মত-মতান্তর

কুরবানি প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন এবং হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত ঘটনার তুলনামূলক পর্যালোচনা

গাজী মিজানুর রহমান

২১ জুলাই ২০২১, বুধবার, ৩:০২ অপরাহ্ন

পৃথিবীর তিনটি বড় ধর্মীয় সম্প্রদায়, যথা মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদী। সকলেরই পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম (আঃ)। ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র ইসমাইল (আঃ) মুসলমানদের আদি-পুরুষ। অপরদিকে খ্রিস্টান ও ইহুদী উভয় সম্প্রদায়ের বংশ-ধারা নেমে এসেছে ইব্রাহিম (আঃ) এর অপর পুত্র ইসাহাক (আঃ) থেকে। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঈদুল আজহা উদযাপন করে, পবিত্র কুরআনে বর্ণিতমতে তার উৎস ইব্রাহিম (আঃ) কর্তৃক আল্লাহর হুকুমে ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানি করতে নেয়ার ঘটনা। অন্যদিকে ইহুদী এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিশ্বাস করে, আল্লাহ বা গড ইসাহাক (আঃ) কে উৎসর্গ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইব্রাহিম (আঃ) এর দুই পুত্রকে ঘিরে দুই রকমের দাবি একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারী মানুষের কাছে একটা প্রশ্নের উদ্রেক করে।

পবিত্র কুরআনের সূরা আস-সাফফাতের ৮৩-৯৯ নং আয়াত পর্যন্ত ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে প্রাচীন ইরাকের দেব-দেবীর উপাসনাকারীদের সংঘাতের কথা বলা হয়েছে। তারপর ১০০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ইব্রাহিম (আঃ) একটা নেক সন্তান চাইলেন আল্লাহর কাছে। আল্লাহপাক তাকে সেই সন্তান দিলেন, যা ১০১ নং আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে- “So We (Allah) gave him the good news of a boy ready to suffer and forbear” ( আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর অনুবাদ )। তারপর সেই সন্তান বড় হলে আল্লাহ তাকে কুরবানি করতে নির্দেশ দিলেন। ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) আল্লাহর এই আদেশ পালন করতে প্রস্তুত হলেন। তখন আল্লাহ তাদের উভয়কে আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য পুরস্কৃত করলেন। ইসমাইল (আঃ) এর স্থলে একটি পশু কুরবানি হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, তাদের জন্য এটা একটা পরীক্ষা ছিল। তারপর এই ঘটনার বর্ণনা শেষ হলে আয়াত ১১২-তে আল্লাহ বলেন, “And We gave him the good news of Isaac - a prophet, one of the righteous.” (আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর অনুবাদ)। এভাবে ইব্রাহিম (আঃ) কে দুটি সুসংবাদ দেয়া হয়। প্রথম সুসংবাদের পুত্র ইসমাইল (আঃ) এবং দ্বিতীয় সুসংবাদের পুত্র হচ্ছেন ইসাহাক (আঃ)। কাজেই এটা স্পষ্ট যে যাকে কুরবানি করতে নেয়া হয়েছিল, সেই সন্তানের নাম না বলা হলেও ‘কষ্ট স্বীকার এবং ধৈর্য ধারণের জন্য প্রস্তুত বালক বলে ইসমাইল (আঃ) কে বুঝানো হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এমন পরোক্ষ ইঙ্গিতময় উক্তির ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।

ইহুদী ধর্মগ্রন্থের অংশ জেনেসিসে পূর্বোক্ত বর্ননার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য রয়েছে। জেনেসিসের ২২ নং চ্যাপ্টারে বলা হয়েছে “ And he said, Take now thy son, thine only son Isaac, whom thou lovest, and get thee into the land of Moriah; and offer him there for a burnt offering upon one of the mountains which I will tell thee of.” (কিং জেমস ভার্সান )। জেনেসিস মতে ইব্রাহিম (আঃ) এর ৮৪ বছর বয়সে ইসমাইল (আঃ) এবং ১০০ বছর বয়সে ইসাহাক (আঃ) এর জন্ম হয়। এছাড়া জেনেসিস মতে ইসাহাক (আঃ) এর ৩৭ বছর বয়সে তাকে উৎসর্গ করতে নেয়া হয়েছিল, যখন ইব্রাহিম (আঃ) এর বয়স ১৩৭। ইব্রাহিম (আঃ) ১৭৫ বছর বেঁচেছিলেন। জেনেসিসের ১৬ এবং ১৭ নং চ্যাপ্টারে ইসমাইল (আঃ) কে জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং হাজেরা (রাঃ)-কে দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়স সে সময়ের মানুষের আয়ুষ্কাল অনুযায়ী পিতা-মাতার অভিভাবকত্বের অধীনে থাকা শিশু-বয়স বলা যায়। কিন্তু ৩৭ বছর বয়স সেদিক দিয়ে একটু বেশি। আবার ইসাহাক (আঃ) এর জন্মের আগে ১৪ বছর ইসমাইল (আঃ) পিতার একমাত্র পুত্র ছিলেন। ইসাহাক (আঃ) কখনোই ইব্রাহিম (আঃ) এর একমাত্র পুত্র ছিলেন না। এগুলি বিষয় জেনেসিসের বর্ণনা বিশ্বাস করার পথে বিরাট বাধা।

