প্রথম পাতা

এম্বুলেন্সের কান্না

শুভ্র দেব

২৬ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৯:৩৬ অপরাহ্ন

ঢাকা মেডিকেলের চিত্র ছবি: মুজাহিদ সামিউল্লাহ

কঠোর লকডাউনে নীরব-নিথর সড়ক-মহাসড়ক। এরমধ্যে নীরবতা ভেঙে গ্রাম থেকে শহরের দিকে ছুটছে এম্বুলেন্স। এক একটি এম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে রোগী নিয়ে আসছে ঢাকার কোনো হাসপাতালে। এম্বুলেন্সে করে আসা রোগীদের বড় অংশ করোনা আক্রান্ত। সংকটাপন্ন বা গুরুতর রোগীরা জেলা বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে এসব রোগী আসছে ঢাকায়। রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর সামনে দিনভর আসে একের পর এক এম্বুলেন্স। আর ছাড়া পাওয়া রোগী বা মৃতদেহ নিয়ে বের হয়ে যায় কোনো গন্তব্যে। হাসপাতালের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় যেন কেঁদে চলছে এম্বুলেন্স।

রোববার দুপুর সাড়ে ১২টা। স্পট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের করোনা ইউনিটের প্রধান ফটক। একটু পর পর সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স আসছিল। দশ মিনিটের ভেতরে প্রায় ৮টি এম্বুলেন্স এসে সেখানে থামে। এই আটটি এম্বুলেন্সের প্রত্যেকটি ঢাকার বাইরের জেলা থেকে এসেছে। প্রতিটা এম্বুলেন্সের ভেতরেই মুমূর্ষু রোগী। অধিকাংশ রোগীর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। তাদেরকে এম্বুলেন্সের সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিলো। রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনদের মধ্যে হতাশার ছাপ। একটি এম্বুলেন্স থেকে রোগীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে টিকিট কাউন্টারে ছুটেন কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার তালতলা গ্রামের বাসিন্দা হিমেল হোসেন। টিকিট কেটে তড়িঘড়ি করে জরুরি বিভাগে গিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। কিছুক্ষণ পরে জরুরি বিভাগ থেকে বের হয়ে অন্য হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

যাবার সময় হিমেল মানবজমিনকে বলেন, আমার বাবা জোবায়ের হোসেন (৬৭)। পাঁচ বছর ধরে কিডনিজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। নতুন করে গত রোববার থেকে তার মাথাব্যথা, সঙ্গে জ্বর আসে। প্রাথমিক চিকিৎসায় জ্বর কমলেও শরীর ব্যথা কমেনি। সেই সঙ্গে তার নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। পরে তার নমুনা পরীক্ষা করালে নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। ঈদের পরদিন থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। অক্সিজেন লেভেল নিচের দিকে নামতে থাকে। পরে তাকে নিয়ে যাই কুমিল্লা সদর হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা দ্রুত ঢাকায় আনার পরামর্শ দেন। পরে তড়িঘড়ি করে বাবাকে সকালে প্রথমে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। বাবার শারীরিক অবস্থা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে সেখানকার চিকিৎসক জানান, রোগীর জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ লাগবে। আর মুগদা হাসপাতালে কোনো আইসিইউ খালি নাই। সাধারণ শয্যায় রেখে এই রোগীকে চিকিৎসা দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তাই অন্য হাসপাতালের আইসিইউতে রোগীকে স্থানান্তর করতে হবে। পরে সেখান থেকে বাবাকে আবার এম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসি ঢামেক হাসপাতালে। এখানে এসে দেখি কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নাই। এখন মহাখালী ডিএনসি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে নিয়ে যাবো। সরকারি হাসপাতাল ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য আমাদের নাই। যে এম্বুলেন্সে করে রোগী নিয়ে এসেছি সেটি দিয়েই হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছি। শুধুমাত্র এম্বুলেন্স ভাড়াই প্রায় ১৫ হাজার টাকা দিতে হবে।

করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে মিনিটে মিনিটে রোগী আসছেন। প্রায় সব রোগীকেই এম্বুলেন্সে করে ঢাকায় আনা হচ্ছে। এতে করে হাসপাতালে হাসপাতালে এম্বুলেন্সের জটলা বাঁধছে। শনি ও রোববার এই দুই দিনে ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিটে প্রায় পাঁচ শতাধিক এম্বুলেন্স করোনা রোগী নিয়ে আসা-যাওয়া করেছে। সাধারণ এম্বুলেন্সের পাশাপাশি আইসিইউ এম্বুলেন্সও ছিল। এম্বুলেন্সের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে নিরাপত্তাকর্মীদের। আর রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়েছেন চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা।

হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর থেকে করোনা আক্রান্ত দাদী সোহরবান বেগম (৭৮)কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন নাতি সোহেল হায়দার। করোনার নানান উপসর্গ নিয়ে সোহরবান বেগম এক সপ্তাহ ধরে ভুগছিলেন। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় চিকিৎসকরা তাকে ঢাকার করোনা হাসপাতালে আনার পরামর্শ দেন। সোহেল বলেন, এম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিলো না কোথাও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৯ হাজার টাকা দিয়ে এম্বুলেন্স ভাড়া করেছি।

গাজীপুরের শ্রীপুরের বাসিন্দা আছমা খাতুন (৬১)। তিন সন্তানের জননী এই নারীর কয়েকদিন ধরে পুরাতন শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। অক্সিজেন লেভেল বিপদসীমায় নেমেছে। ছেলে আলম মিয়া তাকে নিয়ে এসেছেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। আলম বলেন, আমার মায়ের অক্সিজেন লেভেল ৭০-এ। শনিবার রাত থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। গাজীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছে। ঢাকায় আনার জন্য আমাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি এম্বুলেন্স ভাড়া করতে হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার হামছাদী থেকে ৫৬ বছর বয়সী বাবা হিরণ মিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন হুমায়ুন মিয়া। কাপড়ের ব্যবসায়ী হিরণ সোনারগাঁও এলাকায় ফেরি করে পণ্য বিক্রি করতেন। গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট থাকায় নমুনা পরীক্ষা করালে তার পজেটিভ আসে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা বেশি হওয়াতে চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে আনা হয়। হিরণের ছেলে হুমায়ুন বলেন, সোনারগাঁও উপজেলার একেবারে শেষ গ্রামে আমরা থাকি। বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়েছেন। ভেবেছিলাম বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করাবো। কিন্তু অবস্থা খারাপ থাকায় হাসপাতালে আনতে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে বলা হয়েছে ঢাকায় আনলে ভালো হবে। তাই এম্বুলেন্সে করে নিয়ে এসেছি।

এদিকে এম্বুলেন্স নিয়ে রোগীর স্বজনদের অভিযোগও ছিল। বিপদের সুযোগ নিয়ে এম্বুলেন্স চালকরা কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের দাবি করা ভাড়াতেই চলাচল করতে হচ্ছে। অনেক সময় প্রয়োজনে কোথাও সময় নষ্ট করলে বাড়তি ভাড়া দিতে হয়। মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা এক রোগীর স্বজন শাওন বলেন, আমার ভাই অসুস্থ। জরুরি ভাবে ঢাকায় আনতে হবে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোনো এম্বুলেন্স পাচ্ছিলাম না। পরে ৮ হাজার টাকা দিয়ে একটি এম্বুলেন্স ভাড়া করে এসেছি। এখানে আসার পর রোগী নামাতে আধাঘণ্টা দেরি হয়েছে। সেজন্য আরও ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থেকে আসা আরেক রোগীর স্বজন বলেন, নন এসি একটি এম্বুলেন্সের ভাড়া সাত হাজার টাকা দিতে হয়েছে। রোগীর অবস্থা খারাপ। ঢাকায় আনতে হবে। তাই নিয়ে এসেছি।

এম্বুলেন্স চালকরা জানিয়েছেন, রোগীর চাপ বেশি। ঢাকার বাইরের জেলা শহরে এম্বুলেন্সের সংখ্যা কম। সেই তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে রোগী বেশি। একটা এম্বুলেন্স রোগী নিয়ে ঢাকায় গেলে রোগী হাসপাতালে নামিয়ে ফের জেলা শহরে আসতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। ইচ্ছা করলে একজন চালক দিনে অনেকগুলো ট্রিপ দিতে পারে না। তাই মালিকদের নির্দেশেই ভাড়া বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। মানিকগঞ্জ থেকে আসা এম্বুলেন্স চালক তবারক মিয়া বলেন, জেলা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার গিয়ে রোগী নিয়ে ঢাকায় এসেছি। যে গ্রাম থেকে রোগী এনেছি সেখানকার রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না। রোগী নিয়ে এসে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে হয়। ট্রলির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এরপর রোগী ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর আমাদের ভাড়া পরিশোধ করা হয়। এই লম্বা সময় আমাদের রোগীর সঙ্গে লেগে থাকতে হয়। কখনো কখনো এক রোগীর পেছনে পুরো দিন চলে যায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status