দেশ বিদেশ

টোকিও অলিম্পিক

দশ সেকেন্ডের বাধা পার হতে বিজ্ঞান যেভাবে স্প্রিন্টারদের সাহায্য করছে

৩১ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৭:৩৭ অপরাহ্ন

২০১২ লন্ডন অলিম্পিকসে পুরুষদের ১০০ মিটার দৌড়ের ফাইনালে ৮ জনের ৭ জনই দৌড় শেষ করেছেন ১০ সেকেন্ডের কম সময়ে। অ্যাথলেটিক্সের গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে এটি ছিল খুবই বড় একটি ঘটনা কিন্তু ২০১২ সালের অলিম্পিকসের সময় লন্ডনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ভেতরে যেসব দর্শক বসেছিলেন তাদের পক্ষে সেটা অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি। এ সময় পুরুষদের ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় উসাইন বোল্ট-এর ফিনিশিং লাইন পার হওয়ার দৃশ্য স্ক্রিনে বড় করে দেখানো হচ্ছিল। সেদিনে রাতে জ্যামাইকার এই সুপারস্টার আরো একটি স্বর্ণপদক জয় করেন এবং ৯.৬৩ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড় শেষ করে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। ‘এখনো পর্যন্ত এটাই ছিল সবচেয়ে সেরা দৌড়,’ বলছিলেন যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড হালাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর স্টিভ হাক। তবে মি. হাক শুধুমাত্র উসাইন বোল্টের প্রশংসা করেননি। পুরো ইভেন্টে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের সবার দুর্দান্ত পারফরমেন্সের ব্যাপারেই তিনি এই মন্তব্য করেছেন। এই ইভেন্টের ফাইনালে যে ৮ জন অ্যাথলেট অংশ নিয়েছেন তাদের একজন বাদে বাকি ৭ জনই ১০০ মিটার দৌড় শেষ করেছেন ১০ সেকেন্ডের কম সময়ে।

এটি এক নজিরবিহীন ঘটনা।
একশ’ মিটার দৌড়ে স্প্রিন্টারদের সামনে এই ১০ সেকেন্ড যেন একটি বাধা হয়ে ছিল এতদিন। তাদের পক্ষে এ রকম সময়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছিল না। দশ সেকেন্ডের এই সীমা প্রথম অতিক্রম করা হয় ১৯৬৮ সালে এবং স্প্রিন্টারদের জন্য এটি ছিল অনেক বড় এক অর্জন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এমন স্প্রিন্টারের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে যারা ১০ সেকেন্ডের কম সময়ে ১০০ মিটার দৌড় শেষ করেছেন। অ্যাথলেটিক্সের আন্তর্জাতিক পরিচালনা সংস্থা ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্সের তথ্য অনুসারে ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত- এই ৪ দশকে মাত্র ৬৭ জন অ্যাথলেট ১০ সেকেন্ডের বাধা ডিঙ্গাতে পেরেছেন। কিন্তু এর পরের ১০ বছরে দ্রুতগতিসম্পন্ন এই স্প্রিন্টারদের ক্লাবে যোগ দিয়েছেন আরো ৭০ জন। এবং এ বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত, আগের দুই বছরে আরো ১৭ জন অ্যাথলেট এই প্রথমবারের মতো ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ১০০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছেন। নারীদের জন্য এই সীমা ছিল ১১ সেকেন্ড এবং এই বাধাও এখন গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

