অনলাইন

করোনার বিরুদ্ধে ভুটান মডেল, শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব

তারিক চয়ন

২৩ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ৯:৪১ পূর্বাহ্ন

ভ্রমণ করার জন্য বিশ্বের অনেক মানুষের কাছেই আকর্ষণীয় স্থান 'বজ্র ড্রাগনের দেশ' নামে পরিচিত ভুটান। বিশ্বের প্রথম কার্বন প্রভাবমুক্ত দেশ ভুটানের জনসংখ্যা মালদ্বীপের পর দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণও সবচেয়ে কম ভুটানে। এমনকি করোনা সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বের সব দেশের তালিকায়ও ভুটানের অবস্থান একেবারে নীচের দিকে (১৯০ তম)। প্রায় আট লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে আড়াই হাজারেরও (২,৪৫৬) কম মানুষের করোনা শনাক্ত  হয়েছে। তাদের মধ্যে ২,১৭৯ জনই ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সারা দেশে করোনা সাংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন মাত্র দুই জন মানুষ!

বিষয়টি এমন নয় যে, আকারে ছোট এবং জনসংখ্যা কম বলে ভুটানে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা কিংবা মৃত্যুসংখ্যা কম। বরং এমনটা বলা হবে পরিসংখ্যানকে মিথ্যা বলারই নামান্তর। তাহলে চলুন, জেনে নেয়া যাক ভুটানের বিষয়ে পরিসংখ্যান কি বলছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ভুটানে করোনার অবস্থানই বা কি।

পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার বলছে (বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত), দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে করোনা শনাক্তের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটিতে করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় চার লক্ষ বিশ হাজার মানুষ। শনাক্তের সংখ্যার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে সাড়ে ১৮ হাজার মানুষ করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তানে মারা গেছেন প্রায় ২৩ হাজার মানুষ। চতুর্থ নেপালে প্রায় ১০ হাজার জন। পঞ্চম শ্রীলঙ্কায় প্রায় চার হাজার জন। ষষ্ঠ আফগানিস্তানে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার জন। সপ্তম মালদ্বীপে মাত্র ২১৮ জন। অষ্টম তথা সর্বশেষ ভুটানে মাত্র দুইজন মানুষ মারা গেছেন।

দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ মালদ্বীপ এবং ভুটানে করোনাক্রান্ত হয়ে অল্প কিছুসংখ্যক মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু মৃত্যুসংখ্যায় এক কাতারে ফেললেও মালদ্বীপ এবং ভুটানকে মৃত্যুহারের দিক থেকে কিছুতেই এক কাতারে ফেলা যাবে না। কারণ প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার বিপরীতে ভুটানে যেখানে মারা গেছেন মাত্র তিনজন মানুষ, সেখানে মালদ্বীপে মারা গেছেন ৩৯৬ জন মানুষ! এছাড়া নেপালে (৩২৫) এবং ভারতেও (৩০১) প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার বিপরীতে মারা গেছেন তিনশোর বেশি মানুষ। বাকি চার দেশেও প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যার বিপরীতে মারা গেছেন একশোর বেশি মানুষ।

অনেকেই বলেন টেস্ট বেশি করা হলে করোনায় শনাক্তের সংখ্যাও বাড়ে। প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার বিপরীতে টেস্ট করার দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে ভুটান। দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপের (২০৩৭৯৫০) পরেই গড়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট করা হয়েছে ভুটানে (১০২৩১০৩)। অর্থাৎ গড়ে মোট জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি টেস্ট করা হয়েছে ভুটানে। প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার বিপরীতে সবচেয়ে কম টেস্ট করা হয়েছে যথাক্রমে আফগানিস্তান (১৭১৯৮) বাংলাদেশ (৪৪২৫৬) ও পাকিস্তানে (৬৯০৩৪)।

সবমিলিয়ে স্বাভাবিকভাবেই করোনা মোকাবিলায় সারা দুনিয়ার বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি এখন ভুটানের দিকে। তারা ভুটানের এই অভিনব সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন 'ভুটান মডেল'কে। কি সেই ভুটান মডেল যা অনুসরণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো পেতে পারে সাফল্য?

জনগণের সহনশীলতাঃ

ভুটানের জনগণ সহনশীল বলে খ্যাতি আছে। তারা সরকারি বিধিনিষেধ মেনে চলতেও অভ্যস্ত। একথা সবাই বলেন, সরকার যতোই ভালো পদক্ষেপ নিক জনগণের সচেতনতা, সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতা ছাড়া করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। করোনাকালের শুরু থেকেই ভুটানিরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে। মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাতধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সকল সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে তারা ছিল সচেতন।

সঠিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বঃ

করোনা মহামারী মোকাবিলায় সঠিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা বিশ্বের সব দেশেই বারবার পরিলক্ষিত হয়েছে। যে কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে করোনার সংক্রমণ রোধ করতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জোর অনুরোধ করে আসছে। এদিক দিয়ে দেখলে, করোনাকালের একবারে শুরু থেকেই ভুটান সঠিক পথে ছিল। কিছুদিন আগেই জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ও ইউএনডিপির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক কান্নি উইগনারাজা ভুটানের গণমাধ্যমেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার ভাষায় 'রাজার নেতৃত্বে ভুটানি সরকারকে করোনা মোকাবিলায় মডেল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় অভিনন্দন জানান'।

