শেষের পাতা

মোবাইল ইন্টারনেট নিয়ে অসন্তোষ

কাজী সোহাগ

২ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ৮:৫০ অপরাহ্ন

মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম ছেলের অনলাইন ক্লাসের জন্য মোবাইল ইন্টারনেটের প্যাকেজ ব্যবহার করছেন কয়েকদিন হলো। কিন্তু ছেলে ঠিকমতো ক্লাস করতে পারেন না। কারণ ইন্টারনেটের গতি স্লো। পাশের বাসার বাসিন্দা হালিম উদ্দিনেরও একই অবস্থা। মোবাইল ইন্টারনেটের 
মাধ্যমে জুম মিটিংয়ে অংশ নিলে অসংখ্যবার প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। একই এলাকার আরেক বাসিন্দা হাফিজা বেগম। অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু মোবাইল ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে তার ব্যবসায় এখন বন্ধের পথে। কারণ ঘরের মধ্যে মোবাইল সংযোগের পাশাপাশি মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ পেতেও বেগ পেতে হয়। এ চিত্র শুধু রাজধানীর মিরপুরের নয়। সারা বাংলাদেশেই চিত্র এরকম। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) এ পর্যন্ত হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু সমাধান হয়েছে হাতেগোনা। মোবাইল অপারেটররা এ নিয়ে যতটা ব্যবসা করতে পছন্দ করেন ততটা মান নিয়ে কাজ করেন না-এমন অভিযোগ সাধারণ গ্রাহকদের। তারা বলেন, ইন্টারনেট প্যাকেজ নিয়ে অপারেটরদের রয়েছে অর্ধ-শতাধিক প্যাকেজ। ইন্টারনেট নিয়ে তাদের অফারগুলো দেখলে মনে হয় আমাদের সেবা দিতে পারলে তারা ধন্য হয়। অথচ প্যাকেজে ইন্টারনেট ও তার গতি নিয়ে যা বলা হয় তা ঠিকমতো রক্ষা করা হয় না। আমরা মনে করি এটা এক ধরনের প্রতারণা। ব্যবসার পাশাপাশি মানের দিকটাও অপারেটরদের গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। সংশ্লিষ্টরা জানান, মোবাইল গ্রাহকদের মূল অভিযোগ হচ্ছে বড় শহরের বাইরে কভারেজ দুর্বলতা, নিম্নগতি এবং ইন্টারনেট জিবি’র স্বল্প মেয়াদ। আমাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি শ্রমবাজারের প্রায় ৮৯ শতাংশ বলে এ খাত মোবাইল ইন্টারনেটের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল। ফলে, যেকোনো ইন্টারনেট জিবি প্যাকেজের মেয়াদকে তিন, পাঁচ বা সাত দিনের পরিবর্তে অন্তত এক মাস করা উচিত। ফোরজি থেকে নেটওয়ার্ক ঘন ঘন টু-জিতে চলে যাওয়া একটা বড় সমস্যা। আধুনিক ব্রাউজারে নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিল্টইন অ্যাপ্লিকেশন থাকে বলে টু-জির ব্রাউজিং সক্ষমতা প্রায় শূন্য বলে টু-জি ডেটাতে প্রাইসিং অন্যায্য। এই ডেটা দিয়ে পেজ লোড হয় না, বরং সময় নষ্ট হয়। ভোক্তা অধিকারের দিক থেকে টু-জিতে ব্যবহৃত ডেটার ক্ষতিপূরণ (কেটে রাখা রাজস্বসহ) দেয়া উচিত। মোবাইল স্বল্প মেয়াদের তুলনামূলক সস্তার বড় প্যাকেজের জিবি শেষ হয় না বলে জিবি অপব্যবহারে পড়ে, এতে শ্রমঘণ্টা এবং স্পেকট্রাল অ্যাসেট, দুটিরই অপচয় হয়। ফলে, নতুন জিবি ক্রয় সাপেক্ষে পুরনো প্যাকেজের একটা অংশ পুনঃব্যালেন্স হওয়ার দাবি রাখে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার। ব্রডব্যান্ডের ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হচ্ছে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪শ’ জিবিপিএস। আর প্রায় ১২ কোটি মোবাইলভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ব্যবহার করে মাত্র ৯শ’ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ। এখানে সহজেই অনুমেয় যে সর্বাধিক গ্রাহকদের সেবা দিতে এত কম পরিমাণ ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করার পরেও মোবাইল ফোন অপারেটরদের রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ এত বেশি কেন? এ নিয়ে গ্রাহকদের ভেতর ক্ষোভ জন্মেছে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রকাশ করছেন। তিনি বলেন, টাকা দিয়ে ডাটা বা টকটাইম কেনার পরে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অব্যবহৃত ডাটা ও টকটাইম পরবর্তী রিচার্জের সময় পাওয়া যাচ্ছে না কেন? হিসাবটা খুবই সহজ। যেমন ধরুন- আপনি ১জিবি ডাটা কিনেছেন কিন্তু ব্যবহার করেছেন মাত্র ৫০০ এমবি, এর মধ্যে আপনার নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাহলে