মত-মতান্তর

কেন আফগানিস্তানে শান্তি আসে না?

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৩ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার, ১১:০৬ পূর্বাহ্ন

কেন বছরের পর বছর আফগানিস্তানে শান্তি আসে না, তা অনুসন্ধানের জন্যে বর্তমানের সঙ্গে অতীতের দিকেও নজর দেওয়া খুবই জরুরি। কারণ, ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃত্ব আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসনের পর রক্তাপ্লূত বেদনার অভিজ্ঞতায় ৪২ বছর কেটে গেছে। কমিউনিস্টরা বিতারিত হয়েছে। ক্ষমতায় এসেছে নানা সরকার। উত্থান ঘটেছে তালেবান গোষ্ঠীর। বিশ্বের সবগুলো পরাশক্তি কোনও না কোনও মাত্রায় অংশ নিয়েছে আফগানিস্তানের সমস্যা সমাধানে। আমেরিকা বছরের পর বছর প্রভূত অর্থ ও শক্তি ব্যয় করে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও ফলোদয় হয়নি। রক্তপাত ও মৃত্যুর শেষ হয়নি আফগানিস্তানে। বরং নতুন করে সশস্ত্র সংঘাতের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।


দীর্ঘমেয়াদী, ব্যয়সাধ্য, অসফল প্রয়াস শেষে আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের সৈন্যবাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া পর পরই সর্বশেষ খবরে যা জানা যাচ্ছে, তা হলো, তালেবান আর সরকারি সৈন্যদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘাত বাড়ছে। আফগানিস্তানের ১৩ প্রদেশে সেনাবাহিনীর অভিযানে প্রচুর হতাহত হচ্ছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও তালেবান সূত্র নিজ নিজ সাফল্যের তথ্য নিশ্চিত করছে।


আন্তর্জাতিক সূত্রগুলো জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের লাগমান, নানগারহার, নুরিস্তান, কুনার, গজনি, পাকতিয়া, কান্দাহার, হেরাত, বাল্খ, জুযজান, হেলমান্দ, কুন্দুজ ও কাপিসা প্রদেশে উভয় পক্ষের অভিযান ও পাল্টা-অভিযান চলছে। চলছে চোরাগুপ্তা হামলাও।


তবে সরকারি পক্ষ ও তালেবান গোষ্ঠী পরস্পরের পরিসংখ্যান প্রত্যাখ্যান করেছে। উভয় পক্ষই বিভিন্ন ধরনের সামরিক সাফল্যের পরিসংখ্যান হাজির করছে। নিরপেক্ষ ভাষ্যে, আফগানিস্তানের শতকরা ৯০ ভাগ সীমান্তে তালেবানদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যদিও, যে দাবি তালেবান করেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের বলেছে, আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার পরিধি ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে এবং হাতছাড়া হয়ে যাওয়া জেলাগুলো তালেবানের কাছ থেকে একের পর এক পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি আসলে আরও খারাপ এবং ভয়াবহ।


দুই পক্ষের বক্তব্য আর প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট অনুধাবণ করা যায় যে, আফগানিস্তানে আসলে অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। কখনও সরকারি বাহিনী, আবার কখনও তালেবান গোষ্ঠী সাফল্য পেলেও দেশটির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ কোনও পক্ষের হাতেই নেই। দুই পক্ষের দখলে আফগানিস্তানে চলছে রক্ত ও মৃত্যুর স্রোত। আমেরিকান সৈন্যদের চলে যাওয়ার খবরে যুদ্ধরত পক্ষগুলো বরং আরও সক্রিয় হয়েছে। চীন এবং রাশিয়া মাঠে নেমেছে। পাকিস্তান ও ভারত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।


