মত-মতান্তর

২.৫ মিলিয়ন আফগান রিফিউজির সংখ্যা আরো বাড়বে!

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৭ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৩৪ পূর্বাহ্ন

অনেক আগে থেকেই আফগান-পাকিস্তান এবং আফগান-ইরান সীমান্তের বিভাজন রেখা মুছে গেছে সারি সারি আদিঅন্তহীন রিফিউজি ক্যাম্পের কারণে। সীমান্তরক্ষী নয়, উদ্বাস্তু নারী, পুরুষ, শিশুরাই সেখানে প্রধান মুখ। তাদের অস্থায়ী আবাস আর সম্বলই সেখানকার দৃশ্যমান স্থাপনা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আফগান রিফিউজির সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আফগানিস্তান নামক ভূখণ্ডটি জন্মভূমি ও নিজস্ব দেশ হলেও সেদেশের ২.৫ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন, দেশছাড়া, উদ্বাস্তু বা রিফিউজি, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক এবং বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ। বাস্তুহারা আফগান রিফিউজিদের সিংহভাগ আশ্রয় পেয়েছেন পাকিস্তানে। দ্বিতীয় আশ্রয়দাতা দেশ ইরান।

আফগান সীমান্তবর্তী মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে (তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান) আশ্রয় লাভের বিশেষ সুযোগ পান না বিপন্ন আফগানরা। যেমন আশ্রয় পাননি তালেবান হামলায় পলাতক আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি। মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিফল হয়ে তিনি আপাতত জায়গা পেয়েছেন পারস্য উপসাগরীয় দেশ ওমানে। যেখান থেকে তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক আমেরিকায় চলে যাওয়ার চেষ্টায় আছেন।

ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টের মতোই অবস্থা হতভাগ্য আফগান নাগরিকদের। তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্বের বহু দেশই তাদেরকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। দূরের দেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার কোনও দেশকেও খোদ আমেরিকা সুপারিশ করেও আফগান নতুন রিফিউজিদের নিতে সম্মত করাতে পারছে না।

সাম্প্রতিক সঙ্কটে সৃষ্ট অগণিত রিফিউজিদের আগেই যে ২.৫ মিলিয়ন নিবন্ধিত আফগান রিফিউজি রয়েছেন দেশের বাইরের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে, তাদের অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। বছরের পর বছর কয়েকটি প্রজন্মের জন্ম ও বেড়ে উঠার ঘটনা আবর্তিত হচ্ছে ক্যাম্পের অমানবিক পরিস্থিতিতে। সেই ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত আগ্রাসনের পর থেকেই আফগানিস্তানে সংঘাতের 'বাই-প্রোডাক্ট' হিসেবে উদ্বাস্তুকরণ শুরু হয়। তারপর গত ৪২ বছরে আফগানিস্তানে দফায় দফায় বেড়েছে সংঘাত, বেড়েছে রিফিউজির সংখ্যা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আফগানিস্তান থেকে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন নিবন্ধিত শরণার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে বলা হলেও তার বাইরেও নানা দেশে আছেন বহু অনিবন্ধিত আফগান। সর্বশেষ চিত্র দেখে এটাই ধারণা করা হচ্ছে যে, আফগান রিফিউজির সংখ্যা আরো বাড়বে।

বিশেষত, সাম্প্রতিককালে, রাজধানীসহ দেশের অনেক জায়গায় ক্রমবর্ধমান নাজুক পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুকরণের যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তা মর্মন্তুদ। সবাই দেশের পলাতক প্রেসিডেন্টের মতো টাকার বস্তা নিয়ে যেতে পারছেন, তা মোটেও নয়। এক প্রকার খালি হাতে প্রাণ নিয়ে পালাতে দেখা গেছে অসংখ্য নাগরিককে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ, তালেবান কর্তৃক আফগান রাজধানী কাবুল পদানত করার পর বিমানবন্দরে যে পলায়নরত মানুষের অচিন্তনীয় ভিড় দেখা গেছে, তা ছিল ভয়াবহ। বিমানবন্দরকে মনে হয়েছে 'বাসস্টপ' আর বিমানকে মনে হয়েছে 'লোকাল বাস'। বিমানের ডানায়, চাকায়, শরীরের নানা অংশে মৃত্যুকে পরোয়া না করে যেভাবে মানুষ আরোহণের চেষ্টা করেছে, তা সত্যিকার অর্থেই অকল্পনীয় এবং ভীতিকর ছিল।

উদ্বাস্তদের নিয়ে কর্মরত জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর -এর কর্মকর্তার পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠেছেন। তাদের কাজ আরো বাড়বে বলেও তারা জানিয়েছেন। কারণ, বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু আফগান নাগরিকদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, পর্যায়ক্রমে এবং মর্যাদাপূর্ণ পদ্ধতিতে দেশে ফেরানোর বদলে এখন আরো বিপুল উদ্বাস্তুদের সামলাতে হবে বলে তাদের ধারণা। পুরনো ও নতুন বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো সুরক্ষিত আছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য এখন তৎপর তারা।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুনভাবে উদ্ভূত রিফিউজি সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে একাধিক এজেন্সি কাজ করছে। তাদের কাজের মধ্যে এখন প্রধানত গুরুত্ব পাচ্ছে, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়গুলো। তাছাড়া গৃহহীন মানুষদের জরুরি আশ্রয়, খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী প্রদান এবং দুর্বল বাস্তুচ্যুত মানুষকে জরুরি সেবা প্রদানের বিষয়গুলোও প্রাধান্য পাচ্ছে। আফগানিস্তানের লাগাতার সংঘাতের সমান্তরালে এহেন উদ্বাস্তুকরণের বাস্তবতা চরম মানবিক বিপর্যয়ের করুণ চিত্রকেও উপস্থাপন করেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status