অব্যবহৃত এমবি কোথায় গেল? উত্তর খুবই সহজ, অব্যবহৃত এমবি দিয়ে বিভিন্ন প্যাকেজ তৈরি করে পুনরায় বিক্রি করা হয়েছে গ্রাহকদের কাছে। যেহেতু নিয়ন্ত্রক কমিশন ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণের জন্য কস্ট মডেলিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই আমরা করোনা মহামারিতে দাম না কমিয়ে ইন্টারনেট ডাটা ও টকটাইমের মারপ্যাঁচ বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি। অর্থাৎ আমাদের দাবি অব্যবহৃত ডাটা টকটাইম পরবর্তী রিচার্জের সময় যুক্ত করা। বিষয়টি বিবেচনার জন্য মোবাইল ফোন অপারেটর, নিয়ন্ত্রক কমিশন ও সরকারকে বিনীতভাবে বিবেচনার অনুরোধ করছি। ইন্টারনেটের গতি মাপার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলার ‘স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স’ মতে, বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫ নম্বরে (জুন ২০২১)। বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ভেনিজুয়েলা। যে উগান্ডাকে নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ট্রল করি, তারাও আমাদের চেয়ে ৮ ধাপ এগিয়ে রয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশ আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়া থেকে ৭ ধাপ, তাঞ্জানিয়া থেকে ৫, সোমালিয়া থেকে ৪, ঘানা থেকে ৩, সুদান থেকে ২ এবং জিম্বাবুয়ে থেকে ১ ধাপ পিছিয়ে আছে। প্রযুক্তিবিদরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সবক’টি নেটওয়ার্কের প্রধানতম যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও সেবা সরবরাহকারী চীন থেকে ১২৯টি দেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ, যেখানে ডাউনলিংকে গড়গতি পার্থক্য সেকেন্ডে ১৪৭ মেগাবিট। বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গড় লেটেন্সি ও জিটার যথাক্রমে ৪৩ ও ৪৭ মিলি সেকেন্ড। যদিও জানুয়ারি মেজারমেন্টে লেটেন্সি ও জিটার ছিল ৩৮ ও ৩৯ মিলিসেকেন্ড করে। এই ছয় মাসে বাংলাদেশের এক ধাপ অবনমনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এখানে। একটি মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য যে সময় নেয়, তার নির্দেশক হচ্ছে লেটেন্সি ও জিটার। মিলিসেকেন্ড স্কেলে এ সময় যত বেশি লাগবে, ইন্টারনেট গতি ততই কম হবে। টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ও ভোডাফোন নেদারল্যান্ডসের সিনিয়র সলিউশন আর্কিটেক্ট ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তার এক বিশ্লেষণে জানিয়েছেন, ফোরজিতে ব্যবহারের উপযোগী ৭০০, ৮০০, ৯০০, ১৪০০, ১৮০০, ২১০০, ২৬০০, ২৭০০ ব্যান্ডের তরঙ্গগুলোকে বিটিআরসি সহজলভ্য করতে পারেনি। ৯০০, ১৮০০, ২১০০ ব্যান্ড বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, ৭০০, ৮০০, ২৬০০, ২৭০০ ব্যান্ড একেবারেই অব্যবহৃত। অপখাতে বিক্রীত কিছু তরঙ্গ যেমন একেবারেই অব্যবহৃত পড়ে আছে, তেমনি এখনো কিছু তরঙ্গ রেল কিংবা সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য রিজার্ভ। এই সমুদয় বাণিজ্যিক ব্যান্ডগুলোকে ফোরজি ও ফাইভজির (৩.৫ গিগা, সাব-সিক্সসহ) জন্য উন্মুক্ত করার মাস্টারপ্ল্যান অনুপস্থিত। একদিকে বিটিআরসি’র চরম অদক্ষতায় ‘আইনি ঝামেলার’ নামে অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ‘স্পেকট্রাল অ্যাসেট’ কিছু ব্যাংক্রাপ্ট কোম্পানির হাতে অব্যবহৃত পড়ে আছে, অন্যদিকে টেলিটকও মাত্র ১ শতাংশ গ্রাহক নিয়ে বরাদ্দ তরঙ্গ নষ্ট করছে। কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও এসব তরঙ্গ উন্মুক্ত করা দরকার। তিনি বলেন, এক যুগ ধরে টেলিকমের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো খাতের দায়িত্বে যাদের রাখা হয়েছে, তাদের মুখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গালভরা কথাবার্তা শোনা গেলেও ইন্টারনেটের মতো মৌলিক সেবা খাতেই বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তলানিতে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থের সংঘাত পেছনে ফেলে মেধাভিত্তিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status