প্রথম পাতা

চিকিৎসকরা ক্লান্ত, স্বজনদের আহাজারি

সিট নেই, অক্সিজেন নেই

শুভ্র দেব

২৫ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৯:৪৬ অপরাহ্ন

শাহিদা আক্তার। বয়স তেঁতাল্লিশ বছর। শরীর ব্যথা, জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই। করোনার উপসর্গ থাকায় স্বজনরা তাকে নরসিংদীতে নিয়ে করোনা পরীক্ষা করান। দু’দিন পর তার করোনা পজেটিভ রেজাল্ট আসে। এরমধ্যে শাহিদার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। তড়িঘড়ি করে তাকে নেয়া হয় নরসিংদী সদর হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে গতকাল শনিবার সকালে পাঠানো হয় ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড মুগদা হাসপাতালে। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে নেয়ার পর সেখানকার
চিকিৎসকরা অক্সিজেন ও শয্যা সংকট দেখিয়ে শাহিদাকে ভর্তি নেননি বলে অভিযোগ করেন তার স্বামী আবু তালেব। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমার স্ত্রীকে নরসিংদী থেকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা ভর্তি নিচ্ছে না। রোগীর খারাপ অবস্থা কিন্তু বলছে এখানে অক্সিজেন ও শয্যা নেই। তাকে মহাখালী ডিএনসি কোভিড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলছেন।
শুধু শাহিদা আক্তার নন। জিঞ্জিরা থেকে ৬২ বছর বয়সী মতি বেগমকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে বিপাকে পড়েন আবেশকার বেগম। তার শাশুড়ি ১০ দিন ধরে অসুস্থ। নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। ঢামেক হাসপাতালে আনার পর অক্সিজেন ও শয্যা সংকট দেখিয়ে ভর্তি নেয়নি হাসপাতাল। তাকে মহাখালী ডিএনসি কোভিড হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গতকাল ঢাকা মেডিকেল ও মুগদা মেডিকেলে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা গেছে কিছুক্ষণ পর পর রোগী আসছেন। তাদের অনেকেই ভর্তি হতে পারছেন না। কারণ তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন। হাই ফ্লো অক্সিজেন বা আইসিইউ প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে এই দুই হাসপাতালে এমন শয্যা খালি নেই। তাই রোগীদের অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এদিকে বাড়তি রোগীর চাপে ক্লান্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রতিদিনই ঢাকার বাইরের জেলা থেকে আক্রান্তরা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এসে ভিড় করছেন। এতে করে ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। মিলছে না কোনো আইসিইউ। এছাড়া নতুন করে দেখা দিয়েছে অক্সিজেন সংকট। বড় হাসপাতালগুলোতেও অক্সিজেন ও শয্যা সংকট দেখিয়ে রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে না। দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীরা ভর্তির জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গতকাল ঢাকার বড় করোনা হাসপাতালের ৭টিতেই কোনো আইসিইউ শয্যা খালি ছিল না। এছাড়া সরকারি হিসাবে আরও কিছু হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি দেখালেও বাস্তবে সাধারণ রোগীরা কোনো আইসিইউ শয্যা পাচ্ছেন না। একইভাবে সাধারণ শয্যারও একই অবস্থা।
গতকাল সারাদিন ঢাকার বড় ৪টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে ভয়ঙ্কর চিত্র। এসব হাসপাতালে প্রায় মিনিটে সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স আসছে। বেশিরভাগ রোগীরা ঢাকার আশেপাশের জেলা থেকে আসছেন। আবার দূরের জেলা থেকেও অনেকে আসছেন। দূর থেকে অনেক আশা নিয়ে জটিল রোগীদের ঢাকায় নিয়ে এসে অনেকে বিপাকে পড়ছেন। অনেক হাসপাতালের লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসা রোগীরা গাড়ি থেকে রোগীদের নামানোর সুযোগও পাচ্ছেন না। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কথা বলেই চলে যেতে হচ্ছে। এতে করে রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরছেন। জটিল রোগীদের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেক জটিল রোগী চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছামাত্রই মারা যাচ্ছেন। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীর চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। রোগী সামাল দেয়ার অবস্থা নেই। অনেক হাসপাতালে সক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি নেয়া হয়েছে। তবুও রোগী আসছে। এখন ভরসা শুধু কোনো রোগী যদি ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে।
