শেষের পাতা

হাবিবার পরিবারে শুধুই কান্না

মিজানুর রহমান, সিলেট থেকে ফিরে

২৫ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৯:৩৩ অপরাহ্ন

বড় ভাইয়ের লাশ দেখা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন হাবিবা আক্তার শিল্পি ও তার পরিবার। কিন্তু ভাই তো ভাই-ই। শেষ পর্যন্ত সব শঙ্কা-ভয় দূরে ঠেলে যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যনির্দেশনা মেনে করোনায় মারা যাওয়া বড় ভাইকে শেষ বিদায় জানান। কিন্তু আট মাসের ব্যবধানে আজ হাবিবাকেই কেড়ে নিলো প্রাণঘাতী মহামারি। ২০শে জুলাই সন্ধ্যায় সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। অবশ্য ১০ দিন আগে আইসিইউতে হাবিবা যখন শ্বাসযন্ত্রণায় নিদারুণ কষ্টে সেই সময়ে দুনিয়া ছেড়ে যান তার অতি আদরের ছোট ভাই। মৃত্যুর আগে বোনকে দেখার আকুতি ছিল ভাইয়ের। কিন্তু মরণব্যাধি কোভিড-১৯ তাদের দু’জনের মাঝে দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে ফেলে। ভাই-বোনের সাক্ষাৎ অধরাই থেকে যায়! বলছি করোনায় পরপর তিন সদস্যকে হারানো সিলেটের একটি পরিবারের কথা। যে পরিবারের প্রতিটি মানুষ আপন আলোয় উজ্জ্বল। করোনায় মারা যাওয়া ওই পরিবারের প্রথম ব্যক্তি 'বড় ভাই' মোজতবা রোম্মান চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েন ডিরেক্টর। বহু সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তার ছোট ভাই তানভীর আহমেদ চৌধুরী। সিলেটের লালদীঘিরপাড়ের প্রতিষ্ঠিত তরুণ ব্যবসায়ী। গত ৯ই জুলাই করোনায় মারা যান তিনিও। ৫ ভাই ৩ বোনের সংসার হাবিবার। তাদের পৈত্রিক নিবাস হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার তেঘারিয়া মুনসেফ বাড়ি। বাবা মরহুম আবদুল হাই। মা মরহুম ফজিলাতুন্নেছা খানম। স্ব-স্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত ওই পরিবারের অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা সামাজিক মর্যাদা- কোনো কিছুরই কমতি ছিল না। অন্তত বাণিজ্যিক এই পৃথিবীতে চিকিৎসা আদায় করে নেয়ার মতো যোগ্যতা, কানেকশন বা অবস্থান ছিল তাদের। কিন্তু ভয়াল করোনার কাছে আজ তারা পরাস্ত-পরাজিত! কোনো প্রচেষ্টাই তাদের সুরক্ষা দিতে পারেনি। আস্তিক ওই পরিবার অবশ্য আগাগোড়ায় এটাকে নিয়তি বা স্রষ্টার সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিয়েছেন। চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা, ত্রুটি কিংবা অন্য কোনো অভিযোগ নেই তাদের। সিলেট এমসি কলেজের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবা আক্তার। প্রভাষক হিসাবে (ষোড়শ বিসিএস) ১৯৯৬ সালে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে কর্মজীবন শুরু করলেও কয়েক মাসের মধ্যেই বদলী হয়ে আসেন 'স্বপ্নের' এমসি কলেজে। হাবিবার শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে এমসি কলেজে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ওই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে  অনার্স পাস করেন তিনি। এ কারণে শিক্ষক হিসাবে এমসি কলেজে ফেরার ব্যাকুলতা ছিল তার। অবশ্য তিনি সফল হন।পেশাগত পরিচয়ের সুবাদে এমসি  কলেজের এক শিক্ষকের সঙ্গে পরিণয়-সংসার। ক্যারিয়ারের প্রতিটি ধাপ সফলতার সঙ্গে পার করলেও বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে তার এমসি কলেজে। দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেছেন কলেজের একমাত্র ছাত্রী হলের সুপার হিসেবে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিভাগীয় শহরে আসা হাজারো মেয়ে, যাদের সিলেট শহরে কোনো অভিভাবক ছিল না, হাবিবা ছিলেন তাদের আশ্রয়। মাতৃস্নেহে তিনি অনেক ছাত্রীর শিক্ষাজীবন নির্বিঘ্ন করতে সহায়তা করেছেন। অবশ্য এ কাজে তার জীবনসঙ্গী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান  চেয়ারম্যান প্রফেসর ফরিদ আহমেদ সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন। হাবিবা হোস্টেল সুপার থাকাকালীন ক্যাম্পাসই ছিল ফরিদ-হাবিবা দম্পতির আবাস। তাদের একমাত্র কন্যা সালমা আক্তার সামার শৈশব কেটেছে চারতলা মহিলা হোস্টেল কম্পাউন্ডে। সামা এখন পড়ছেন গাজীপুর তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজে, এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষে। মেডিকেল পড়ুয়া মেয়ে এখনো সুস্থ থাকলেও প্রিয়তমার মৃত্যু আর নিজের করোনা পজেটিভ হওয়ার রিপোর্ট কাবু করে ফেলেছে প্রফেসর ফরিদ আহমেদকে। তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শ্যালক-সম্বন্ধীর মৃত্যুও তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যদিও সহধর্মিনী হাবিবার মৃত্যুর দু'দিন পর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। শ্বাসকষ্ট বা অন্য শারীরিক জটিলতা না থাকায় তিনি মোটামুটি শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status