ঐতিহাসিক বিবেচনায়, একমাত্র কাশ্মীর ইস্যু ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় আফগান সমস্যার মতো পুরনো সঙ্কট আরেকটিও নেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশী-বিদেশী নানা রকমের রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপের পরেও দেশটি শান্তির দিশা পায় নি। বরং লোকক্ষয়, রক্তপাত আর ধ্বংসলীলা বেড়েছে। বিশ্বের সকল পরাশক্তি, আঞ্চলিক শক্তি এবং বিশ্বব্যাংক, ইইউ, ইসি, ডিএফআইডিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সরাসরি অংশগ্রহণের পরেও আফগানিস্তানের পরিস্থিতির আদৌ কোনও উন্নতি হয় নি। কেউই সেখানে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সফলতা দেখাতে পারে নি।


কেন আফগানিস্তানে শান্তি আসছে না, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যার উত্তর পাওয়া কঠিন ও দুরূহ এবং প্রায়-অসাধ্য। তবে আফগান জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বিভেদের বীজ সুপ্তভাবে লুক্কায়িত রয়েছে। আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ বলা হলেও তা সঠিক নয়। কারণ, সংঘাতের কারণে বিশাল জনগোষ্ঠী দেশত্যাগ করেছে। আবার, তালেবান গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহু মানুষ। ফলে অস্থির দেশটির মতোই এর জনসংখ্যার আদৌ কোনও সংখ্যাগত স্থিরতা আছে বলে মনে করার কারণ নেই।


এই আফগান জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ পশতুন হলেও সেখানে তাজিক, হাজারা, উজবেক, আইমান, তুর্কমেন, বালুচ, পাশাই, নুরস্তিনি, গুজ্জর, আরব, ব্রাহুই, কিজিলবাশ, পামিরি, কিরগিজ, সাদাত প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন এবং এদের মধ্যে মৈত্রী ও সম্প্রীতির চেয়ে বিভেদ ও অনৈক্য বেশি। দেশের প্রধান শহর কাবুল, হেরাত, মাজার-ইশরিফ, কান্দাহার, কুন্দুস প্রভৃতিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব বিরাজমান।


ভাষা হিসেবেও আফগানিস্তানে পশতু ছাড়াও ফারসি এবং বহু আঞ্চলিক ভাষা বিদ্যমান। দেশের মধ্যে এমন বহু অঞ্চল আছে, যাদের ভাষা অন্য অঞ্চলের মানুষ বোঝেও না। ধর্মীয় দিক থেকে ইসলামের প্রাধান্য থাকলেও শিয়া আর সুন্নিদের পাশাপাশি সুফি ও বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর দূরত্ব। তদুপরি, প্রাচীন জীবনধারার কারণে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব মানতে মোটেও রাজি নয়। কথায় কথায় দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হওয়া চিরাচরিত আফগান সংস্কৃতিরই অংশ।


ফলে এই বিচিত্র মানবগোষ্ঠীকে একতাবদ্ধ করা সত্যিই কষ্টকর। উপরন্তু, তালেবানরা একটি আলাদা মতবাদ ভিত্তিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে দেশটিতে, যাতে স্থানীয়ের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ বিদেশীরাও যুক্ত হয়েছে। এরা কেবল সমাজ ও অর্থনীতির দখলদারিত্ব নিয়েই সন্তুষ্ট নয়, জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভাজিত আফগানিস্তানের পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব হাসিলেও তৎপর।


আফগানিস্তানের আরেক বিপদ হলো তার ভৌগোলিক অবস্থান। দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী আফগানিস্তানের ইতিহাসে অনেক সাম্রাজ্য ও রাজ্য ক্ষমতায় এসেছিল, যেমন গ্রেকো-বারট্রিয়ান, কুশান, হেফথালিটিস, কাবুল শাহী, সাফারি, সামানি, গজনবী, ঘুরি, খিলজি, কারতি, মুঘল, ও সবশেষে হুতাক ও দুররানি।


