সেরা চিঠি

বাবার কফিনের স্মৃতি

২৩ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ৪:২৩ অপরাহ্ন

প্রিয় শীলা আহমেদ,

অন্তরাত্মার অন্তস্থল থেকে  আপনাকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। 

আপনি দেশ বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কন্যা - এই পরিচয়ে আপনাকে চিঠি লেখার কোন প্রয়োজন আমার ছিল না।
হুমায়ূন আহমেদের নবম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে আপনার একটি সাক্ষাৎকার পুনঃপ্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে বাবার স্মৃতি সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার বক্তব্য পড়ে আমার হৃদয়ে প্রচন্ড দাগ কেটেছে। আপনার ভয়াবহ মর্মপীড়া এবং মর্মস্পর্শী আবেদন আমাকে দারুন ভাবে আহত করেছে, একই সাথে ভিতরের সত্য ও ন্যায়ের শক্তিকে জাগ্রত করেছে। ফলে আমার 'আত্মা' এবং 'হৃদয়ের' তাগিদে আপনাকে এ চিঠি লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছি।

আপনি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন "বাবার মুখ আমার বেশি মনে পড়ে না, মনে পড়ে তাঁর কফিনটা। বাবা মারা যাওয়ার পর বিমান থেকে তাঁর কফিনটা নামানো হচ্ছিল। সেই দৃশ্যটা বারবার মনে পড়ে।"

এইটুকু কথা পড়ে আমার বারবার মনে হয়েছিল আপনার ভাগ্য নিশ্চয়ই নিষ্ঠুর নয়। বাবাকে কাছে পেয়েছেন, বাবার স্মৃতিকে ঐশ্বরিক নীল শিখার মত অক্ষয় করে রাখতে পেরেছেন এবং পরিশেষে বাবার কফিনটাও নৈঃশব্দের ভেতর লালন করছেন।

আমার কোন ক্ষমতা নেই আপনার বেদনার্ত হৃদয়কে সান্ত্বনা দেবার। বরং আপনার বেদনার তীব্রতা আমার ঘুমন্ত বেদনাকে জাগ্রত করেছে, তা অবহিত  করতেই এ চিঠি লেখা।

আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি খুব কম বয়সে। সুতরাং বাবার কোন স্মৃতি আমার কোষাগারে সংগৃহীত নেই। আমার বাবার মুখ আমি বিন্দুমাত্র মনে করতে পারিনা।

আপনি আপনার বাবাকে  কাছে পেয়েছেন এবং হারিয়েছেন। কিন্তু আমি পাইনি, কিন্তু হারিয়েছি। আমি এখনো বুঝতে পারিনা যাকে পাই নি তাঁকে কি করে হারাই।

আপনার বাবার মুখ কিছুটা হলেও মনে পড়ে আর দৃশ্যমান হয় বাবার কফিন। আমার বাবার মুখ বিন্দুমাত্র মনে পড়ে না, মনে পড়েনা কফিনের কোন স্মৃতিও।

বাবা তার সন্তানের কাছে অপরিচিত, এটা আমার কাছে ভয়ঙ্কর বেদনাদায়ক অবিচার মনে হয়। এমন কোন আদালত যদি পৃথিবীতে থাকতো যেখানে আমার এই আনীত অভিযোগ খন্ডন করা যায় তাহলে আমার দুঃখ খানিকটা হলেও অপসারিত হতো।

আমার বেদনার ভয়াবহ দানব আপনার সাক্ষাৎকারের সুবাদে আমার সামনে নতুন করে আবির্ভূত হয়েছে।

আপনার সাক্ষাৎকারের যে অংশটি অজস্র তারার মত উজ্জ্বল হয়ে আমার অন্তরাত্মার গভীরে কিরণ দান করছে, তা হচ্ছে আপনি বলেছিলেন "আমাদের ঘিরে তখন অসংখ্য লোক, শত শত ক্যামেরা, কফিন বহন করার জন্য গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো লাশের গাড়ি। চারপাশ থেকে ছবি তোলা হচ্ছে। বাবার মৃতদেহ যে বিমানে এসেছে, একই বিমানে আরেকটা কফিন সেদিন এসেছিল। একটা মেয়ে আর হয়তো তার মা এসেছিল মৃতদেহ নিতে।
মেয়েটা ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। তার হয়তো মনে হচ্ছিল, আমার বাবা মারা গেছে বলে চারিদিকে এত আয়োজন, অথচ  সেও তো একজন প্রিয়জন হারিয়েছে, তার জন্য তো কোন আয়োজন নেই। আমার মনে হচ্ছিল তাকে গিয়ে বলি, গাঁদা ফুল, ক্যামেরা, মানুষের ভিড় --এসবের কোন মূল্যই নেই আমার কাছে। বলি, প্রিয়জন হারানোর বেদনা তোমার আর আমার ভেতরে একদম একই রকম।"

আমি আপনার এই বক্তব্যে স্তম্ভিত হয়েছি, আপনি আত্মার দিক থেকে কত শক্তিমান, বিশাল শক্তিশালী প্রলোভনকে আপনি কত সহজে পরিত্যাগ করেছেন। নিজেকে কত সহজে আত্মম্ভরিতা থেকে মুক্ত করতে পেরেছেন। এই মানসিকতা আমাদের সমাজে বিরল।

আপনি কী নির্দ্বিধায় বলেছেন, ফুল, ক্যামেরা বা মানুষের ভিড় - এসবের কোন মূল্যই নেই আমার কাছে। আপনার এই মূল্যবোধ কোন জগত সংসারে প্রকাশ করেছেন যেখানে আমরা ক্যামেরা না থাকলে ভুখানাঙ্গা মানুষের রিলিফ বিতরণ বাতিল করে দেই, যেখানে ক্যামেরা না থাকলে সন্তান হারানো মায়ের আহাজারি শুনতে যাই না, যেখানে ক্যামেরার আওতায় থাকার জন্য নামাজ এ জানাজায় প্রথম কাতারে আমরা হুড়োহুড়ি করি, যেখানে ক্যামেরার জন্য অপেক্ষা করে আমরা নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠান শুরু করি না, যেখানে সেলফি না তুলে কোন লাশ দেখতে চাই না সেখানে কী দুঃসাহসিক কথা আপনি বলেছেন! 

আমরা যেখানে ফুলের মালার জন্য প্রস্ফুটিত ফুলের বাগান উজাড় করে দিতে পারি, যেখানে অতিরিক্ত ভিড় দেখানোর জন্য পায়ের নিচে মানুষ পিষ্ট করতেও আনন্দ বঞ্চিত হই না,
সেখানে ফুলের মালা, হই হুল্লোর, লোকে লোকারণ্য থাকার প্রশ্নটিই আপনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরা যে কত 'নিচ' এবং 'তুচ্ছ' বিষয় নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেছি তা আপনার এই বক্তব্যের পর আরো বেশি করে উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমাদের অগভীরতা ও অমানবিকতা আমাদের সমাজটাকে ধ্বংসের ইঙ্গিত বহন করছে কিন্তু আমরা সতর্ক হচ্ছি না। আমরা আমাদের চারপাশের সুউচ্চ বিল্ডিং, প্রকাণ্ড রাস্তা, চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অতি ধনবানদের কীর্তি এবং ধারণার অতীত অর্থ বিত্তের বাড়াবাড়িকে 'জাতীয় গৌরব' মনে করছি। আমরা অর্থহীন, অন্তঃসারশূন্য ও মূল্যহীন বিষয়গুলোকে মাথার মুকুটে পরিণত করে ফেলেছি।

আমরা যে অতি লোভে, স্বার্থসিদ্ধির দৌড়ে এবং স্বার্থপর ধ্যান-ধারণায় বিদ্যমান সমাজকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছি তা আমরা অনেকেই বিবেচনা করছি না। আমরা ফুলের মালা, রাজকীয় সংবর্ধনা, তোষামোদকারীদের দ্বারা পরিবৃত থাকা এবং অভ্যর্থনাকারীদের কাছ থেকে সসম্মানে মাথা নত করে পদক গ্রহণ করাকেই সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার মনে করি। ফলে মহৎ, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বা নৈতিক দিক থেকে উঁচুস্তরের  মানুষগুলো সমাজ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে - অপমানের ভয়ে সবসময় তটস্থ অবস্থায় আত্মগোপনে থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

