প্রথম পাতা

রিটার্নিং কর্মকর্তার মৃত্যু, চার কর্মকর্তা আক্রান্ত, তবুও নির্বাচন হচ্ছে সিলেটে

সিরাজুস সালেকিন, ঢাকা ও ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

২৬ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৯:৩৫ অপরাহ্ন

করোনায় রিটার্নিং কর্মকর্তার মৃত্যু। দুই সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ চার নির্বাচন কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত। একের পর এক নির্বাচন কর্মকর্তার দায়িত্ব বদল। পুরো জেলায় ঊর্ধ্বমুখী করোনা শনাক্ত ও মৃত্যু হার। তবুও অনড় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এত কিছুর পরও পেছাচ্ছে না সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে আগামী ২৮শে জুলাইয়ে নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করতে যাচ্ছে ইসি। ইতিমধ্যে ভোটগ্রহণের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বৈঠকসহ আনুষঙ্গিক সকল কার্যক্রম শেষ হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে ওই এলাকাকে লকডাউনের আওতাবহির্ভূত ঘোষণা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে দপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও নির্বাচন বন্ধ করেনি ইসি। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তারা নির্বাচন করতে বাধ্য। গতকাল সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক দেবনাথ মানবজমিনকে বলেন, ২৮শে জুলাই সিলেট-৩ আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন পেছানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। লিগ্যাল নোটিশের কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই বলেও মনে করেন তিনি।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, গত ৩রা জুন সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এই নির্বাচনের প্রথম রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেন রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকালেই তিনি করোনা আক্রান্ত হন। এরপর ৩রা জুলাই রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়া হয় সিলেটের জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলামকে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ইসরাইল হোসেনকে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর গতকাল বিকাল ৩টার দিকে তিনি মারা যান। ইসরাইল হোসেন দায়িত্ব পালনকালে মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই ও প্রতীক বরাদ্দে অংশ নেন। ইসরাইল হোসেন ছাড়াও ওই সময় করোনা আক্রান্ত হন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা সিলেটের সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ফয়সাল কাদের, অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা শুক্কুর মাহমুদ, জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবুল হাসনাত ও বালাগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সোহরাব হোসেনসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এক সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দ্বিতীয় দফায় পরিবর্তন করা হয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) স্থলে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ফেঞ্চুগঞ্জের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হয়। ইউএনও রাখি আহমেদ করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তার স্থলে দায়িত্ব পালন করবেন এহসানুল কবীর ফেরদৌস। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগে করোনায় মৃত্যু, আক্রান্ত ও সুস্থতার তিন সূচকই ছিল ঊর্ধ্বমুখী। গতকাল সকাল ৮টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগে করোনায় মারা গেছেন ১০ জন। যাদের ৬ জনই সিলেট জেলার বাসিন্দা। একই সময়ে নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে আরও ৪৪০ জনের শরীরে। সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভোটগ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নির্বাচনে দায়িত্ব পালন নিয়ে তারা দোটানায় পড়েছেন। চাকরি হারাতে হতে পারে এমন আশঙ্কায় তারা দায়িত্ব পালনে বাধ্য হচ্ছেন। এরআগে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা এড়ানোর সুযোগ আছে কিনা, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এ বিষয়ে কমিশনকে নিরুৎসাহ করা হয়। এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে ভোটারদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। মানুষের জীবনরক্ষার খাতিরে নির্বাচন কমিশনের উচিত এই নির্বাচন স্থগিত করা। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলে তারও সমাধান রয়েছে। কমিশন চাইলে প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করে আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করতে পারে। নির্বাচনের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবন।

এদিকে সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচন স্থগিতের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদাকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী। গতকাল রেজিস্ট্রি ডাকযোগে তাদের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির এ নোটিশ পাঠিয়েছেন। আগামী ২৮শে জুলাই এ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। নোটিশে বলা হয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে চলমান লকডাউনেও নির্বাচন স্থগিত রাখা সম্ভব নয়। ভোটগ্রহণ স্থগিত করা না হলে উচ্চ আদালতে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে নোটিশে বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অপর ৫ আইনজীবী এডভোকেট মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম, আল-রেজা মো. আমির, মো. জোবায়দুর রহমান, মো. জহিরুল ইসলাম এবং মুস্তাফিজুর রহমানের পক্ষে তিনি এই নোটিশ দিয়েছেন। এতে বলা হয়, সংবিধানের ১২৩ এর দফা ৪ শর্তানুসারে সিলেট উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত। তাই ২৮শে জুলাই অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন স্থগিত করা যাবে না এই বক্তব্য আইনের সঠিক ব্যাখ্যা নয়। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের উচিত চলমান করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে লকডাউনের সময়ে নির্বাচন না করা এবং ৭ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্য যেকোনো দিন ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ করা। ৩ লাখ ৫২ হাজার ভোটারের এই নির্বাচন অনুষ্ঠান সরকারের বর্তমান লকডাউন নীতিরও বিরোধী। সুতরাং ২৮শে জুলাই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। নোটিশে বলা হয়েছে, দৈবদুর্বিপাকের কারণে সংবিধান অনুযায়ী ৭ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার সুযোগ রয়েছে। অথচ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলছেন, নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। সিইসির এই বক্তব্য সঠিক নয়। নোটিশে আরও বলা হয়, যে কারণে ৮ই জুনের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি, সেই কারণ এখনো দেশে বিদ্যমান। দেশে করোনাভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ চলছে। তাই নির্বাচনে ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা হোক। অন্যথায় উচ্চ আদালতে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

গত শনিবার সিলেটে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা জানিয়েছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার ফলে সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই। আগামী ২৮শে জুলাই অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া উপনির্বাচন স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠিত হবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সবাইকে মাস্ক পরে ও নিরাপদ দূরত্ব মেনে ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানান সিইসি। নির্বাচন না পেছানোর যুক্তি দিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, দৈবদুর্বিপাকের কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অতিরিক্ত যে ৯০ দিন সময় নিতে পেরেছেন তা আগামী ৩রা সেপ্টেম্বর শেষ হচ্ছে। আর আগস্ট শোকের মাস। আগস্ট মাসে নির্বাচন না করার রেওয়াজটি আমরা ভাঙতে চাই না। এসব কারণে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আর নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই।

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা এবং বালাগঞ্জ উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত সিলেট-৩ আসন। প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার ভোটার রয়েছেন আসনটিতে। এ আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১১ই মার্চ মারা যান। ১৫ই মার্চ আসনটি শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নিয়মানুযায়ী মধ্য জুনের মধ্যে এ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও করোনাজনিত পরিস্থিতিতে ইসি আরও তিন মাস সময় বাড়ায়। পরে ইসি এ আসনে ১৪ই জুলাই ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবারো পিছিয়ে ২৮শে জুলাই ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে। এ লক্ষ্যে গত ১৫ই জুন পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে গত ২৫শে জুন চারজন প্রার্থীর মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয় ইসি। তফসিল অনুযায়ী ২৬শে জুলাই রাত ১২টায় প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হবে।

ইসির শোক
সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেনের মৃত্যুতে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গভীর শোক প্রকাশ করেছে। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস রিলিজে মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। ইসরাইল হোসেন ১৯৯৬ সালে সহকারী সচিব হিসেবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যোগদান করেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বিভিন্ন শাখা/অধিশাখায় দায়িত্বপালনসহ রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসরাইল হোসেন ১৯৬৬ সালে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এদিকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো. এনামুল হক করোনাভাইরাসে মারা গেছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এ নির্বাচনকর্মী। ৪৪ বছর বয়সী এনামুল স্ত্রী ও ১ ছেলে রেখে গেছেন। ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status