শেষের পাতা

রপ্তানির পোশাক চুরি বিদেশে দুর্নাম

আলতাফ হোসাইন

১ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ৮:১৫ অপরাহ্ন

চলতি বছরের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের একটি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান ইউরোপের কয়েকটি দেশ এবং আমেরিকায় বিপুল পরিমাণ পোশাক রপ্তানি করে। কিন্তু ক্রেতারা জানায়, আমদানিকৃত পণ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কম পেয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করলে ক্রেতারা পণ্যের কার্টনের ছবি ও ভিডিও পাঠায়। সেখানে দেখা যায় প্রতিটি কার্টনে যে পরিমাণ পণ্য থাকার কথা ঠিক সেই পরিমাণ নেই। প্রতিটি কার্টনে ৩ ভাগের এক ১ ভাগ পোশাক কম দেখতে পান তারা। এমন পরিস্থিতিতে বায়ারদের কোনোমতে বুঝিয়ে শুনিয়ে ম্যানেজ করেন ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এভাবেই তৈরি পোশাক রপ্তানির সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে দীর্ঘদিন ধরেই পোশাক চুরির ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র চালক-সহযোগীদের সঙ্গে মিলে রাস্তায় কাভার্ডভ্যান দাঁড় করিয়ে রপ্তানি পোশাক ও মালামাল চুরি করছে। এতে বায়াররা অর্ডার বাতিল করাসহ বাংলাদেশ থেকে নতুন করে পণ্যের অর্ডার না করে বিকল্প বাজার খুঁজে নিচ্ছেন। এমনটিই বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি গোয়েন্দা অনুসন্ধানে এমনই একটি চক্রের সন্ধান মেলে, যারা নারায়ণগঞ্জের ওই প্রতিষ্ঠানেরই পণ্য পরিবহনের কাজে চুক্তিবদ্ধ ছিল। পরে ওই চক্রের ৫ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। একইসঙ্গে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ চোরাই পোশাক। গ্রেপ্তারের পর ওই চক্রের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে পোশাক চুরির অভিনব কৌশল। তারা জানায়, চুক্তিবদ্ধ পণ্য পরিবহনের কাভার্ডভ্যানে পোশাক আনতে নির্দিষ্ট দিনে কারখানায় যায়। এরপর পণ্য লোডের পর কাভার্ডভ্যান রওনা হয় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নিজস্ব গোডাউনে নিয়ে কার্টন খুলে সেখান থেকে ৩ ভাগের ১ ভাগ পণ্য সরিয়ে ফেলা হয়। পরে এমনভাবে কার্টনগুলো আটকানো হয় যাতে কোনোভাবেই যেন বোঝা না যায় যে কার্টনের মুখ খোলা হয়েছিল। পরবর্তীতে চুরি করা পোশাকগুলো দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বায়ারদের কাছে বিক্রি করে দেয় চক্রটি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে যেমন বিশ্ব বাজারে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তেমনি পোশাক রপ্তানিতে বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের একজন পুলিশকে জানায়, বেশকিছু ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিসহ কয়েকটি চক্র চালক ও সহযোগীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। প্রতি চালানে চালককে দেয়া হয় ২০ হাজার আর সহযোগীকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। অতিরিক্ত আয়ের লোভে ৪-৫ বছর ধরে এভাবে পোশাক চুরির কাজের সঙ্গে জড়িত বলে জানান তিনি।
ওয়েস্ট নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বায়াররা পণ্যগুলো ক্রয়ের পর তাদের লোক দিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর আমরা সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেই। একেকটি কাভার্ডভ্যানে ৪০০-৪৫০টি করে কার্টন থাকে। কিন্তু এই চক্রটি যাত্রাপথে বিশেষ পদ্ধতিতে কার্টনগুলো খুলে প্রতিটি কার্টন থেকে ৭-৮ পিস করে পণ্য রেখে দেয়। পরে কার্টনগুলো তারা এমনভাবে আবার আটকিয়ে দেয় যাতে কোনোভাবেই বোঝা না যায় যে কার্টন খোলা হয়েছিল। সেজন্য বায়ারদের লোকজন বুঝতে পারে না। তারা দেখে যে কার্টন ঠিক আছে। কার্টনের নাম্বারও ঠিক আছে। তারা কার্টন দেখেই আমাদের বিল বুঝিয়ে দেয়। পণ্যগুলো রপ্তানির আগ পর্যন্ত কেউ এটা বুঝতে পারে না। কিন্তু বায়াররা যখন পণ্যগুলো স্টোরে নেয় তখন আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। তারা বলে যে কার্টনে পোশাক কম আসছে। তখন আমরা তাদের বলি যে এটা হওয়ার কথা নয়। আমরা তখন তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলে তারা আমাদের ছবি, ভিডিও করে পাঠিয়ে বিভিন্নভাবে নিশ্চিত করে। তখন তারা হিসাব করে আমাদের জানায় যে কি পরিমাণ পণ্য কম আসছে। এভাবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে প্রায় ২ লাখ ডলারের ক্লেইম চলে আসছে। এতে বায়াররা আমাদের ওপর খুবই বিরক্ত। এভাবে চলতে থাকলে ক্রমেই আমরা বিদেশি বায়ার হারাতে থাকবো। এতে দেশের পোশাক খাতের জন্য খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন- বিজিএমইএ এর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম মানবজমিনকে বলেন, এমন কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। যাত্রাপথেই বিশেষ কৌশলে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র এগুলো করে থাকে। তবে এটি শিল্পের জন্য কখনোই ভালো হবে না। কারণ এতে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এটা চলতে থাকলে ক্রেতারা আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাই আমরা বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে প্রধান করে বিজিএমইএ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির প্রতিনিধির অনেকে আছেন। আমিও এই কমিটিতে আছি। এখন বিষয়টি নিয়ে আমরা আগামী ২৮শে জুলাই আবার বৈঠক করবো। সেখানে আমরা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সেদিনের বৈঠকে বলা হয়েছিল যে, চট্টগ্রামের হাইওয়েজুড়ে সিসিটিভি লাগানো হবে। যাতে এই চক্রটিকে সহজে চিহ্নিত করা যায়।
সম্প্রতি বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রধানদের অভিযোগ আকারে জানায় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন- বিজিএমইএ। সচিবালয়ে গার্মেন্ট মালিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে মতবিনিময়কালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যেভাবেই হোক, রপ্তানি পণ্যের চুরি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতেই হবে। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স বলে জানান তিনি। ওই বৈঠকে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বন্দরে পোশাক পণ্য চুরির ঘটনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘদিন ধরে পোশাক খাতের রপ্তানি ও আমদানির মালামাল চুরির ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে একটি সংঘবদ্ধ চক্র চালকদের সঙ্গে মিলে রাস্তায় কাভার্ডভ্যান দাঁড় করিয়ে মালামাল চুরি করছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় কার্টনের ওজন ঠিক রাখার জন্য তারা কার্টনে ঝুট, মাটি ইত্যাদিও ভরে দিচ্ছে। এগুলো এইভাবে আমেরিকা ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে গেলে তারা অভিযোগ জানাচ্ছেন। এতে একদিকে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন, অন্যদিকে বিদেশে দেশের সুনামও নষ্ট হচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status