মত-মতান্তর

এ টেইল অব থট ডিসঅর্ডার!

যুক্তরাজ্য থেকে ডা: আলী জাহান

১ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ১১:৩৫ অপরাহ্ন

১) ৩০ বছর বয়সী শিক্ষিত যুবক মোবারকের ব্যাপারে চরম উদ্বিগ্ন তার স্ত্রী হেলেনা সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। মোবারক সাহেব মাঝে মধ্যে এমন কিছু কথাবার্তা বলছেন যা হেলেনা বুঝতে পারছেন না। শিক্ষিত স্কুলশিক্ষিকা হেলেনা পারভীন বুঝতে পেরেছেন তার স্বামীকে ডাক্তার দেখানো দরকার। কোন ধরনের ডাক্তার দেখাতে হবে সেই হোমওয়ার্ক করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে হাজির হয়েছেন।

২) একটি বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার মোবারক সাহেবের আগের কোন রোগের ইতিহাস নেই। দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন। করোনা আসার পর থেকে তার উপর দিয়ে অনেক মানসিক চাপ যাচ্ছে। প্রথমে হেলেনা ভাবছিলেন সমস্যাটা এমনিতেই চলে যাবে। কয়েক সপ্তাহ হয়ে যাবার পরও যখন সমস্যাটি যায়নি তখনই তিনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছেন।

৩) ঢাকার এক নাম করা বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখছেন প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কবির জুয়েল। অধ্যাপক সাহেবের রুমে ঢুকেই মোবারক সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, " আচ্ছা স্যার, আমার নাম মোবারক হোসেন। আপনি এখন বলুনতো আমার বাবার বয়স কত? অথবা তিনি কী চাকরি করেন? বলতে পারেন তিনি জীবিত না মারা গেছেন? আমার স্ত্রীর নাম হেলেনা পারবেন। বলুনতো দেখি আমার স্ত্রী কোথায় চাকরি করেন?"

৪) হেলেনা পারভীন মোবারক সাহেবের অদ্ভুত কথাবার্তার আরো কিছু উদাহরণ যোগ করেন। যেমনটা আজকে সকালে মোবারক সাহেব বলছিলেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন "আমি আকাশে চেয়ার নিয়ে বসে থাকলে তুমি কি আমাকে এক কাপ চা দিতে পারবে? গতরাত প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টিতে অনেক ঠান্ডা ছিল। ডাইনিং টেবিলে রাখা মাইক্রোওয়েভ গতরাত ঠান্ডায় অনেক কষ্ট পেয়েছে। ঠান্ডার মধ্যে চেয়ার টেবিলটা ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া করেনি। তাদের দিকে একটু খেয়াল রাখবে।"

৫) অধ্যাপক সাহেব আরো কিছু প্রশ্ন করেন। হেলেনা পারভিন ভয় পেয়ে গেলেও অধ্যাপক কবির জুয়েল হেলেনাকে আশ্বস্ত করেন। তিনি রোগ ধরতে পেরেছেন। মোবারক সাহেবকে তিনি ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। মোবারক সাহেবের সমস্যাকে মেডিকেলের ভাষায় thought disorder বলে। এটি একটি বড় মানসিক রোগের লক্ষণ। খাসা  বাংলা ভাষায় বলতে গেলে আপনি বলতে পারেন তা পাগলামি।

৬) Thought Disorder এ রোগীরা প্রচলিত শব্দগুলো দিয়ে যে বাক্য তৈরি করে তা সেন্স তৈরি করে না। উপরে বর্নিত বাক্যগুলোর দিকে খেয়াল করুন। সবগুলো শব্দের অর্থ আছে। কিন্তু সেই শব্দগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি। ফলশ্রুতিতে মোবারক সাহেবকে antipsychotic ঔষধ খেতে হবে। তিনি একটি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। রোগের নাম Schizophrenia.

৭)  এবার দেখা যাক আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মোবারক সাহেবের উপসর্গ বহন করছি কিনা। আমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে কি অধ্যাপক কবির জুয়েলের মতো সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে?