এখনও আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো বেশ শক্তিশালী এবং আফগান ইস্যুতে অত্যন্ত সতর্ক। কারণ আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া, রাশিয়ানদের জন্য তাজিকিস্তান, চীনের জন্য উইঘুর, ভারতের পক্ষে কাশ্মীর এবং ইরানের জন্য সীমান্ত এলাকা গুরুত্বপূর্ণ। যেসব স্থানেও সঙ্কট আছে। ফলে আফগান সমস্যা যেন নিজের সীমান্তবর্তী এলাকার সমস্যা আরও বৃদ্ধি না করে, সেজন্য প্রতিবেশী দেশগুলো সতর্ক এবং নিজ নিজ স্বার্থগত দিক থেকে আফগান পরিস্থিতির বিষয়ে তৎপর রয়েছে। এক্ষেত্রেও প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই, আছে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ হাসিলের উদগ্র কামনা।


আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহ, বিশেষত মার্কিন ও ইউরোপীয় গোষ্ঠী তাদের অর্থ ও সামরিক শক্তিকে অকাতরে ব্যয় করছে আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পছন্দের অনুগত সরকার দিয়ে তারা যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ইচ্ছুক, তাতে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার আর সামরিক সরঞ্জামাদি খরচ হলেও লাভ হয়েছে কমই। যে কারণে দেশটিতে ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতায় সীমাহীন ক্ষতির কারণে পশ্চাৎগামী মার্কিনিরা নতুন নাম দিয়েছে 'ভিয়েতস্তান'।


আফগানিস্তানের সঙ্কটের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ইস্যুসমূহও। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশটি কৌশলগত কারণে 'গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল' নামে পরিচিত, যেখানে পপি, আফিম ও অন্যান্য মাদকের চাষ ও ব্যবসা এবং সমগ্র অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রির অবাধ সুযোগ রয়েছে। আশেপাশে বহুদেশের বহু গ্রুপের মাদক ও অস্ত্রের উৎস হলো এই বাজার।


আফগানিস্তান মানব পাচারেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট। তাছাড়া, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী বিশ্বব্যাপী আদান-প্রদানেরও সহজ সংযোগস্থল আফগানিস্তান। বস্তুতপক্ষে, দেশটিতে নিজ নিজ স্বার্থ ও মুনাফার জন্য কাজ করছে অসংখ্য অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ শক্তি। এদের সবাই আফগানিস্তানে শান্তি চায়, মোটেও তা নয়। বরং রক্ত ও মৃত্যুর জটিল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ফায়দা হাসিল করার মতো ধুরন্ধর ও অমানবিক শক্তিরও অভাব নেই আফগানিস্তানে। ফলে বিবদমান দেশী-বিদেশী পক্ষগুলো যখন শান্তির জন্যে একাত্ম হচ্ছে না এবং রক্ত ও মৃত্যুর বিনিময়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় উগ্রভাবে তৎপর আছে, তখন আফগানিস্তান নামক দেশটির জন্য শান্তির দেখা পাওয়া সত্যিই অসম্ভব।


তাহলে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কোন পথে চলবে? ৪২ বছরের রক্ত ও মৃত্যুর করুণ ঐতিহ্যই টেনে যাবে সমুদ্র-সংযোগহীন, স্থলবেষ্টিত, পার্বত্য মালভূমির ঊষর দেশটি? আফগানিস্তান বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর ফায়দা হাসিলের লীলাভূমি হয়েই থাকবে? আপাতত বাস্তব পরিস্থিতিতে এমনটিই দেখা যাচ্ছে। তবে, কোনও শক্তিশালী নেতৃত্ব যদি দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করতে পারে, তবে সঙ্কটের সমাধান শেষে শান্তি আসতে পারে। নইলে যুদ্ধের পর যুদ্ধে শেষ হয়ে যাবে ইতিহাসের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ আফগানিস্তান। কিংবা পশ্চিমা দেশগুলো অথবা আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিবর্গ রঙবেরঙ-এর শান্তি ফর্মুলার নামে আরও বিপন্নতার মুখোমুখি করবে দেশটিকে।


ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status