বাংলারজমিন

চামড়া নিয়ে তেলেসমাতি

এবিএম আতিকুর রহমান, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) থেকে

২৭ জুলাই ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:০২ অপরাহ্ন

দেশের সর্ববৃহৎ চামড়া বাজার টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায় পাকুটিয়ায় অবস্থিত। বৃটিশ আমলেই গড়ে ওঠে এই বাজার। পূর্বে এই হাটের নাম ছিল পাকিস্তান হাট। একই নামে চিনতো সারা দেশের মানুষ। কিন্তু এবার নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, হাটে চামড়া কম ওঠা, ক্রেতা না আসা, উচ্চমূল্য দিয়ে হাট ডেকে এনে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা ইজারাদারদের গচ্চা যাওয়া, ট্যানারি মালিকদের নিষ্ঠুর প্রতারণাসহ নানা সমস্যার কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় দশ ভাগের এক ভাগ চামড়াও ওঠেনি এই হাটে। এ ছাড়া হাটের কোনো মালিকানা না থাকায় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নায়েবের তত্ত্বাবধানে সরকারি খাস কালেকশনের মাধ্যমে হাট পরিচালিত হচ্ছে।
সরজমিন গিয়ে হাটে আসা বেশ কয়েকজন ঋষি, ফড়িয়া, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ট্যানারির এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে চামড়া নিয়ে চালবাজির এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, কোর্ট টাই পরা ব্যক্তি ও সিন্ডিকেট চার ভাগে বিভক্ত হয়ে সরাসরি অল্প কিছু চামড়া ট্যানারিতে পৌঁছে দিচ্ছে। বাকি চামড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অতি সহজে পাচার করে দিচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ থেকে আসা মো. বাবুল আক্তার বাবলু নামে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, আমি ২০১৫ সালে ঢাকা এইড ট্যানারিতে বাকিতে মাল দিয়ে এখনও সে টাকা ফেরত পাইনি। অনুরূপভাবে আল মদিনা ট্যানারি, মিতালী ট্যানারি ও মুক্তা ট্যানারির কাছে প্রায় ১২ কোটি টাকা আমার এখনো পাওনা। আমার মতো অনেকইে আছেন যাদের ৫-১০ কোটি টাকা এই সব ট্যানারির কাছে পাওনা রয়েছে। সরকার এদের কোটি কোটি টাকা লোন দিলেও আমাদের পাওনা টাকা এখন পর্যন্ত ফেরত দেয়নি। কোম্পানির এজেন্টদের অভিযোগ লবণ, পরিবহন খরচ, শ্রমিক খরচ, হাটের খাজনা, গুদাম ভাড়াসহ সরকার চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সবকিছু মিলিয়ে তার থেকে অধিক মূল্য দিয়ে চামড়া কিনে বছরের পর বছর ট্যানারিতে ফেলে রাখতে হচ্ছে। বিক্রি করার মতো লোক পাচ্ছি না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি সপ্তাহের রোববার ও বুধবার চামড়ার হাট বসে এখানে। বগুড়া, সিরাজগঞ্জ কেরানীগঞ্জ, বৃহত্তর ঢাকা বিভাগ ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা থেকে ব্যবসায়ীরা চামড়া বেচা-কেনা করতে আসেন এই হাটে। হাটের আগের দিন রাতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চলে আসেন- ট্যানারি মালিক, মহাজন, ঋষি, ফড়িয়া থেকে শুরু করে ছোটখাটো মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে চামড়া বেচা-কেনা। স্থানীয় ৩ শতাধিক মানুষ সপ্তাহে ২ দিন শ্রম বিক্রি করে চালান তাদের সংসার। ঈদ এলেই তাদের ব্যস্ততা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়তি ইনকাম করে পরিবার-পরিজন নিয়ে সারা বছর ভালোভাবে চলতে পারবে এমন আশাতে বুক বেঁধে ঈদের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু এতিম, গরিব-দুঃখী মানুষের মতোই শ্রমজীবী মানুষগুলোর সেই আশা-দুরাশায় পরিণত হয়েছে।
অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে এবারের ঈদ তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছে। মানবসৃষ্ট এই অভিশাপ একদিকে যেমন এতিম, অসহায় গরিব-দুঃখী মানুষের পেটে লাথি দিয়েছে অপরদিকে শ্রমজীবী মানুষগুলোও পরিবার-পরিজন নিয়ে সারা বছর কীভাবে চলবে এমন ভাবনা ও দুশ্চিন্তায় তাদের মাঝে চরম হতাশা নেমে এসেছে। সারা দেশের ন্যায় টাঙ্গাইলেও এর প্রভাব পড়েছে। সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, ১ লাখ টাকা দিয়ে গরু ক্রয় করে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে ৬০ থেকে ১০০ টাকায়। ১ লাখ টাকার বেশি দামের গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে ১৫০-৩০০ টাকায়, ছাগলের চামড়া ১০ টাকায়। অনেকেই রাগে ও দুঃখে চামড়া বিক্রি না করে মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছেন।
খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাড়া, মহল্লা ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসব চামড়া নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করে ভ্যান, অটো, ছোট ছোট পিকআপ ও ট্রাকযোগে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কাঁচা চামড়া নিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন পাকুটিয়া চামড়া বাজারে। সেখানে এসে ঘটে বিপত্তি। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যখন বড় বড় চামড়া এক জায়গায় ট্যাক করে রেখে ক্রেতার অপেক্ষা করতে থাকেন তখন বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্ট, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও চামড়া সিন্ডিকেটের সঙ্গে যারা জড়িত তারা কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েন পানির দামে চামড়া ক্রয় করার জন্য। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখাচ্ছেন আর এসব সিন্ডিকেটের লোকেরা বিড়ালের মতো বেছে বেছে ১০-১২টি করে চামড়া ক্রয় করা শুরু করছেন। বড় বড় চামড়া ২৫০-৪৫০ টাকায় সর্বোচ্চ ক্রয় করছেন তারা। অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট চামড়া, কাফা, বাদ কাফা চামড়া কেনা বন্ধ করে দেন। এসব চামড়া নিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়ে যান। মাথায় হাত দিয়ে আর চোখের জলে গামছা ভিজিয়ে এসব চামড়া ফেলে দিয়ে রাতের অন্ধকারে বাধ্য হয়ে পালিয়ে যান। অনেকেই আবার ৫০-৬০ টাকা এসব চামড়া বিক্রি করে দেন। ছাগলের চামড়া পুরোটাই ফেলে দেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status