প্রথম পাতা

কেন এই সমন্বয়হীনতা?

সিরাজুস সালেকিন

২ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ৯:০১ অপরাহ্ন

বলা হয়েছিল এবারের লকডাউন কঠোরতম হবে। বন্ধ থাকবে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান। শুরুটা কঠোর হলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে পরিস্থিতি অনেকটা হ-য-ব-র-ল। একের পর এক সমন্বয়হীন সিদ্ধান্তে দিকভ্রান্ত মানুষ। বিশেষ করে কল-কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে রীতিমতো তামাশা করছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। রাতে ঘোষণা দিয়ে সকালে কাজে আসার তাড়া। যানবাহন নেই। হেঁটে-গড়িয়ে কর্মক্ষেত্রে আসা মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষও। মহামারি নিয়ন্ত্রণে যেখানে পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত আসার কথা সেখানে কেন এমন সমন্বয়হীনতা এর কোনো জবাব মিলছে না কারও কাছ থেকে।
রপ্তানিমুখী শিল্প ও কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হয় গত শুক্রবার। এ সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদের প্রজ্ঞাপনে শুধু কারখানা খোলার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। কিন্তু ঈদের ছুটিতে গ্রামে আটকে থাকা শ্রমিকরা কীভাবে ঢাকায় ফিরবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা ছিল না। গণপরিবহন বন্ধ রেখে কারখানা খোলার খবরে দুশ্চিন্তায় পড়েন শ্রমিকরা। বাস-ট্রেন-লঞ্চ বন্ধ থাকায় শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। যাত্রীবাহী লঞ্চ বন্ধ থাকায় হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান ফেরিঘাটগুলোতে। কখনো পায়ে হেঁটে, কিছুপথ রিকশা-অটোরিকশায়, সুযোগ পেলে পিকআপ ভ্যানের পেছনে দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করেই তারা ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে কারখানায় ফেরার চেষ্টা করেন। এরমধ্যে গত শনিবার রাত ৯টায় তথ্যবিবরণীতে জানানো হয়, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের কাজে যোগদানের সুবিধার্থে গতকাল বেলা ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। একই সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ বিজ্ঞপ্তি জারি করে, গত শনিবার রাত ৮টা থেকে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল করবে। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। শেষ মুহূর্তে কাজে যোগ দিতে ঢাকামুখী হতে থাকে মানুষের স্রোত। পরিস্থিতি সামলাতে যাত্রীবাহী লঞ্চ চালু রাখার ঘোষণা দেয় বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। গণপরিবহন চালু না করে কারখানা খোলার সিদ্ধান্তের পেছনে সমন্বয়হীনতা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার স্বল্প সময়ের নোটিশে গণপরিবহন চালু ও বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি বলে মনে করছেন তারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম বলেন, সমস্ত গণপরিবহন বন্ধ রেখে গার্মেন্ট খুলে দেয়া ঠিক হয়নি। সমন্বয়হীনতার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে কাজটা অনুচিত। গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় বড় ঘাটতি ছিল। অন্তত তিনদিন সময় দিয়ে সব গণপরিবহন চালু করে দিলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকরা ঢাকায় ফিরতে পারতো। অথচ স্বল্প সময় দিয়ে গণপরিবহন চালু করা হয়েছে। ফলে মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ৫ই আগস্ট পর্যন্ত কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করা গেলে সংক্রমণ অনেকটা কমে যেতো। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল করা হতো। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে সরকার শিল্প কারখানা খুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। ব্যবসায়ীরা প্রথমে জানিয়েছিলেন, স্থানীয় কর্মীদের নিয়ে কারখানা চালু করা হবে। কিন্তু কারখানা খোলার খবরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কাজে যোগ দিতে কর্মীরা মরিয়া হয়ে ঢাকার দিকে ছুটতে থাকেন। এ অবস্থায় সীমিত সময়ের জন্য সরকার গণপরিবহন চালু করতে বাধ্য হয়। কারখানার মালিকরা সুনির্দিষ্টভাবে নোটিশ দিলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। গণপরিবহন পুরোপুরি চালু না করে কারখানা খোলার বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে যুক্তি তুলে ধরেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। গত শনিবার তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, শুধু যারা ঢাকাতে আছে, কারখানার আশপাশে যারা রয়ে গেছে, তারা কাজ করবে ৫ তারিখ পর্যন্ত। আমরা এর ভেতরে সিদ্ধান্ত নেবো, ৫ তারিখের পর কী হবে। কীভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সেটি আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের কাজকর্মগুলো, যেগুলো একেবারেই অপরিহার্য, সেগুলো চালানো। সেটি কী করলে ভালো হবে, সেজন্য আরেকটু সময় আমাদের লাগবে। কারখানার শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছেন- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ফরহাদ হোসেন বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা বলেছিলেন, যেসব শ্রমিক ঈদে বাড়ি যাননি বা ঈদের পর পর চলে গেছেন এবং কারখানার আশপাশে থাকেন, তাদের নিয়ে কারখানা চালু রাখা হবে। গার্মেন্ট মালিকরা বলেছেন, পরে যারা আসবেন, তাদের চাকরিতে কোনো সমস্যা হবে না। ৫ই আগস্টের পর পর্যায়ক্রমে তাদের আনা হবে। বিষয়টি স্পষ্টই ছিল। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই গতকাল থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দিয়েছে সরকার। এর বাইরে সবকিছু বন্ধ থাকবে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত। এরপর বিধিনিষেধ বা লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিকল্প নিয়েও আলোচনা করছে সরকার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ৫ই আগস্টের পর লকডাউন আরও অন্তত ১০ দিন বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এরআগে বেশ কয়েক দফা লকডাউন শিথিলের বিপক্ষে ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, আমরা কীভাবে এই সংক্রমণ সামাল দেবো? রোগীদের কোথায় জায়গা দেবো? সংক্রমণ যদি এভাবে বাড়তে থাকে তাহলে কি পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব? অবস্থা খুবই খারাপ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব বিবেচনাতেই আমরা বিধিনিষেধ আরও ১০ দিন বাড়ানোর সুপারিশ করেছি। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২৩শে জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ চলছে, যা আগামী ৫ই আগস্ট পর্যন্ত চলবে। গত শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক আদেশে জানায়, ১লা আগস্ট থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্প ও কলকারখানা চলমান বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত থাকবে। এরআগে কোরবানির পশুর চামড়া পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, খাদ্য ও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণ কলকারখানা এবং ওষুধ, অক্সিজেন ও কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনকারী শিল্পও এ বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখার কথা জানিয়েছিল সরকার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status