ইসলামিক ধারার দর্শন মতে, হিব্রু বাইবেল দীর্ঘকাল পরে লেখার কারণে অনেক স্থানে পাল্টে গেছে। এরকম পাল্টে যাওয়ার উদাহরণ হিসেবে কুরবানি সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ‘ইসমাইল’ নামের স্থানে ‘ইসাহাক’ করা হয়েছে , এমন দাবি করা মোটেও অযৌক্তিক নয়। প্রশ্ন ওঠে, কি কারণে এমন করা হয়েছে? ধৈর্যের ও সহনশীলতার আদর্শ দেখিয়ে হাজেরা (রাঃ) ও ইসমাইল (আঃ) নিজ বাসভূমি ছেড়ে মক্কায় এসেছিলেন। তবুও ইসাহাক (আঃ) এর মাতা সারা (রাঃ) এবং ইসমাইল (আঃ) এর মাতা হাজেরা (রাঃ) এর মধ্যে পারিবারিক মনোমালিন্যকে পুঁজি করে হাজেরার (রাঃ) প্রতি ইহুদীরা বিরূপ মনোভাব পোষণ করতো। এর ফলে ইব্রাহিম (আঃ) এর সময়ের কমবেশি ১২০০ বছর পরে নেবুচাদনেজারের ব্যাবিলনের দাসত্ব থেকে ফিরে এসে জেনেসিস কিতাব গ্রন্থিত করার সময় আরবীয় গোত্র অপেক্ষা নিজেদের শ্রেষ্ঠ্যত্ব দেখাতে গিয়ে ইহুদীরা ঘটনার সাথে যোগ-বিয়োগ করেছে বলে মুসলিম ধর্মশাস্ত্র-গবেষকদের বিশ্বাস।

জেনেসিসে তথ্য ওলোট-পালটের দাবির সমর্থনে আর একটি বিবরণ উল্লেখের দাবি রাখে। ইয়াকুব (আঃ) এর অপর নাম ইসরায়েল। তার সন্তান-সন্ততি ইসরায়েলি নামে অভিহিত। ইয়াকুব (আঃ) এর অপর ভ্রাতার নাম ছিল ইসাউ। ইসমাইল (আঃ)ছিলেন তাদের উভয়ের চাচা। আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আঃ) ইরাক ছেড়ে যান কানানে। কানান তার এবং তার বংশধরদের জন্য প্রতিশ্রুত স্থান। কিন্তু অন্য সব শরীক বাদ দিয়ে ইসরায়েলিরা কেবল ইব্রাহিম (আঃ) এর একটা পৌত্র ইয়াকুব (আঃ) এর বংশধরদের জন্য কানান এলাকার স্বত্ব দাবি করে। এছাড়া জেনেসিসে এমন এমন কাজের উল্লেখ আছে , যা সেই সময়ে নবি হিসেবে পরিগণিত ব্যক্তিগণ করতে পারেন তা বিশ্বাস করা কঠিন। এর মধ্যে ইয়াকুব (আঃ) কর্তৃক ভ্রাতা ইসাউ এর উত্তরাধিকার দখল করার কাহিনীটি এখানে প্রাসঙ্গিক। ইসাহাক (আঃ) এর পুত্র ইসাউ ও ইয়াকুব (আঃ) জমজ হলেও ইসাউ ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ। সে সময়ের রীতি অনুযায়ী বয়োজ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কিছু অগ্রাধিকার-প্রাপ্যতা ছিল। ইসাহাক (আঃ) ছিলেন অন্ধ। জেনেসিসে বলা হয়েছে যে, একদিন ইসাউ বাড়িতে ছিলেন না; ইয়াকুব (আঃ) মায়ের প্ররোচনায় বকরির চামড়ায় আবৃত হয়ে বাবার কাছে গিয়ে নিজেকে ইসাউ হিসেবে উপস্থাপন করেন। এই বেশ গ্রহণের কারণ ছিল যে, ইসাউ ছিলেন লোমশ শরীর-বিশিষ্ট। ইসাহাক (আঃ) তার শরীরে হাত দিয়ে লোমশ গা দেখে তাকে ইসাউ ভেবে ওয়াদা করে বসলেন যে, তাকে তার উত্তরাধিকারী করা হবে। আরো বলা হয় যে, ভীষণ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ইসাউ এক বাটি ডালের স্যুপের বিনিময়ে তার স্বত্ব ত্যাগ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব মহামানবেরা যাদের সকল ঈর্ষার ঊর্ধ্বে থাকার কথা, তারা কি এমন করতে পারেন? এসব কাহিনী থেকে বুঝা যায় যে, ইসরাইলিরা নিজেদের প্রাধান্য, সম্পত্তির অধিকার ও দেশের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মগ্রন্থে কিছু কাহিনী অন্তর্ভূক্ত করেছিল যা কিছুটা অবান্তর বলে প্রতীয়মান হয়। উল্লেখ্য যে এগুলিসহ জেনেসিস লেখা হয়েছিল মুসা (আঃ) এর তিরোধানের প্রায় ৮০০ বছর পরে।

একইভাবে ইব্রাহিম (আঃ) এর আরব গোত্রের উত্তরসূরিদেরও খাট করে দেখাতে কুরবানির প্রসঙ্গটি উলটে দেয়া হতে পারে, বলে মুসলিম ধর্মশাস্ত্র-গবেষকদের অভিমত। পবিত্র কুরআনে কুরবানির সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি পড়লে বুঝা যায় যে , আল্লাহপাক তার প্রিয় একজন নবি ইব্রাহিম (আঃ)এর উপর তার প্রথম পুত্র ইসমাইল (আঃ) কেই কুরবানি করতে হুকুম দিয়েছিলেন। সেই কারণে মুসলমানেরা আজও পশু কুরবানির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। পবিত্র কুরআনের সূরা সাফফাতের ১০৭ এবং ১০৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে “ And We ransomed him with a momentous sacrifice : And We left [this blessing] for him among generations [to come] in later times. ” (আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর অনুবাদ)।

(সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট ও লেখক)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status