কী হচ্ছে আসলে?
স্টিভ হাকের মতো বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এর পেছনে রয়েছে নানা কারণ- এই ট্র্যাক ইভেন্টে প্রতিযোগীর অংশগ্রহণ যেমন বেড়েছে, তেমনি অ্যাথলেটরা এখন আগের তুলনায় ভালো প্রশিক্ষণও পাচ্ছেন। ‘সারা বিশ্বে এখন আরো বেশিসংখ্যক অ্যাথলেট উন্নত ধরনের প্রশিক্ষণ পাচ্ছে এবং দ্রুত দৌড়ানোর জন্য তারা ক্রীড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরও সাহায্য পাচ্ছে’ বলেন মি. হাক। এ রকম দ্রুতগতির স্প্রিন্টারের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র এবং জ্যামাইকার বাইরে অন্যান্য দেশগুলোতেও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে সাধারণত এই দুটো দেশের অ্যাথলেটদের সাফল্যের কথাই শোনা যেতো। কিন্তু এখন যুক্তরাজ্য এবং কানাডার মতো দেশেও এ রকম দ্রুতগতির দৌড়বিদ পাওয়া যাচ্ছে। এসব দেশের অ্যাথলেটরা অলিম্পিকে পুরুষদের ১০০ মিটার ইভেন্টে অন্তত একটি স্বর্ণপদক জয় করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে নাইজেরিয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যে দেশের ১০ জন অ্যাথলেট এখনো পর্যন্ত ১০ সেকেন্ডের বাধা অতিক্রম করতে পেরেছেন। যুক্তরাজ্যের অবস্থাও তাই। অ্যাথলেটদের সংখ্যার হিসেবে এই দুটো দেশের অবস্থান তৃতীয়। সম্প্রতি এই ক্লাবে যোগ দিয়েছে জাপান, তুরস্ক, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও। অথচ স্প্রিন্টিং প্রতিযোগিতায় এসব দেশের তেমন একটা সাফল্য নেই বললেই চলে। একই চিত্র দেখা গেছে নারীদের ১০০ মিটার দৌড়ের ক্ষেত্রেও। তাদের বেলায় ১১ সেকেন্ডের যে বাধা ছিল সেটা প্রথম ভাঙা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। পূর্ব জার্মানির স্প্রিন্টার রেনাটে স্টেচার এই রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এর পরে ২০১১ সালের মধ্যে আরো ৬৭ জন নারী অ্যাথলেট এই সীমা অতিক্রম করেছেন। ১০ বছর পরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫ এবং তাদের মধ্যে এমন সব দেশের অ্যাথলেটও রয়েছেন, এই ইভেন্টে যেসব দেশের খুব একটা সাফল্য নেই।

জুতা, ট্র্যাক এবং ক্রীড়া বিজ্ঞান
এ বিষয়ে প্রযুক্তিও ভূমিকা রাখছে। যেমন স্প্রিন্টাররা আজকাল যে ধরনের জুতা পরে দৌড়াচ্ছেন সেগুলো হালকা- সবচেয়ে আধুনিক মডেলের জুতার ওজন হতে পারে ১৫০ গ্রামেরও কম। বর্তমানে একেবারে ভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে এসব জুতা তৈরি করা হচ্ছে। একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে জার্মান কোম্পানি পুমা এবং ফর্মুলা ওয়ানের টিম মার্সিডিজ যৌথভাবে এমন এক ধরনের স্প্রিন্টিং জুতা তৈরি করেছে যার সোল বা তলা কার্বন ফাইবার দিয়ে বানানো। কার রেসিং-এ কয়েকবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ড্রাইভার লুইস হ্যামিলটনের গাড়ি নির্মাণেও এই একই উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে।

এছাড়া দৌড়ানোর ট্র্যাকেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। অ্যাথলেটরা আগে এ ধরনের প্রতিযোগিতায় মাটি কিম্বা ঘাসের ওপর দৌড়াতেন। কিন্তু এখন তারা দৌড়াচ্ছেন সিনথেটিক ট্র্যাকে। অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো সিনথেটিক ট্র্যাক ব্যবহার করা হয় ১৯৬৮ সালে, মেক্সিকোতে। এ ধরনের ট্র্যাকে দৌড়াতে গিয়ে স্প্রিন্টাররা তাদের শরীরের জয়েন্টে আরো বেশি সুরক্ষা পান এবং এ ধরনের ট্র্যাকে স্প্রিংবোর্ডের মতো এফেক্ট পাওয়া যায়, যে কারণে স্প্রিন্টাররা দ্রুতগতিতে দৌড়াতে পারেন। আমেরিকান স্প্রিন্টার জিম হাইন্স ১৯৬৮ সালের ওই অলিম্পিকে ১০ সেকেন্ডের বাধা অতিক্রম করেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এতো দ্রুত ১০০ মিটার দৌড় সম্পন্ন করেছেন। এজন্য তার সময় লেগেছে ৯.৯৫ সেকেন্ড। ট্র্যাকের উপরি-পৃষ্ঠ তৈরিতে রাবারের ছোট ছোট যেসব শক্ত কণা ব্যবহার করা হয় সেগুলোর আকারও এখন বিবেচনা করা হয় দ্রুতগতিতে দৌড়ানো যায় এমন ট্র্যাক নির্মাণের জন্য। বেইজিং-এ ২০০৮ সালের অলিম্পিক গেমসে ইতালির একটি কোম্পানি, মন্ডো, দৌড়ের ট্র্যাক তৈরি করেছিল যাতে তৈরি হয়েছিল ৫টি বিশ্ব রেকর্ড। দৌড়বিদরা এই ঘটনা যেভাবে উদযাপন করেছিল, ইতালির ওই কোম্পানিটিও ঠিক ততটাই খুশি হয়েছিল।