আপনার রয়েছে প্রচন্ড নৈতিক সাহস। আপনি কি আমাদের সমাজের প্রভাবশালীদের আস্ফালন দেখেননি যাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র এবং গণমাধ্যমকে সতর্ক থাকতে হয়। তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সমাজের জন্য অপরিহার্য, তাদের অনুগ্রহ লাভের আশায় আমরা তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকি। পুরস্কৃতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য সত্য এবং বিবেক বিক্রি করে দিতেও আমরা কুন্ঠাবোধ করিনা। আমাদের সমাজে নৈতিকতা ও বিবেকবিহীন মানুষ ক্রমাগত আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাবিধাতা হয়ে উঠছেন। তাদের নিষ্ঠুরতা এবং পাশবিকতা আমরা প্রায়শই প্রত্যক্ষ করি।

আমরা যে 'মূর্খতা' ও 'নীচতা'র চাষ শুরু করেছি তাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের সত্য ও গভীর কথা বলার সুযোগ সংকুচিত হয়ে উঠবে। প্রতিমুহূর্তে আমাদেরকে ধ্বংস করার শক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমাদের উপর।

আপনার মত নির্মম সত্য আমরা  যদি না বলি তাহলে আমাদের কর্তব্যে বড় ধরনের ত্রুটি দেখা দেবে। আপনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছেন আমাদের মানবিক সমাজ এবং নৈতিক সমাজ বিনির্মাণের ভাবাদর্শ সর্বগ্রাসী প্রলোভনের প্লাবনে ভেসে গেছে।

আপনি সাক্ষাৎকারের শেষ কথাটি বলেছিলেন 'প্রিয়জন হারানোর  বেদনা তোমার আর আমার ভেতর একদম একই রকম।'

আপনার এ বক্তব্য আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা মানবিক দিক থেকে সর্বোচ্চ সমৃদ্ধ। আপনার পরদুঃখকাতরতা, সূক্ষ্ম সংবেদনশীলতা এবং গভীর মানবিকতায় আপনার স্বরূপ প্রতিভাত হয়েছে। এ ধরনের মূল্যবোধ 'মানুষ' এবং 'মানবিক' হওয়ার ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল। এধরনের চেতনা আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার পথকে প্রশস্ত করবে। এ জন্য আমার অন্তরাত্মা দিয়ে আপনাকে আমি সংবর্ধিত করছি এবং অভিবাদন জানাচ্ছি, সে জন্যই মূলত এই চিঠির অবতারণা। 

আমার গভীরে এমন উপলব্দি নেই যা আপনার প্রবহমান চেতনাকে আরও তেজোদীপ্ত বা জ্যোতির্ময় করতে পারে, মানুষের আত্মাকে আলোকিত করতে পারে। 

আপনাকে একটি ঘটনা না বললেই নয়। আমি আপনার পিতা হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে একটি গান লিখেছিলাম, এস আই টুটুল তাতে অসাধারণ সুর করেছেন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন। গানটি ছিল:

বড় ভালো আছি আমি
মাটিরও ভিতর
তোরা কেউ জানলে না 
আমার সুখবর
আমি ছিলাম মাটির ওপর
এখন মাটি আমারই ওপর..

গীতিকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি এটাই ছিল আমার নৈবদ্য। 

আপনার সাক্ষাৎকারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা এবং প্রতিক্রিয়া একান্তই আমার। আমার সীমাবদ্ধতা বা উপস্থাপনের দুর্বলতা নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

আপনার প্রেরণার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মানুষকে সমাজ রূপান্তরের মহৎ কাজে অনুপ্রাণিত করবে।

শীলা, আপনার সাক্ষাৎকার এর মধ্য দিয়ে আলোকোজ্জ্বল চেতনার যে বার্তা পেয়েছি তা লালন করবো কফিনে বিশ্রাম নেবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।

সর্বদাই ভালো থাকবেন।
শুভেচ্ছাসহ
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
২৩.০৭.২০২১
উত্তরা ঢাকা
[email protected]
 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status