সীমান্তে কড়াকড়িঃ

করোনার আতুড়ঘর বলে পরিচিত চীন এবং এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি জর্জরিত দেশ ভারত- দুই দেশের সাথেই সীমান্ত রয়েছে ভুটানের। শুরু থেকেই সীমান্তে কঠোর নজরদারি বজায় রেখেছে ভুটান। করোনা নিয়ে বিশ্বে জানাজানি হওয়ার আগেই ২০১৯ সালের একেবারে শেষের দিকে চীনে 'অজানা কারণে' নিউমোনিয়ার খবর পাওয়া যায়। সাথে সাথেই ভুটানি সরকার 'আসন্ন বিপদ' মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া শুরু করে। বিমানবন্দরে এবং সীমান্তের প্রবেশমুখে শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যার উপসর্গযুক্ত এবং জ্বরে আক্রান্তদের স্ক্রিনিং করা শুরু করে। ০৬ মার্চ ভুটানে প্রথম করোনাক্রান্ত শনাক্ত হন। তিনি ছিলেন ভুটান ভ্রমণে আসা একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ওইদিনই তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের 'ট্রেস' করে 'কোয়ারেন্টিন' করা হয়। এছাড়া পর্যটননির্ভর দেশটি পর্যটকদের প্রবেশেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।  বিদেশফেরত ভুটানিদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়। ভালো হোটেলে থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করে তাদের উৎসাহিত করা হয়। গেলো মাসেই একটি চমকপ্রদ খবর সারা দুনিয়ায় চাউর হয়ে যায়- সংক্রমণ ঠেকাতে সীমান্ত পাহারায় স্বয়ং ভুটানের রাজা। বিস্তারিত খবরে জানা যায়, সংক্রমণ বাড়তে থাকায় রাজা জিগমে খেসার নামগিল ওয়াংচুক পূর্ব সীমান্তে পাঁচদিন টহল দিয়েছেন। সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, যিনি নিজেই একজন চিকিৎসক। অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমে যেন নিজ দেশে সংক্রমণ না বাড়ে সেজন্য রাজা নিজেই মাঠে নামেন! জানা যায়, মহামারি শুরুর পর থেকে রাজা নিজের বাড়িতে খুব কমই অবস্থান করেছেন। তার বেশিরভাগ সময় কেটেছে নিজ দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে।

কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনঃ

করোনা ঠেকাতে যখন যেখানে কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন প্রয়োজন হয়েছে সেখানেই তা নিশ্চিত করেছে ভুটান। ১১ ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কঠোরভাবে করোনাকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। পাঁচ দিন পরেই সংক্রমণ ছড়াতে পারে এমন সম্ভাব্য ভুটানিদের জন্য বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা চালু করে। সকল শনাক্তদের আলাদা করা হয়। এমনকি যারা টেস্টে পজিটিভ হন নি কিন্তু প্রাথমিক উপসর্গ রয়েছে তাদের আইসোলেশনে রাখা হয় যাতে আক্রান্ত হলে তাদের দ্রুত চিকিৎসা করা যায়। আলাদা করা এবং পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন রোগীদের মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ প্রদান করা হয়।

বিনামূল্যে সববয়সীদের গণটিকাদানঃ

ভুটান দেশের ভিতরে এবং বাইরের নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে করোনার টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ভুটান বিশ্বের প্রথম দেশ যেখানে কোভিশিল্ড (অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকা) ভ্যাকসিন আসে।দেশটি মার্চে গণটিকাদান শুরু করে। শুরু থেকেই প্রাপ্ত বয়স্ক যে কোন ব্যক্তি টিকা নিতে পারছেন। ছোট দেশটিতে প্রায় ১২০০ টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে হেলিকপ্টারে করে টিকা পাঠানো হয়। এর ফলে, ৬০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ প্রদান দুই সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। ভারত থেকে টিকা আসা বন্ধ হয়ে গেলে সাময়িকভাবে দেশটি অসুবিধায় পড়লে কার্যকর ও দক্ষ 'ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি'র কারণে এখন ভুটানে বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক টিকা আসছে। আট লক্ষেরও কম জনসংখ্যার দেশটিতে জুলাই মাস থেকে আসতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঁচ লক্ষ, ডেনমার্ক থেকে আড়াই লক্ষ, ক্রোয়েশিয়া-বুলগেরিয়া-অন্যান্য দেশ থেকে এক লক্ষ, চীন থেকে ৫০ হাজার এবং কোভ্যাক্স থেকে প্রায় ছয় হাজার ভ্যাকসিন। কোভাক্স প্রকল্পকে সহযোগিতা এবং দেশব্যাপী সার্বজনীন টিকাদান অভিযানের লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে কাজ করেছে ভুটান যাতে সব ভুটানি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টিকা পেতে পারেন। মঙ্গলবার দেশজুড়ে দ্বিতীয় ডোজ টিকাদান কর্মসূচী শুরু হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, করোনা মহামারী মোকাবিলায় ভুটানের সাফল্যের গল্পটি অবশ্যই সারা বিশ্বের সাথে ভাগ করে নেওয়ার দাবিদার। জনগণের সচেতনতার পাশাপাশি ভুটান সরকার প্রাথমিক সতর্কতার পর অবিলম্বে কৌশলগত এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষতার সাথে পর্যাপ্ত টেস্টিং, ট্রেসিং; প্রয়োজনীয় স্থানে স্যানিটাজার ও পিপিই বিতরণ, কার্যকর কোয়ারেন্টিন এর ব্যবস্হা গ্রহণ, সীমান্তে নজরদারিতে সুফল পাওয়া গেছে। জনগণেরও নেতৃত্বের উপর আস্থা ছিল যে,
তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। সবমিলিয়ে করোনা মোকাবিলায় সাফল্য পাওয়া গেছে। দুমাস আগে ইউনিসেফ তাই বলেছে, আক্ষরিক অর্থেই ভুটান এখন দক্ষিণ এশিয়ার সর্বশেষ দেশ হিসেবে করোনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status