পুষ্টি, প্রশিক্ষণ ও বিজ্ঞান
অ্যাথলেটদের পুষ্টি এবং প্রশিক্ষণের পেছনেও বিজ্ঞানের ভূমিকা রয়েছে। আজকের দিনের স্প্রিন্টারদের পারফরমেন্স পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করা যায় এবং সে অনুযায়ী নির্ধারণ করা যায় তাদের কৌশল ও সময়। এছাড়াও গবেষণার মাধ্যমে স্প্রিন্টারদের শরীরের সেইসব পেশি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে যেগুলো তাদের সাফল্যের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গত বছরের অক্টোবর মাসে লাফবারা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ক্রীড়া বিজ্ঞানের বিষয়ে পড়াশোনার জন্য এটি একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান) বিজ্ঞানীদের একটি দল আবিষ্কার করেছে যে ট্র্যাকে দ্রুত দৌড়ানোর জন্য গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস নামের একটি পেশি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পেশি পশ্চাৎদেশ গঠন করে থাকে। ‘এখন আমরা জানি যে স্প্রিন্টারদের দেহে রয়েছে বিশেষ ধরনের পেশি। ফলে আমরা হয়তো খুব শিগগিরই দেখতে পাবো যে অ্যাথলেটরা বিশেষভাবে সেসব পেশির উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন’ বলেন এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন এমন একজন বিজ্ঞানী স্যাম অ্যালেন।

এই বাধা কি মানসিকও?
জাপানের একজন স্প্রিন্টার রায়োতা ইয়ামাগাতা আশাহি শিম্বুন পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ১০০ মিটার দৌড় শেষ করার সাফল্যের জন্য বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বের কথা স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। তিনি বলেছেন, এর পেছনে বিজ্ঞানীদের গত ২০ বছরের গবেষণারও ভূমিকা রয়েছে। জাপানি কোনো স্প্রিন্টার ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত ১০ সেকেন্ডের বাধা ডিঙ্গাতে পারেননি। কিন্তু এর পরে ইয়ামাগাতা এবং আরো ৩ জন অ্যাথলেট সেটা করতে সক্ষম হয়েছেন। যেভাবে এ ধরনের অ্যাথলেটের সংখ্যা বাড়ছে এবং এতো দেশের প্রতিযোগী এই সাফল্য অর্জন করছে যে তাদের কাছে এই বাধা এখন আর ততটা ভীতিকর মনে হয় না। এই মন্তব্য করেছেন চীনের বিংতিয়ান সু। ২০১৫ সালে তিনি ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ১০০ মিটার দৌড় শেষ করেছেন। তিনি এশীয় বংশোদ্ভূত প্রথম অ্যাথলেট যিনি এই বাধা অতিক্রম করেছেন। ‘আমার মনে হয় এই বাধা যতটা না শারীরিক তার চেয়েও বেশি মানসিক,’ ২০১৯ সালে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন।

পদকের আধিপত্য
যেসব অ্যাথলেট ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ১০০ মিটার দৌড়াতে পেরেছেন তারা যে এই বাধা অতিক্রম করতে আপনা আপনিই সফল হয়েছেন তা নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এখনো অনেক দেশ আছে, যেমন ভারত এবং দক্ষিণ আমেরিকার সকল দেশ, তাদের কোনো পুরুষ অ্যাথলেট ১০ সেকেন্ডের এবং নারী অ্যাথলেট ১১ সেকেন্ডের বাধা জয় করতে পারেনি। পদক জয়ের হিসাবের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও জ্যামাইকার নারী ও পুরুষ স্প্রিন্টাররা অলিম্পিকস ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে প্রাধান্য বিস্তার করেছেন। পুরুষদের ইভেন্টে এই দুটো দেশের বাইরে সবশেষ যে স্প্রিন্টার অলিম্পিকের স্বর্ণ পদক জয় করেছেন তিনি কানাডার ডোনোভান বেইলি, ১৯৯৬ সালে আটলান্টা গেমসে। নারীদের ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছেন বেলারুশের স্প্রিন্টার ইওলিয়া নেস্টিসিয়ারেঙ্কা ২০০৪ সালে এথেন্স গেমসে। কিন্তু এর আগের ৫টি অলিম্পিকসেই জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্টার এবং পরের ৩টি জিতেছেন জ্যামাইকান দৌড়বিদ। টোকিও গেমসে যে এই চিত্রটি পুরোপুরি বদলে যাবে সেই সম্ভাবনাও কম, যদিও উসাইন বোল্টের অবসর নেয়ার পর এই অলিম্পিকস অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status