সিরাজগঞ্জ থেকে করোনা পজেটিভ বাবা মুজিবুল হককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন রুকনুজ্জামান মিয়া। বাবা পুরণো ডায়াবেটিসের রোগী। কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে জ্বর ভালো হচ্ছিল না। তাই করোনা পরীক্ষা করালে পজেটিভ রেজাল্ট আসে। গত দুদিন ধরে শ্বাসকষ্টসহ শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। তাই গতকাল শনিবার তাকে ভর্তি করার জন্য সিরাজগঞ্জ থেকে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে আনা হয়। কিন্তু শয্যা সংকট থাকায় বাবাকে ভর্তি করাতে পারেননি রুকনুজ্জামান। তিনি বলেন, ঢামেক করোনা ইউনিটে শয্যা ফাঁকা নেই। এছাড়া অক্সিজেনের সংকট রয়েছে। হাসপাতালের লোকজন বলছেন, অপেক্ষা করতে হবে। কোনো রোগী ছাড়পত্র নিয়ে গেলে ভর্তি করা যাবে। না হলে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বাবার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। তাই এখানে অপেক্ষা করার মতো সময় নেই।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা শাহানা খাতুন দুদিন আগে করোনা পজেটিভ হয়েছেন। শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছিল। অক্সিজেন লেভেল বিপদসীমায় নেমেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দ্রুত আইসিইউতে নিতে হবে। না হলে রোগী বাঁচানো কঠিন হবে। তাই আইসিইউর সন্ধানে শাহানা খাতুনের স্বজনরা তাকে প্রথমে করোনা ডেডিকেটেড মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় তাকে নিয়ে আসেন ঢামেক হাসপাতালে। এই হাসপাতালেও একই অবস্থা। কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। শাহানার ভাগ্নে আবু মোতালেব বলেন, সাধারণ শয্যায় রেখে খালাকে চিকিৎসা করানো যাবে না। শ্বাসকষ্ট বেশি তাই আইসিইউতে নিতে হবে। দুটি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কোথাও আইসিইউ খালি নেই বলে আমাদেরকে জানানো হয়েছে।
মিরপুরের বাসিন্দা ৭৮ বছর বয়সী মোশারফ হোসাইনের প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। চার দিন ধরে তিনি করোনা পজেটিভ। প্রথম দিকে শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলেও শুক্রবার রাত থেকে অবস্থা জটিল হতে থাকে। স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে মোশারফকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে নিয়ে আইসিউতে ভর্তি করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। পরে শনিবার সকালে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন ছেলে কাজী হোসাইন। হাসপাতালটিতে এসে কোনো লাভ হয়নি। এই হাসপাতালের সাধারণ শয্যা থেকে শুরু করে আইসিইউ’র সব ক’টি শয্যা রোগীতে পূর্ণ। মোশারফের ছেলে কাজী হোসাইন কুর্মিটোলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরতদের অনেক কাকুতি-মিনতি করেছেন একটি আইসিইউ শয্যার জন্য। অনেকটা হতাশ হয়ে তিনি বাবাকে নিয়ে যান মহাখালী ডিএনসি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে।
নরসিংদীর রায়পুরা থেকে হায়দার আলীকে (৫৫) ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন ছেলে আহমদ আলী। তিনদিন ধরে জ্বর ও ঠাণ্ডা-কাশিতে ভুগছিলেন হায়দার। এমন অবস্থায়ই তার শ্বাসকষ্টও শুরু হয়েছে। নরসিংদীর স্থানীয় দুটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে অক্সিজেনের অভাব রয়েছে বলে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় এসে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে শুরু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে কোথাও আইসিইউ শয্যা পাননি।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাধারণ শয্যা রয়েছে ৩৫০টি ও আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২৪টি। সবমিলিয়ে ৩৭৪টি শয্যার একটিও ফাঁকা নেই। কেবলমাত্র ভর্তি রোগী সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র অথবা কোনো রোগী মারা গেলে শয্যা ফাঁকা হলে সেখানে ভর্তি নেয়া হচ্ছে। করোনা ডেডিকেটেড কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রোগী ভর্তি করার সক্ষমতা ৩০০ হলেও বর্তমানে হাসপাতালটিতে ৪৩ জন রোগী বেশি ভর্তি আছেন। হাসপাতালটিতে সাধারণ শয্যা রয়েছে ২৭৫টি। আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১০টি। বাকিগুলো এইচডিইউ শয্যা। হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ৪৩৯টি, হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংখ্যা ৫৭টি ও অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর রয়েছে ৩৯টি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবন ও পুরাতন বার্ন ইউনিট ভবন মিলিয়ে মোট শয্যা রয়েছে ৭০৫টি। এসব শয্যায় রোগী ভর্তি আছেন ৭২৪। সক্ষমতার বাইরে বাড়তি ১৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। ২০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে একটিও খালি নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, এই মুহূর্তে দিনে ২০০ টনের মতো অক্সিজেনের চাহিদা রয়েছে হাসপাতালগুলোতে। চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন যেসব রোগী আসছেন তাদের জন্য বাড়তি অক্সিজেন লাগছে। সামনে রোগী বাড়লে এই চাহিদা আরও বেড়ে যাবে। তখন সংকট দেখা দেবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status