প্রথম পাতা

সরজমিন খুমেক হাসপাতাল

‘বহু চেষ্টা করেছি বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না’

জীবন আহমেদ, খুলনা থেকে

২৪ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৯:১২ অপরাহ্ন

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর লড়াই ছবি: জীবন আহমেদ

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে আহাজারি করছেন নড়াইলের নয়ন কুমার কুণ্ডু। একটু আগেই মারা গেছেন তার বাবা। মরদেহ নিয়ে যাওয়ার আগে ফোনে বিলাপ করছিলেন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে। ৩টি হাসপাতাল ঘুরেও বাবাকে বাঁচাতে না পারায় বারবার কষ্টের কথা জানাচ্ছিলেন তিনি। শুক্রবার সকাল ৯টার ঘটনা এটি।

মানবজমিনকে তিনি বলেন, বাবার হার্ট ও মস্তিষ্কে সমস্যা ছিল। ঈদের ছুটির জন্য নড়াইল হাসপাতালে ভালো ডাক্তার পাইনি। পরে যশোর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাখা হয় করোনা ওয়ার্ডে। সেখানেও ভালো কোনো চিকিৎসা পাইনি। পরে গতকাল সকালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে কয়েক ঘণ্টার পর বাবা মারা গেছেন। তার কোনো করোনা কিংবা উপসর্গ ছিল না। হার্টে সমস্যার কারণে তাকে ২৪ ঘণ্টাই অক্সিজেন দিয়ে রাখা হতো। ১৫-১৬টা সিলিন্ডার শেষ হয়েছে। আমি আমার বাবার জন্য বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তুপারলাম না বাবাকে বাঁচাতে।

গত ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে করোনার নতুন ‘হটস্পট’ খুলনা। সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যা। মৃত্যুর সংখ্যাও অস্বাভাবিক। বেড়েছে আইসিইউ শয্যার চাহিদা। চাহিদার তুলনায় আইসিইউ বেডের সংখ্যা সীমিত থাকায় করোনা রোগীদের অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন আইসিইউ সেবা থেকে। এতে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। কেউ বা আইসিইউ না পেয়ে ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। ঈদের দিন বুধবার ও পরদিন বৃহস্পতিবার খুলনা এ হাসপাতালে রোগীর চাপ কম থাকলেও গতকাল সকাল থেকেই চাপ বেড়েছে। প্রতি ঘণ্টায় আসছে রোগী। গতকাল সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অন্তত ২৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তির জন্য আসেন। যারা সবাই করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হতে চান। তাদের অনেকেরই রয়েছে শ্বাসকষ্ট। বেশ ক’জন রোগীর স্বজনকে আইসিইউ’র জন্য আহাজারি করতে দেখা গেছে। তবে আইসিইউ বেড খালি না থাকায় সাধারণ বেডেই ভর্তি হতে হয়েছে তাদের।

এদিকে হাসপাতালটিতে করোনা চিকিৎসার জন্য মোট শয্যা রয়েছে ২০০টি। এর মধ্যে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ২০টি। গত কয়েকদিন ধরে কোনো বেড খালি থাকছে না। এতে অপেক্ষায় থাকছেন সংকটাপন্ন বহু রোগী। একজন মারা যাওয়ার খবর এলেই আইসিইউর জন্য সিরিয়াল পড়ে তাদের। তালিকাও হয় দীর্ঘ। এতে অনেকেই আইসিইউর সেবা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাইরে সরজমিনে দেখা গেছে, দু’দিনেই বদলে গেছে দৃশ্যপট। যেখানে ঈদের দিন ও তার পরদিন কোনো কোলাহল ছিল না, ভিড় ছিল না। শুক্রবার ভোর থেকে এম্বুলেন্সের লাইন পড়ে গেছে। চলছে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে দর কষাকষি। হাসপাতালে ভর্তি কয়েকজন রোগীর স্বজন মানবজমিনকে জানান, হাসপাতালে অনেক ডাক্তার ঈদের ছুটিতে গেছেন। এই সময়ে হাসপাতালেও তেমন একটা রোগীর চাপ ছিল না। করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ বেড খালি থাকলেও আইসিইউর চাহিদা সব সময় বেশি ছিল। ঈদের পরদিন ভোর থেকেই হাসপাতালে রোগীদের চাপ বাড়তে থাকে। বেশিরভাগ রোগী শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাহিদার তুলনায় এখনো অক্সিজেন কম পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কিছু সিলিন্ডারে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক কম থাকে। স্টাফরা অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগানোর কয়েক মিনিট পরও অক্সিজেনের সাপোর্ট পাওয়া যায় না। এতে রোগী ও স্বজনদের মধ্যে ভয় কাজ করছে।
জুয়েল মোল্লা নামের একজন বলেন, ৬-৭ দিন ধরে খুলনা মেডিকেলে আমার খালা ভর্তি আছেন। আগে অক্সিজেনর সমস্যা থাকলেও এখন তা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। সেবার মান কিছুটা ভালো হয়েছে। তবে হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। এই সংকটময় মুহূর্তে অনেক রোগীর আইসিইউর সেবা প্রয়োজন হয়। এটা বাড়ানো হলে হয়তো মৃত্যুর সংখ্য অনেক কমতো।
করোনার উপসর্গ নিয়ে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি হন যাত্রাপুরের আমির আলী শেখ। সেখানে করোনা শনাক্ত হলে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। প্রয়োজন হয় আইসিইউ’র। নেয়া হয় খুলনায় কিওর হোমে। সেখানেও আইসিইউ না পেয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন স্বজনরা। সেখানে জানতে পারেন, আইসিইউ’র কোনো বেড খালি নেই। অনেক কাকুতি-মিনতি করেও মেলেনি আইসিইউ সেবা। পরে সাধারণ বেডেই ভর্তি নেন ডাক্তাররা।

মোখলেসুর রহমান। বয়স ৭৫। খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অবস্থা খারাপ হওয়ায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনরা। সদর হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় তারা এখানে নিয়ে এসেছেন আইসিইউ’র জন্য।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরএমও ও করোনা হাসপাতালের ফোকালপার্সন ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার মানবজমিনকে বলেন,  হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ বেড়েছে। অনেকেই স্বাসকষ্ট নিয়ে আসছেন। আইসিইউ বেডের চাহিদাও বেড়েছে। তবে আমাদের এখানে ২০টি আইসিইউ আছে। কোন বেড খালি নেই। আমাদের অনেক ডাক্তার ছুটিতে আছেন। অনেকে এই ঈদের সময়ও করোনা রোগীদের সেবা করে যাচ্ছেন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status