মত-মতান্তর

ভ্যাকসিন নিয়ে কেন এতো গোপনীয়তা?

আমীর খসরু

১৬ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ১১:১৫ পূর্বাহ্ন

‘আনুষ্ঠানিকভাবে কী কী প্রতিষ্ঠান আছে, শুধু তা দিয়ে গণতন্ত্রের মূল্যায়ন হয় না, বিভিন্ন গোষ্ঠীর বহু মানুষের কণ্ঠস্বরগুলো শোনা যাচ্ছে কিনা তাও দেখতে হবে’।
- অমর্ত্য সেন
- দ্য আইডিয়া অফ জাস্টিস

পঞ্চাশোর্ধ্ব শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুর রাজ্জাক পরিবার নিয়ে বসবাস করেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানার দনিয়া এলাকায়। গত মঙ্গল ও বুধবার সকাল ৬টার দিকে টিকা দেয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের (দনিয়া) কার্যালয়ের সামনে। এসে দেখেছিলেন মানুষের দীর্ঘ সারি। তাই কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর কাগজপত্র জমা না দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে যান। তবে আবদুর রাজ্জাক এরপর আর আগের দুই দিনের মতো ভুল করেননি। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত ৩টার সময় তিনি চলে যান কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে। তিনি দেখেন, তার সামনে আরও ৯ জন জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দেওয়ার জন্য কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষা করছেন। রাত ৩টার পর রাজ্জাক দেখতে পান, একে একে মানুষ জড়ো হচ্ছেন কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার সময় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একজন প্রতিবন্ধি মানুষ। টিকা দেওয়ার জন্য ৩ দিন ধরে ঘুরতেছি। আজকে তো রাত ৩টা থেকে এখানে এসেছি। কিন্তু টিকা দিতে পারিনি। কবে নাগাদ টিকা দিতে পারবো, সেটিও জানিনা।’
উপরের ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছে ১২ আগস্ট ওই সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে। এ থেকেই সহজে অনুমান করা যায়, করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে বাস্তবে কী চলছে। ৭ আগস্ট শুরু হওয়া গণটিকা কার্যক্রম নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবরা-খবর ইতিমধ্যেই সবাই শুনেছেন বা দেখেছেন । হাজার হাজার মানুষ জড়ো করে তিন থেকে সাড়ে তিনশ’ মানুষকে টিকা দেয়ার নজির দেখে সংবাদমাধ্যমও প্রশ্ন তুলেছে - ‘এটি গণটিকা না গণ-হয়রানি?’ ৬ দিনের এই কার্যক্রম সংবাদমাধ্যম সেরে-সামলে যতোটা সম্ভব ঘটনা তুলে ধরার সাহস দেখিয়েছে। সামলে চলার সাংবাদিকতার এই সময়ে যতোটা সম্ভব ততোটা পারাই মঙ্গল। কারণ নানা অ্যাক্টসহ আইন-কানুন এবং বাঁধা-বিপত্তি সামনে তো রয়েছেই।
কোটি কোটি মানুষের এই দেশে সরকারি হিসেবে এই গণটিকা কর্মসূচির আওতায় মাত্র ৩২ লাখ মানুষকে করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়ার কথা আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বলা হয়েছে। তাহলে এই কর্মসূচির নাম ‘গণটিকা প্রদান’ বলা হচ্ছে কোন যুক্তিতে?
দেশে কতো ভ্যাকসিন মজুদ আছে বা সরকার কতোটা কিনেছে, চুক্তি করেছে বা এ পর্যন্ত দেশে এসেছে - তার সঠিক কোনো হিসেব আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হচ্ছে না। মাঝে মাঝে সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, ‘এতো’ লাখ ভ্যাকসিন নিয়ে বিমান দেশের পথে যাত্রা করেছে বা দেশে এসে পৌঁছেছে। শুধু এ পর্যন্তই। কিন্তু কতো লাখ পৌঁছেছে তা সাধারণ্যে জানাতে কোথায় আপত্তি তা বোধগম্য নয় !
আমরা জানি ভারত থেকে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আনার চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ৭০ লাখ। এরই বা সবশেষ খবর কি তাও অজানা। এরপরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য, সহযোগিতা, দান-অনুদানে যে ভ্যাকসিন এসেছে তার কিছুটা হিসেব ওইসব দেশ বা কোভ্যাক্স ইনেসিয়েটিভ থেকে পাওয়া গেছে। কিন্তু সরকার কতোটা কিনেছে বা চুক্তি করেছে তার স্পষ্ট কোনো হিসেব জানানো হচ্ছে না। কতো দামে কেনা হয়েছে তাও বলা হচ্ছে না - ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় হিসেবে। কেন বিষয়টি ‘স্পর্শকাতর’ তারও কোন কারণ এখন পর্যন্ত জানানো হয়নি। সরকার এবং এর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার বলছেন, টিকার কোনো ঘাটতি নেই এবং প্রতিমাসে ১ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া হবে। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। যদি ঘাটতি নাই থেকে থাকে তাহলে বেশ কয়েকদিন নিবন্ধন এবং ভ্যাকসিন দেয়া বন্ধ ছিলো কেন?

বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, ১ কোটির বেশি ডোজ ভ্যাকসিন মজুত আছে। আবার অন্যদিকে বলা হচ্ছে, গণটিকা কর্মসূচিতে ৩২ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। সারাদেশে নিবন্ধনকৃতদের ভ্যাকসিন দেয়ার কর্মসূচি কম-বেশি চলছে। তাহলে এখনো কী ১ কোটি ডোজের বেশি ভ্যাকসিন মজুত আছে? তাহলে এই কয়দিনে কতো ভ্যাকসিন এসেছে এবং কোথা থেকে এসেছে? স্বাস্থ্য দফতর ১২ আগস্ট পর্যন্ত যে তথ্য সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছে তাতে প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ মানুষকে। দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে ৫২ লাখ ২ হাজার জনকে। অর্থাৎ সবমিলিয়ে ২ কোটির মতো ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন করেছেন ৩ কোটিরও বেশি মানুষ। মনে রাখতে হবে, গ্রামীণ অঞ্চলে বা শহরেও বহু মানুষের ইন্টারনেট সংযোগ বা প্রাপ্ততা নেই। রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন। যাইহোক, যে হিসেব দেওয়া হয়েছে তাতে রেজিষ্ট্রিকৃত দেড় কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ দিতে হবে এবং দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় রয়েছেন ১ কোটির বেশি মানুষ। তাহলে এখনই ভ্যাকসিনের প্রয়োজন আড়াই কোটি ডোজের বেশি।
সরকারিভাবে বর্তমানে কমপক্ষে ২৫ বছর বয়সীদের ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ১৫ জুলাই বলেছিলেন, বয়সসীমা অচিরেই ১৮ বছরে নিয়ে আসা হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৮ বছরের বেশি ১৪ কোটি এবং ২৫ বছরের বেশি ১০ কোটির ওপরে। যদি ২৫ বছর বয়সীদের ভ্যাকসিন দিতে হয় তাহলে ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে দুই ডোজ হিসেবে কমপক্ষে ২০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন। আর কমপক্ষে ১৮ বছর বয়সীদের ভ্যাকসিন দিতে হলে প্রয়োজন হবে ২৮ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের।

গত ২৪ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী বছরের প্রথম দিকেই ২১ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেশে আসবে। তিনিই বলেছেন, চীন থেকে ৬ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সিনোফার্ম থেকে আনা হবে। অথচ সম্প্রতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে দেড় কোটি ডোজের। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, চীনের বাকি সাড়ে চার কোটি ডোজ সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের চুক্তি কবে হবে এবং সম্পাদিত চুক্তির দেড় কোটি ডোজ কতো দিনের মধ্যে আসবে? ২১ কোটি ডোজ কোন কোন দেশ থেকে কীভাবে আগামী বছরের প্রথমেই চলে আসবে? রাশিয়া থেকে যে ভ্যাকসিন কেনার কথা ছিলো তাতেও তো অতিশয় ধীরগতি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, অতি দ্রুত ৭ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন রাশিয়া থেকে আনা হবে। একইভাবে ৭ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার কথা ছিল জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানি থেকে। এরই বা অগ্রগতি কী?
মনে হচ্ছে, সবকিছুই তালগোল পাকানো। অবশ্য এটা নতুন কিছুই নয়। গত বছরও করোনা সংক্রমণ হয়েছে কিনা তা নিয়ে সময়ক্ষেপণ নিয়েও কমবেশি তেলেসমাতির কথা সবার মনে আছে। আবার ভ্যাকসিন ক্রয়ে শুধুমাত্র এক দেশের দিকে তাকিয়ে থেকে চীনকে না বলে দেয়াসহ নানা ঘটনাবলীর কথাও অনেকেরই ভুলে যাবার কথা নয়। স্বাস্থ্য মহাসংকটকে ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ কিংবা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় হিসেবে দেখাটা অন্যায্য এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের লক্ষ-কোটি মানুষ। শাসকদের সব সময়ই জনচিন্তা, জনস্বার্থ এবং জনগণকেই প্রাধান্য দিতে হবে। ষোড়শ শতাব্দীতে রোম সম্রাট প্রথম ফার্দিনান্দের একটি ঘোষণা এক্ষেত্রে খুবই প্রনিধানযোগ্য। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘বিশ্বের কোথায় কি হচ্ছে, হোক। কিন্তু ন্যায্যতা যেন প্রতিষ্ঠিত হয়’। শত শত বছর পরে এসেও এরই অনুপস্থিতি এবং অভাব জনগণ তীব্রভাবে অনুভব করছে।

(আমীর খসরু: সিনিয়র সাংবাদিক এবং প্রধান নির্বাহী, স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওয়ানাল এ্যফেয়ার্স, ঢাকা)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status