছুই জানান নি। রক্তপাত এড়াতে দেশ ছেড়েছেন বলে ‘সাফাই’ দিয়ে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, দেশে থাকলে তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হতো। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লার মতো পরিণতি হত তাঁর। ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিত তাঁকেও। তবে চাপে পড়ে সাময়িক পিঠটান দিলেও তিনি দেশকে ভালোবাসেন বলে দাবি করেছেন।

কিন্তু আশরাফ গণির কোনও কথাই মানুষ বিশ্বাস করছে না। তাঁর প্রতি কেউ কোনো আস্থাও দেখাচ্ছে না। বরং তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতা ও আলোচনার টেবিলে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং প্রতিরোধের বিভিন্ন ঘটনায় সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহ ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে একেবারেই গুরুত্বহীন আশরাফ গণিকে ভীত, কাপুরুষ ও পলাতক ছাড়া আর কিছুই ভাবা হচ্ছে না।

এমনকি আশরাফ গণি যতই বলুক, ‘আমি শুধু পরনের কয়েকটা জামাকাপড় নিয়ে এসেছি। নিজের লাইব্রেরির একটা বই পর্যন্ত আনতে পারিনি’, তা-ও কেউই বিশ্বাস করছেনা। বরং 'কাবুল থেকে চপার ভর্তি নগদ টাকা নিয়ে গনি পালিয়ে গিয়েছেন', এটাই হলো বিশ্বাসযোগ্য জনশ্রুতি।

এইসব লাঞ্ছনা এবং অজনপ্রিয়তা ডিঙিয়ে আশরাফ গণির পক্ষে আফগানিস্তানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করা অসম্ভব। ফলে স্বদেশ-জন্মভূমি নয়, নানা দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে পৃষ্ঠপোষক-দেশ আমেরিকাতেই মাটি খুঁজতে হবে। জনবিরোধিতা, তাবেদারি ও পদলেহনের কারণে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে, বিশ্বের দেশে দেশে 'পুতুল' ও 'শিখণ্ডী'রা এমন করুণ ও লজ্জাজনক পরিণতিই লাভ করেছে, যে পরিণতির মুখোমুখি এখন একালের 'পার্সন নন গ্রাটা’ এবং 'শিখণ্ডী' আশরাফ গণি আহমদজাই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status