মত-মতান্তর

'এই' তালেবান, 'সেই' তালেবান

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৬ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ১০:৪২ পূর্বাহ্ন

কুড়ি বছর আগে যে তালেবান নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তান থেকে, তারাই আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, অবিশ্বাস্য সাফল্যে এবং নাটকীয়ভাবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে অতিদ্রুত শহরের পর শহর দখল করে রাজধানী পদানত করেছে তারা। শুধু যে আফগান বাহিনীকে হারিয়েছে তাই নয়, বিদায় দিয়েছে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনীকেও।

১৯৭৫ সালে যখন ভিয়েতকং গেরিলারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন দখল করছিল, তখন আমেরিকানরা পালাচ্ছিল। তালেবানরা যখন আফগান রাজধানী কাবুল দখল করে, তখনও প্রতিপক্ষ প্রাণভয়ে পালিয়েছে। ৬০ থেকে ৭০ হাজারে তালেবান বাহিনীর সামনে দাঁড়াতে পারেনি অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্রসজ্জিত ৩ লক্ষাধিক আফগান বাহিনী। খোদ আফগান প্রেসিডেন্ট দিনে হুঙ্কার দিয়ে রাতে পালিয়ে গেছেন পাশের দেশ তাজিকিস্তানে।

বলা হচ্ছে তালেবানদের হটিয়ে গত কুড়ি বছরে আমেরিকা ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগানিস্তানে। পেন্টাগনের হিসাবে আফগানিস্তানের যুদ্ধের পেছনে ২ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে আমেরিকা। যার মধ্যে আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতেই খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। ২০২০ সালের একটি গোপন রিপোর্টে, যার পরে প্রকাশ্যে আসে, তাতে পেন্টাগন জানায়, সরাসরি যুদ্ধেই তাদের ৮১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে।

কুড়ি বছরের এতো খরচ ও আয়োজনের অব্যাহত চাপে ক্লান্ত আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে আসার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতে বিশেষভাবে তৈরি আফগান বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে আর উজ্জীবিত হয় তালেবানরা। 'আফগান বাহিনী তিন মাস টিকে থাকতে পারবে মর্মে মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট ভুল প্রমাণ করে চার সপ্তাহের মাথায় তালেবানরা সারা দেশ এবং রাজধানী করায়ত্ত করে।

১৯৯৪ সালে পাহাড়ি কান্দাহারে প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে শাসন চালিয়েছিল তালেবানরা। মাঝের কুড়ি বছর আমেরিকার প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ ও অংশগ্রহণে 'অনুগত সরকার' ছিল আফগানিস্তানে আর প্রতিরোধের যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তালেবানরা। কুড়ি বছর পর তালেবানরা বিজয়ীর বেশে যখন কাবুলে প্রবেশ করে, তখন সারা বিশ্ব বিস্মিত। প্রবল পরাক্রমশালী আমেরিকা যাদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, বরং ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও শক্তি সঞ্চয় করে ক্ষমতা দখল করেছে এবং মাত্র ১০০ দিনে সারা দেশ ও প্রায়-বিনা যুদ্ধে রাজধানী পদানত করেছে যারা, তাদের প্রতি সারা বিশ্বের নজর থাকাটাই স্বাভাবিক।

নতুনভাবে তালেবানরা সবার নজরে আসে মে মাসে, যখন আফগানিস্তান থেকে সেনা সরাতে শুরু করে ন্যাটো। প্রাথমিকভাবে সরিয়ে নেওয়া হয় ৯ হাজার ৬০০ সৈন্য, যাদের মধ্যে আড়াই হাজার জন ছিলেন মার্কিন সেনা। আর ঠিক তখনই হেলমন্দ প্রদেশে আফগান সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই শুরু করে তালেবানরা। মে মাসেই তারা কাবুলসহ দেশের বিভিন্ন অংশে শক্তি সঞ্চয় ও পাল্টা-আক্রমণ শুরু করে।

পরিস্থিতি তালেবানদের আরও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে যখন আমেরিকা সেনা তুলে নিতে শুরু করে। তখন উত্তরাঞ্চলীয় শহরগুলো দখল করতে থাকে তারা এবং ইরান ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী কৌশলজনক এলাকাগুলো কব্জা করে। তারপর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তারা আফগানিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানীগুলো দখল করতে করতে চারদিক থেকে রাজধানী কাবুলে 'প্রায়-বিনা বাঁধা'য় প্রবেশের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে বিস্মিত করে।

তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, আজকের 'এই' তালেবান আর কুড়ি বছর আগের 'সেই' তালেবান একই গোষ্ঠী হলেও শক্তিতে, সামর্থ্যে, কৌশলে, কূটনীতিতে এক নয়। বরং কুড়ি বছরের মার্কিন প্রতিরোধ ঠেলে তারা অনেক 'পোক্ত' বলেই মন্তব্য করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ।

কারণ কুড়ি বছর আগে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে'র মুখে 'সেই' তালেবান ছিল কোণঠাসা ও একঘরে। আর 'এই' তালেবান মিত্র বেষ্টিত এবং 'সামাজিক-রাজনৈতিক-সামরিক' শক্তি সম্পন্ন। চীন তাদের সঙ্গে আপোস রফা করছে। তুরস্ক আলোচনার জন্য দরজা খুলে রেখেছে। পাকিস্তান পাশে আছে। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের মিত্রের অভাব নেই।

'সেই' তালেবান কূটনীতি ও যুদ্ধকৌশলে পিছিয়ে থাকলেও 'এই' তালেবান অনেকটাই এগিয়ে। দেশের বাইরে বন্ধুর মতোই রাজধানী কাবুল দখলের সময় সাধারণ ক্ষমা ও নৃশংসতা এড়িয়ে দেশের ভেতরেও বন্ধু বাড়িয়েছে তারা। 'সেই' তালেবানকে বর্বর, মধ্যযুগীয় বলা হলেও 'এ' তালেবান পুরনো পথে হাঁটে নি। আল জাজিরা যখন রাজধানী কাবুল দখলরত ময়দানে ওয়ারদাকে বিজয়ী তালেবান বাহিনীর লাইভ করছিল, তখন নির্দিষ্ট একক ইউনিফরম ছাড়া আধা-প্রশিক্ষিত বাহিনীকে দেখাচ্ছিল সুশৃঙ্খল। আফগান প্রেসিডেন্ট ভবন দখলের সময়ও তারা ছিল মার্জিত, নিয়মতান্ত্রিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে অরাজকতা, আন্তঃদ্বন্দ্ব ও হিংসার বদলে শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সাফল্য দেখিয়েছে তারা। 'এই' তালেবানের মধ্যে 'সেই' তালেবানের বর্বর ও বেপরোয়া মনোভাবের লেশ মাত্রও ছিল না। ছিল স্থিরতা ও মজবুতভাবে ক্ষমতা কব্জা করার মতো দৃশ্যমান ধৈর্য্য।

প্রায়-রক্তপাতহীন বিজয়ের পর পরই তালেবানদের সম্ভাব্য সরকার প্রধান মোল্লাহ বরাদার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আফগানিস্তানের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষ ও মহিলারা তাদের নিজেদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন। কাবুল দখলের প্রাক্কালে রবিবার (১৫ আগস্ট) তালেবানদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যেন এই যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কোনও ভাবেই ভীত ও উদ্বিগ্ন না হন। শিক্ষাক্ষেত্রে কোনও নেতিবাচক পরিবর্তন হবে না বলে তারা ঘোষণা করেন। তালেবান কর্তৃপক্ষের বরাতে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের নিজেদের কাজে কোনও গাফিলতি হা করে দায়িত্ব পালনে মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে। সকলের নিরাপত্তা ও সম্পতির সুরক্ষা নিশ্চিত করাকে 'সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার' বলে ঘোষণা করেছে তালেবানরা।

ফলে 'এই' তালেবানের মধ্যে 'সেই' তালেবানের নারী ও শিক্ষা বিরোধিতার অতীত ছায়া দেখা যায়নি। সভ্যতার ও ঐতিহ্য বিরোধিতার আর বামিয়ানের ভাস্কর্য ধ্বংসের জন্য 'সেই' তালেবানকে দায়ী করা হলেও কুড়ি বছর পর রক্ত ও যুদ্ধের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে ক্ষমতায় আসা 'এই' তালেবানদের বিরুদ্ধে অহেতুক নৃশংসতা ও অকারণ নির্মমতার অভিযোগ এখনও পর্যন্ত কেউ উত্থাপন করতে পারে নি। আমেরিকাসহ প্রায়-সারা বিশ্বের প্রতিরোধের পরেও দীর্ঘ দুই যুগ লড়াই করে আরও পরিপক্কতা অর্জনের নজির তালেবানদের বিজয়ের প্রাক্কালে সবার নজরে এসেছে। ফলে 'এই',তালেবান আর 'সেই' তালেবানকে এক করে দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

এখন দেখার বিষয়, 'সেই' তালেবান জন্মের দুই বছরের মাথায় ক্ষমতা দখল করে পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল আর 'এই' তালেবান কুড়ি বছর প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ক্ষমতায় এসে কত বছর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে?

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status