প্রথম পাতা

যোগাযোগের বিকল্প অ্যাপস তৈরি নিয়ে বিতর্ক

কাজী সোহাগ

৪ আগস্ট ২০২১, বুধবার, ৮:৪৩ অপরাহ্ন

প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বের সেরা তিনটি জনপ্রিয় আ্যাপসের বিকল্প তৈরির ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। এগুলো হচ্ছে-ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও জুম। আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে ফেসবুকের বিকল্প নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘যোগাযোগ’ হোয়াটসঅ্যাপের বিকল্প হিসেবে ‘আলাপন’ এবং জুমের বিকল্প ‘বৈঠক’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ২৪শে জুলাই উইমেন ই-কমার্স (উই) আয়োজিত ‘এন্টারপ্রেনারশিপ মাস্টারক্লাস সিরিজ ২’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এ ঘোষণা দেন। ওইসময় প্রতিমন্ত্রী বলেন, এর মাধ্যমে দেশের উদ্যোক্তারা তথ্য, উপাত্ত ও যোগাযোগের জন্য নিজেদের মধ্যে একটি নিজস্ব অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও গ্রুপ তৈরি করতে পারবেন। উদ্যোক্তাদের বিদেশ নির্ভর হতে হবে না। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ই-কমার্স, হার্ডওয়্যার, সফ্‌টওয়্যার, বিপিও সেক্টর মিলে ২০২১ সালের মধ্যে ২০ লক্ষাধিক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে। এছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করা সম্ভব হবে। প্রতিমন্ত্রীর ওই ঘোষণায় দেশের প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিষয়টি বিতর্কিত বলে মন্তব্য করেন তারা। তাদের স্বপক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন। এদিকে প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার পর সোমবার এ নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নেয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টি নিয়ে তারা বিস্তারিত কিছু জানেন না। প্রতিমন্ত্রী মহোদয় জানেন। এছাড়া এ নিয়ে এখন পর্যন্ত একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ওই তিনটি জনপ্রিয় অ্যাপসের আদলে বাংলাদেশে বিকল্প অ্যাপ তৈরি করা হবে। তবে কতোদিনের মধ্যে, কী পদ্ধতিতে, কাদের সহায়তা নিয়ে অ্যাপসগুলো তৈরি করা হবে তা এখন পর্যন্ত র্নিধারণ করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে জানতে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের মোবাইল নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শহিদুল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, জনপ্রিয় তিনটি অ্যাপসের বিকল্প অ্যাপ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে কতোদিনের মধ্যে করা হবে তা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। এ টু আই প্রজেক্টের মাধ্যমে তিনটি অ্যাপস নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এ ধরনের জনপ্রিয় অ্যাপসের বিকল্প তৈরি নিয়ে প্রযুক্তিবিদরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির মানবজমিনকে বলেন, বিকল্প প্রযুক্তি তৈরির ঘোষণায় এখনই উচ্ছ্বাসের কিছু নেই। আবার খুব নেতিবাচক হিসেবে দেখারও কিছু নেই। কারণ বিকল্প প্রযুক্তি তৈরির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু আগে সেটা ভাবতে হবে। যেমন জুমের জন্য রয়েছে নিউরো সাইট, সার্ভার, অনেক ধরনের ফিচার। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে এর মাধ্যমে যোগাযোগ করা যাচ্ছে সেকেন্ডের মাধ্যমে। এ ধরনের সক্ষমতা নিয়ে যদি তৈরি করা যায় তাহলে তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আবার ফেসবুকের মতো অসংখ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে ফেসবুক টিকে গেছে। হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইরকম। তিনি বলেন, অন্য অ্যাপসের কপি না করে আমাদের দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী যদি অ্যাপ বানানো হয় তাহলে সেটা হতে পারে সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তিনি বলেন, চীনের উইচ্যাট লন্ডনসহ এখন পৃথিবীর অনেক দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর কারণ অ্যাপসের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সক্ষমতার একটি বিষয় জড়িত রয়েছে। মন্ত্রণালয় যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সময়ই বলে দেবে ওইসব অ্যাপসের ভবিষ্যৎ কি হবে। এদিকে জনপ্রিয় তিনটি অ্যাপস বানানোর তীব্র সমালোচনা করেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসেসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সম্প্রতি সরকারের আরেক প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ঘটা করে আলাপ নামের একটি অ্যাপ তৈরি করে। এ পর্যন্ত মাত্র ৫ লাখ গ্রাহক ওই অ্যাপস ডাউনলোড করেছে। কিন্তু তারা ব্যবহার করেন না। কারণ এতে খরচ অনেক বেশি। ওই অ্যাপের মাধ্যমে কথা বলতে গেলে প্রতি মিনিট ৪৫ পয়সা খরচ হয়। অথচ হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারের মাধ্যমে কথা বলতে গেলে ইন্টারনেটের দাম অনুযায়ী মাত্র ৯ পয়সা খরচ হয়। তাহলে মানুষ কেন বিটিসিএল এর অ্যাপের মাধ্যমে কথা বলবে। তিনি বলেন, করোনার কারণে জাপানে মাত্র দুই মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। পরে তারা আইওটি ডিভাইসের মাধ্যমে অনলাইনে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। আর আমাদের দেশে শিক্ষকদের মাত্র ২৮ ভাগ প্রযুক্তি জ্ঞান রয়েছে। বাকি ৭২ ভাগের এ নিয়ে কোনো ধারণা নেই। এদিকে নজর না দিয়ে জনপ্রিয় অ্যাপের বিকল্প তৈরির ঘোষণা চটকদার কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু নয়। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নানা খাতে অনেক অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। এসব অর্থ এ ধরনের অ্যাপের পেছনে অযথা সময় ব্যয় করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এসব অ্যাপস বানাতে পারে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এতে তারা লাভবান হবে। সরকার কেন এসব বিকল্প প্রযুক্তি বানাতে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালে পরিস্থিতি বিবেচনায় যে যার মতো অ্যাপ বানাচ্ছেন। প্রচার করছেন ঢাকঢোল পিটিয়ে। বলা হচ্ছে- এ সবই জনস্বার্থে। কিছুদিন যেতে না যেতেই হারিয়ে যাচ্ছে সে সব অ্যাপস। অ্যাপস তৈরি করতে অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। খরচ করছেন অনেক টাকা। দিনশেষে বেশির ভাগ টাকাই যাচ্ছে জলে। বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থে এক বা একাধিক অ্যাপ তৈরি করতে খরচ করছেন লাখ থেকে কোটি টাকা। এসব অ্যাপ পরিচালনা করতে আবার বাড়তি লোকবল ও বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে তাদের। এসব দিক বিবেচনা করে ও সরকারি অর্থ ব্যয় কমাতে প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা এখন মত দিচ্ছেন জাতীয় কমিটি গঠন করতে। প্রযুক্তিগত সহায়তা ও পরামর্শের জন্য এ কমিটি গঠনের কথা বলছেন তারা। কমিটি প্রসঙ্গে প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা মানবজমিনকে জানান, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বা একজন সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি, সাংবাদিক প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, প্রযুক্তিবিদ, সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে গঠন করা যেতে পারে। এই জাতীয় কমিটির কাজ হবে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে জনস্বার্থে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগত সহায়তা পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা। ফলে রাষ্ট্র যেমন নিরাপদ থাকবে জনগণ ও সঠিক অপর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত ব্যবহার করতে পারবে। সাশ্রয় হবে প্রচুর পরিমাণ অর্থের।
প্রসঙ্গত জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বর্তমানে ১০৬টি দেশে ৫৩ কোটির বেশি গ্রাহক রয়েছে। অন্যদিকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জার (সংক্ষেপে হোয়াটসঅ্যাপ) সর্বাধিক জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ ও ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল পরিষেবা। প্রায় ২ বিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে এই অ্যাপসটির যা বর্তমানকালের সমধর্মী অন্য কোনো অ্যাপ-এর থেকে বেশি। বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমের স্মার্টফোনে এই মেসেঞ্জার ব্যবহার করা যায়। শুধু চ্যাটই নয়, এ মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ছবি আদান-প্রদান, ভিডিও ও অডিও মিডিয়া বার্তাও আদান-প্রদান করা যায়। মেসেঞ্জারটি অ্যাপলের আইওএস, ব্ল্যাকবেরি, অ্যান্ড্রয়েড, সিমবিয়ান ও উইন্ডোজ ফোনে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে ২০১৩ সালে জুমের পথচলা শুরু হলেও কোম্পানির ভাষায় ২০২০-এ এই কোম্পানি তার দুর্দান্ত পথচলা শুরু করেছে। সহজে ব্যবহারযোগ্য ও সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ফের সংযোগের সুবিধার মাধ্যমে গ্রাহকদের নজর কেড়েছে জুম। গত বছর মার্চ মাস থেকে তাদের গ্রাহকের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। তখন প্রতিদিন ২০০ মিলিয়নেরও বেশি মিটিং সামাল দিতে হতো তাদের। ঠিক পরের মাসেই তাদের গ্রাহক বেড়ে ৩০০ মিলিয়নে এসে দাঁড়ায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status