অনলাইন

করোনার ধারাবাহিক রেকর্ড, শাটডাউন ও উৎসবের অর্থনীতি

অনিল মো. মোমিন

২০ জুলাই ২০২১, মঙ্গলবার, ৪:৪৪ অপরাহ্ন

জীবন ও জীবিকার কাঁটা হয়ে করোনার সগৌরব তাণ্ডব এখনো অব্যাহত রয়েছে। প্রথম ঢেউ কোনভাবে সামলে উঠলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যেন অপ্রতিরোধ্য। দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর তা নিয়ন্ত্রণে সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ দিয়ে আসছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনও স্থানীয়ভাবে কিছু এলাকায় বিশেষ বিধিনিষেধ জারি করেছিল। কিন্তু এরপরও করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে নি। কমিউনিটি স্প্রেডিং বা সামাজিক সংক্রমণ বিপদজনক পর্যায়ে যাওয়ায় সরকার ১ জুলাই থেকে সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে। প্রথমে এক সপ্তাহের জন্য পরে তা বাড়িয়ে ১৪ জুলাই পর্যন্ত করা হয়। এতেও তেমন কাজ হয়নি, সংক্রমণ কমেনি। বরং প্রতিদিন তা রেকর্ড সংখ্যক হারে বাড়ছে। গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিনের মৃতের সংখ্যা ২০০ এর অধিক। গত এক সপ্তাহে মারা গেছে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। সব মিলে এ রোগে মৃতের সংখ্যা ১৭ হাজারের অধিক এবং শনাক্ত সাড়ে ১০ লাখ। এর মধ্যেই পবিত্র ঈদুল-আজহাকে সামনে রেখে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে।

অন্যদিকে কঠোর লকডাউন চলমান থাকলেও কিছুক্ষেত্রে গণমানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা যায়নি। কেননা করোনা মহামারীর এই দীর্ঘ সময়ে মানুষের জীবিকা নির্বাহ খুব কঠিন হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হওয়ায় দারিদ্র্য বাড়ছে, বাড়ছে কাজের অনিশ্চয়তা। গরিব, নিম্নবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্তের আয় কমছে। ফলে মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে। কারো কারো পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়ে লকডাউনকে অবজ্ঞা করে বেরিয়ে পড়ছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বেরিয়ে পড়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া দলে দলে বাড়ি ফেরাদের কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। এখন লকডাউন শিথিল করায় ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঢল আরো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে লকডাউনের সিদ্ধান্তটি নিয়ে সচেতন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরকারী চাকুরে ও যেসব পেশার লোকজন লকডাউনেও বেতন-ভাতাদি পাচ্ছেন তারা এই সিদ্ধান্তকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে এমন সিদ্ধান্তে যারপনাই খুশি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের খেটে খাওয়া মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। এছাড়া কঠোর লকডাউনে বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়া মানুষদের জন্য এটি বাড়ি ফেরার একটি বড় সুযোগ ।

লকডাউন শিথিলের যৌক্তিকতা মূল্যায়ণে অর্থনীতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাই সময় বিবেচনায় অর্থনীতি বিশ্লেষণ অতীব জরুরি। সময়ের দিকে তাকালে দেখা যায় এখন ঈদ। একটি বৃহৎ উৎসবের সময়। উৎসব মানে অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি। সময়টা 'উৎসবের অর্থনীতি'র বলে এসময়ে অর্থনৈতিক তাৎপর্য অপরিসীম। ঈদ বা উৎসব অর্থনীতিতে তারল্য বৃদ্ধিতে বিরাট সহায়তা করে। কুরবানীর ঈদের অর্থনৈতিক চিত্রের দিকে চোখ বুলানো যাক। এসময়ে পশু, চামড়া শিল্প, ট্যানারি, মশলা, ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটর, ফ্যাশন,পরিবহন ব্যবস্থাসহ দেশে প্রায় ৭৫ হাজার কোটির অধিক টাকার কোরবানীর বাণিজ্য রয়েছে। এরমধ্যে বৃহৎ অংশ শুধু গবাদি পশুকেন্দ্রিক। বর্তমানে দেশে মজুদকৃত ৪১ কোটি ২২ লাখ ৪৪ হাজার গবাদি পশুর মধ্যে আসন্ন ঈদে কোরবানির জন্য প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ গবাদিপশু প্রস্তুত আছে। সংশ্লিষ্টদের মতে এর মধ্যে গরু-মহিষের বাজারমূল্য ১৩ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা, কোরবানি যোগ্য ছাগল-ভেড়ার মোট বাজারমূল্য ৫ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা, উট-দুম্বার মোট বাজারমূল্য ২৩৮ কোটি টাকা বলছেন। কোরবানির পশু বেচা-বিক্রিকে ঘিরে পরিবহন খাতে লেনদেন প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। কোরবানির আরেকটি উপকরণ হলো কামার পণ্য। ছুরি, বঁটি, দা, চাপাতি, কুড়াল, রামদা ছাড়া কোরবানিই সম্ভব নয়। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বাজারতথ্য বলছে, কোরবানিতে এ পণ্যের বাজারও ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। পাশাপাশি কুরবানী পশুর চামড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চামড়া ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতিবছর দেশে দেড় কোটিরও বেশি পশুর চামড়া পাওয়া যায়। এর প্রায় ৮০ শতাংশই আসে কোরবানির পশু থেকে। চামড়া খাতের মূল বাজার ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য বাজারসহ এ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। কোরবানির আরেক বড় বাজার পেঁয়াজ-রসুনসহ গরম মশলার বাজার। প্রতিবছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টন। রসুনের চাহিদা ৫ লাখ টন, আদা ৩ লাখ টন। এর উল্লেখযোগ্য অংশই কোরবানিতে ব্যবহার হয়। অন্যদিকে গরম মশলা বিশেষ করে এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতার বড় অংশ ঈদের রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এসব মসলা ঘিরে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এছাড়া এই ঈদকে ঘিরে রেফ্রিজারেটর ও ডিপ ফ্রিজ বা ফ্রিজার বিক্রির ধুম পড়ে যায়। বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে ফ্রিজের বাজার। মোট বিক্রির প্রায় ৪০ শতাংশই ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে হয়। আবার কোরবানি মূল উৎসব পশুকে ঘিরে হলেও নতুন পোশাক বিক্রির দ্বিতীয় উৎসব এটি। ফ্যাশন সামগ্রীর কমপক্ষে ১০ শতাংশ লেনদেন হয়ে থাকে কোরবানির ঈদে। ফ্যাক্টরি, শোরুম, মাল, সাপ্লাইয়ার, তাঁত শ্রমিক, সেলাইকর্মীসহ ৫ লাখের বেশি লোক জড়িত এ পেশায়।

