প্রথম পাতা

মহামারির ঈদে ৩০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য

এম এম মাসুদ

২৫ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৯:৩৮ অপরাহ্ন

দেশে প্রতি বছর ঈদ উৎসব ঘিরে বাড়ছে বাণিজ্য। উৎসবকেন্দ্রিক বাণিজ্যের মধ্যে দুই ঈদেই সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়। কিন্তু এবার না বেড়ে উল্টো কমছে। এজন্য করোনা মহামারিকেই দায়ী করছেন উদ্যোক্তারা। তারপরেও এবার ঈদুল আজহায় ভোক্তা পর্যায়ে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বছর হয়েছিল প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। তার আগের বছর লেনদেন হয়েছিল ৪৫ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় কোরবানির পশু কেনাবেচায়। এর পরে রয়েছে মসলার বাণিজ্য। ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের যাতায়াতে পরিবহন খাতে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়েছে। এ ছাড়া ফ্রিজ, পোশাক, ফার্নিচার, গাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন পণ্য কেনাবেচা হয়েছে। তবে ঈদে পর্যটন ঘিরে যে বেশ বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়; সেটা এবার হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে মানুষের কাছে অর্থের সংকট থাকায় অনেকেই এবার কোরবানি দেননি। আবার যারা আগে একাই কোরবানি দিতেন, এবার তারা ভাগে দিয়েছেন। এ জন্য গরুর চাহিদা কম ছিল। শুরুর দিকে যেসব ব্যবসায়ী অল্প দামে গরু ছেড়ে দিয়েছেন, তারা লোকসান করেননি। যারা বেশি দামের আশায় গরু রেখে দিয়েছিলেন, তাদেরই লোকসান গুনতে হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম পশু কোরবানি হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে ২০১৬ সালের পর এবারের ঈদুল আজহায় সারা দেশে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। যার মধ্যে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ, ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৭১৫টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। চলতি বছর দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৭ হাজার। ফলে অবিক্রীত থেকে গেছে ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৮টি পশু।
২০১৬ সালে কোরবানির পশুর সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ওই বছর ১ কোটি ৫ লাখ পশু কোরবানি হয়। ২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ ও ২০১৮ সালে ১ কোটি ৫ লাখ পশু কোরবানি হয়। ২০১৯ সালে কোরবানি হয় ১ কোটি ৬ লাখ পশু। ২০২০ সালে করোনাকালে কোরবানির সংখ্যা কমে যায়। ওই বছর ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পশু কোরবানি হয়। সেই হিসাবে এবার গতবারের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কম কোরবানি হয়েছে।
মাংস ব্যবসায়ী এবং চামড়া খাতের বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, এবার ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে। প্রতিটি গরু, মহিষ ও উটের গড় দর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে হলে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৭১৫টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। ছাগল, ভেড়ার গড় দর ১০ হাজার টাকা হলে এসব পশু কেনাবেচা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার মতো। সব মিলিয়ে অন্য খাতসহ এবার প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
চামড়া ব্যবসায়ী সংগঠন হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের হিসাবমতে, ২০১৭ সালে এক কোটি ৫ লাখ কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারিগুলো। পরের বছর একই পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করে তারা। কিন্তু গত বছর করোনার কারণে কোরবানি কমেছে। প্রতি বছর কোরবানির পশুর সংখ্যা ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে বাড়ে। কিন্তু এবার ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবার ৯১ লাখ চামড়া সংগ্রহ করতে পারবে ট্যানারিগুলো।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, এবার ঈদে পশুর ও পশুর চামড়ার লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো হতে পারে। ঈদুল আজহার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য হয় পশু ও চামড়া কেনাবেচায়। ট্যানারি মালিকরা অপেক্ষায় থাকেন ভালো মানের চামড়া কিনতে। ঈদে কোরবানি হওয়া পশুর চামড়া বেশির ভাগই রপ্তানি হয়। তিনি বলেন, বছরে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত হয় ট্যানারিগুলোতে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ চামড়া আসে ঈদুল আজহায়। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হবে।
ঈদে রান্নাসামগ্রী ভোজ্য তেল ও মসলাসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি হয় প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির ঈদে ভোজ্য তেলের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। প্রায় হাজার কোটি টাকার ভোজ্য তেল কেনাবেচা বেশি হয়। ঈদে বাড়তি পিয়াজের প্রয়োজন হয়। পিয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া গরম মসলা এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরাসহ অন্যান্য মসলা বিক্রি হয়েছে অন্তত ১০০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি মসলা কেনাবেচা হয়।
পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী হাজী এনায়েত উল্লাহ বলেন, ঈদ বাজারে মসলার ১০ শতাংশ বাড়তি কেনাবেচা হয়েছে। তবে পুরান ঢাকার পাইকারি বাজারে কেনাবেচা তেমন বাড়েনি।
এদিকে ঈদ বিনোদন ঘিরে জমজমাট হয়ে উঠে পর্যটন বাণিজ্য। কিন্তু এবার সেটা হয়ে উঠেনি। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষসহ পর্যটনের আকর্ষণীয় কেন্দ্র ঘিরে গড়ে ওঠা হোটেল-মোটেলগুলো লোকসানে পড়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ঈদে পরিবহন ভাড়ায় লেনদেন হয় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার।
এদিকে ঈদুল আজহা এলেই বেড়ে যায় ফ্রিজের চাহিদা। এ সময় নানা অফারে কেনাবেচা হয় ফ্রিজ, ফার্নিচার, গাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ নানা পণ্যের। এবার ঈদে এর পরিমাণও আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, উৎসবকেন্দ্রিক বাজার বড় হচ্ছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। এখন ঈদবাজার শুধু কাপড় ও জুতা কেনাকাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফার্নিচার, গাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যয় বাড়ছে। তাছাড়া আগে বেশির ভাগ মানুষ ভাগে কোরবানি দিলেও এখন এককভাবেই দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status