৮) করোনা মহামারীতে পৃথিবীর সবকটি দেশে লকডাউন দেয়ার প্রথম ২ সপ্তাহ পর রোগী এবং মৃত্যুর হার কমেছে এবং কমতে বাধ্য।সেই কমে যাওয়া কয়েক মাস চলেছে এবং পরবর্তীতে লকডাউন তুলে দেয়া হয়েছে অথবা শিথিল করা হয়েছে।

৯) বাংলাদেশ ভিন্ন স্বাদের এবং মাত্রার বিভিন্ন প্রকারের লকডাউন দেয়ার পর সর্বশেষ আখেরি লকডাউন দেয়া হয়েছে। কয়েক মাস হতে চললো। আক্রান্তের সংখ্যার খবর কী? করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের সংখ্যা কি বাড়ল না কমল? উত্তর হচ্ছে, সবগুলো সংখ্যাই বেড়েছে। তাহলে বাংলাদেশের লকডাউন কাজ করেনি। কেন করেনি? এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথবা করোনা বিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটি কি কোন জবাব দেবেন?

১০) সংখ্যা বাড়ছে। হুঁ হুঁ করে বাড়ছে। হাসপাতালের বেড নেই। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে আইসিইউ অথবা করোনা রোগীর বেড খুঁজতে গিয়ে মানুষ মারা পড়ছে। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে।চিকিৎসার অভাবে হাসপাতালের বারান্দায় অথবা রাস্তায় মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। বাড়িতে মারা পড়ছেন। সামান্য জ্বর কাশি, হঠাৎ শ্বাসকষ্ট। জীবনের ইতি টানছেন। সে ইতি টানা বড্ড কষ্টের। যারা বেঁচে আছেন তাদের জন্য অনেক কষ্টের।


১১) ০১ জুলাই থেকে চালু হওয়া আখেরি লকডাউন দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল কার? কিসের ভিত্তিতে সেই লকডাউন ঈদের আগে ৯ দিনের জন্য শিথিল করা হয়েছিল? কোন ওলী আউলিয়ার পরামর্শে গণপরিবহন এবং গার্মেন্টস এখন খুলে দেয়া হচ্ছে?

১২)  সরকার যুক্তি দিতে পারে যে মানুষের রুটি রোজগার নিশ্চিত করার জন্য লকডাউন শিথিল করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেই ক্ষমতা কি আসলেই আপনাদের নেই? একটু ইতিহাস ঘেঁটে আসা যাক। দেখা যাক আপনারা কী কী দাবি করেছেন।

১৩) ১৪ মে ২০১৯ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গর্ব করে বলেছিলেন "বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন কানাডার সমান"। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছিলেন "বাংলাদেশের অর্থনীতির সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী"। দুটি খবরে সংশ্লিষ্ট তারিখে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো পত্রিকায় এসেছিল। কানাডা আর সিঙ্গাপুরের চেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি কি স্বপ্নে পাওয়া হাওয়াই মিঠাই না আসলেই বাস্তব?

১৪) কানাডা-সিঙ্গাপুরের চেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে মারা যাবে কেন? ইউরোপে প্রবেশ করার জন্য ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা পড়বে কেন? বিনা চিকিৎসায় মারা পড়বে কেন? কেন লকডাউন দিয়ে একমাস মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষগুলোকে খাওয়ানোর ক্ষমতা আপনাদের থাকবে না? তাহলে কি আসলেই কথাগুলো সঠিক ছিলনা? শব্দচয়ন সঠিক ছিল, কিন্তু যে বাক্যগুলো তৈরি করা হয়েছিল তাহলে তা বাস্তব ছিল না।

১৫) উঁচু তলায় বসে যারা আমাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন তাদের কথাবার্তা যখন বাস্তবের সাথে মিলে না তখন তাকে কি বলা যায়? Thought Disorder?

১৬) মোবারক হোসেনের ভাগ্য ভালো যে, তিনি উঁচুমানের অভিজ্ঞ একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। আশা করা যায়, সঠিক ওষুধ নিয়ে তিনি সেরে উঠবেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। কথা হচ্ছে যে, মোবারক হোসেন ছাড়াও আমাদের মধ্যে যাদের কথাবার্তার মধ্যে মিল নেই তাদের চিকিৎসা করবে কে? তাঁদের thought disorder ডায়াগনোসিস করবে কে? কে দেবে তাদের চিকিৎসা? নাকি তারা সবাই ওলি-আউলিয়ার পর্যায়ে চলে গেছেন যে তাদেরকে প্রশ্ন করা যাবে না? চ্যালেঞ্জ করা যাবে না?

ডা: আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, UK এবং সাবেক পুলিশ সার্জন (যুক্তরাজ্য পুলিশ)
[email protected]

(পুনশ্চ: রোগীর গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে মোবারক হোসেনের কাহিনীতে স্থান-কাল-পাত্রের কিছু পার্থক্য আনা হয়েছে।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status