লকডাউন অব্যাহত থাকলে বিশাল এ অর্থনীতির বড় ক্ষতির পাশাপাশি এর সঙ্গে যুক্ত কয়েক লাখ মানুষের জীবিকার সাথে ঈদ আনন্দও অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বিশেষ করে গবাদিপশুর প্রান্তিক খামারীরা অধিক লোকসানের মুখোমুখি হবে। চামড়া, কামার, মশলা, ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটর, ফ্যাশন,পরিবহন ব্যবস্থাসহ সর্বোপরি ঈদ অর্থনীতির সাথে জড়িত সারাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে। এমনিতে তুলনামূলক স্থবির জীবিকায় সবাই এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন আর কেউ কারো প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, কারো বিপদে এগিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। একদিকে বেসরকারি সহায়তা নেই অন্যদিকে সরকারী অপ্রতুল সহায়তা। করোনার ক্ষতি পোষাতে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। তবে সেই তহবিল থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবসায়ী কোনো সহায়তা পাননি। যারা পেয়েছেন, তাদেরও মূলত প্রণোদনার ঋণ দিয়ে আগের নেওয়া ঋণ সমন্বয় করা হয়েছে। তাছাড়া প্রণোদনার সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পর্যন্ত আসেনি। এভাবে একদিকে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে ধনিকশ্রেনির বিভিন্ন খাত থেকে আয় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও খরচের খাত কমায় ব্যাংকে তারুল্য বৃদ্ধি করছে।

গতিশীল অর্থনীতির একটি অন্যতম নিয়ামক হলো টাকার হাত বদল করা। টাকা যত বেশি হাত বদল করবে অর্থনীতি তত চাঙ্গা হবে। কিন্তু লকডাউনে টাকার প্রচলন গতি নিম্নমুখী। যা অর্থনীতিকে স্থবিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে তাই টাকার হাতবদল বাড়ানো প্রয়োজন। আর কাজটি সম্পন্ন করার জন্য ঈদ উৎসবকালীন এসময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঈদ অর্থনীতির ৭৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের সম্ভাবনার রয়েছে। অর্থনীতির এই বৃহৎ বাজার সাধারণত ঈদের মাসখানেক আগে থেকে শুরু হয়। তবে এবার এর জন্য সময় পাওয়া যাচ্ছে মাত্র এক সপ্তাহ। নিঃসন্দেহে এটা মন্দের ভালো। পাশাপাশি রেমিট্যান্স, দান খয়রাত, উপহার সব শ্রেণীর মানুষের হাতে টাকার যোগান বাড়াবে। এতে সামগ্রিক ভোগ বেড়ে উৎপাদন ব্যবস্থা গতিশীল হবে। এটা ভাবার সময় এসেছে যে করোনার সংক্রমণ রোধে লকডাউন একমাত্র ব্যবস্থা নয়। সারা বিশ্বই বিকল্প ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি সরকারের বিধিনিষেধের মধ্যে শিল্প-কারখানা বিশেষ করে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখা হয়েছে। কারণ, ইউরোপ-আমেরিকায় দোকানপাট খোলা থাকায় পোশাকের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা রয়েছে আমাদের দেশের অভ্যন্তরেও।

তবে এর মধ্যে প্রতিদিনের মৃত্যু ও শনাক্তের রেকর্ড আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতার বিষয়টি সামনে আনে। মানুষের বেপরোয়া গতিবিধি স্বাস্থ্যবিধিকে চরম ঝুঁকিতে ফেলে। তারপরও শাটডাউনের প্রতিটি দিনই ছিলো নতুন নতুন রেকর্ডের দিন। ফলে করোনরোধে শাটডাউন কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত ও গরীব অসহায়দের মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির নিবেদনই দেখতে পাই বেশি। লকডাউনে মানুষের আয়ের উৎস বন্ধ করে স্বাস্থ্যবিধিতে জীবন বাঁচানো সম্ভব নয়। কেননা ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি। আবার দাতব্য সংস্থা অক্সফামের মতে বিশ্বে প্রতিমিনিটে বিভিন্ন রোগে মারা যায় ৭ জন কিন্তু ক্ষুধায় মারা যায় ১১ জন। জীবনের সাথে জীবিকার গুরুত্ব তাই সর্বাধিক হতে হবে। সবাইকে মাস্ক পরিধান নিশ্চিতকরণ ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে শতভাগ টিকা নিশ্চিতেই করোনা সংক্রমণ রোধ করতে পারে। তাই লকডাউন শিথিলকরণ সিদ্ধান্তকে কিভাবে দেখবেন তা ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছেন। সে যাই হোক না কেন উৎসবকালীন অর্থনীতি চলতে দেয়া খুবই জরুরি।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status