প্রথম পাতা
শ্বাসরুদ্ধকর ৪ ঘণ্টা
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
১৭ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৯:২৪ অপরাহ্ন
মধ্যরাতের পর হঠাৎ অক্সিজেন সংকট দেখা দেয় সিলেটের সুবহানীঘাটের কমিউনিটি বেইজড ক্লিনিকে। রাস্তায় যানজটে গাড়ি আটকে থাকায় সময়মতো অক্সিজেন আসেনি সিলেটে। এ কারণে অক্সিজেন সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ওই ক্লিনিকে যথাসময়ে সিলিন্ডার পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। রাতে অক্সিজেন সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন স্বজনরা। সকাল পর্যন্ত প্রায় ৪ ঘণ্টা ওই হাসপাতালে রোগী এবং তাদের স্বজনরা ছিলেন তীব্র আতঙ্কে। এর মধ্যে প্রায় ১১ জন আইসিইউসহ অক্সিজেন সাপোর্টে থাকা রোগী নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপও করেন। কেউ কেউ চলে যান বাড়িতেও। অক্সিজেন সংকটের কারণে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেন সম্বলিত এম্বুলেন্স নিয়ে আসেন। রোগীদের গাড়িতে রেখে অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হয়। এ ঘটনা গতকাল ব্যাপক আলোচিত হয়েছে সিলেটে। কিন্তু ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অসহায়। অক্সিজেনবাহী গাড়ি পথিমধ্যে যানজটে আটকা পড়ার কারণে সিলেটে এসে পৌঁছেনি। এ কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্প্রেক্ট্রার পক্ষ থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে সকালের দিকে তারা অক্সিজেন সরবরাহকারী অন্য প্রতিষ্ঠান লিন্ডা ও ইসলাম থেকে অক্সিজেন এনে সরবরাহ স্বাভাবিক করেন। হাসপাতালের পরিচালক ডা. তারেক আজাদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘অক্সিজেনের গাড়ি সিলেটে এসে না পৌঁছার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সংকট দূর করেছি। তবে, অক্সিজেন সংকটের কারণে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি।’ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা সিলেটের ডিস্ট্রিবিউটর মাসুদ আহমদ জানিয়েছেন, ‘লকডাউন ভাঙার পর থেকে রাস্তায় অনেক যানজট। এতে করে ঢাকা থেকে গাড়ি আসতে বিলম্ব হওয়ায় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা যায়নি। রাতে যে গাড়ি আসার কথা ছিল সেটি সকালে আসার পর অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।’ এদিকে, করোনাকালীন সময়ে সিলেটে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৫গুণ। আগে যেখানে প্রতিদিন ৫ হাজার কিউবিক মিটার অক্সিজেনের চাহিদা ছিল সিলেটে; এখন সেটি বেড়ে প্রায় ২৫ হাজার কিউবিক মিটারে দাঁড়িয়েছে। সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেনে এখনো টান পড়েনি। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করছে লিন্ডা এবং স্প্রেক্ট্রা। আর শামসুদ্দিন হাসপাতালে অক্সিজেন দিচ্ছে স্প্রেক্ট্রা কোম্পানি। সরকারি এ দুটি হাসপাতালে সংকট দেখা দিলেও সংশ্লিষ্টরা অক্সিজেন নিয়ে প্রতিনিয়ত শঙ্কায় থাকেন। কারণ, এখন একদিন পরপর অক্সিজেন রিলিফ করতে হচ্ছে। ভারত থেকে আমদানি করা অক্সিজেন এ দুটি হাসপাতালে দেয়া হয়। বেনাপোল থেকে গাড়ি এসে অক্সিজেন রিলিফ (সরবরাহ) করে দিয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা পর সিলেটে আসছে অক্সিজেনবাহী গাড়ি। হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী বাড়ায় অক্সিজেন দ্রুত ফুরিয়ে যায়। অন্যদিকে, গাড়ি আসতেও বিলম্ব হয়। ফলে প্রতিনিয়ত অক্সিজেন নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। সিলেটের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মিজানুর রহমানও জানিয়েছেন শঙ্কার কথা। বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালে আমরা শঙ্কায় ছিলাম। হাসপাতালের অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছিল, অন্যদিকে অক্সিজেনবাহী গাড়িও আসছিল না। অক্সিজেন সংকট হলে আইসিইউতে, ওয়ার্ডে অক্সিজেন সাপোর্টে থাকা রোগী মারা যাবে। তবে, অক্সিজেন ফুরিয়ে আসার আগ মুহূর্তে গাড়ি এসে হাজির হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।’ ডা. মিজান জানান, ‘শামসুদ্দিন সিলেটের করোনা হাসপাতাল। এখানে প্রতিনিয়ত করোনার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। সুতরাং অক্সিজেন ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। এখন যানজটের কারণে রাস্তায় গাড়ি আটকে পড়ে। এ সমস্যাটি এখন দূর করতে হবে বলে জানান তিনি।’ এদিকে, সিলিন্ডারে অক্সিজেন সরবরাহ নিয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে। ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রায় ৫ গুণ সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়েছে। অক্সিজেন সরবরাহী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হঠাৎ করে সিলিন্ডার বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সিলিন্ডার সংগ্রহ করার তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও সিলিন্ডার সংগ্রহ করতে পারছে না। এ নিয়ে অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সিলেটের বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ চলছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি হচ্ছে- ‘পূর্বের মতো নিজেদের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে।’ আর এভাবে সরবরাহ দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সিলেটে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডের এজেন্ট মো. আলী হোসেন গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘অক্সিজেনের গাড়ি সময়মতো সিলেটে আসা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। পাশাপাশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের সিলিন্ডার দিয়ে এখন সিলেটের সব হাসপাতালে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। আমরা সাধ্যমতো অক্সিজেনের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছি। সিলিন্ডার সাপোর্ট দিলে আশা করি সময়মতো অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবো।’ এদিকে, সিলেটে করোনা ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি হাপসাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তীব্র লড়াইয়ে নেমেছেন। এখন সিলেটের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৬০০ রোগী রয়েছে। এর মধ্যে একশ’ রোগী রয়েছেন আইসিইউতে। এছাড়া, আরও প্রায় ৫০০ রোগীকে ওয়ার্ডে ও কেবিনে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সিলেটের বেসরকারি ক্লিনিক ও মেডিকেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. নাসিম হোসাইন জানিয়েছেন, হাসপাতালে আর আইসিই বেড ও করোনা ওয়ার্ড বাড়ানো সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ, করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সাপোর্টের প্রয়োজন। এখন যে পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন তা সংগ্রহ করতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। বেশি রোগী হলে আরো অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে।’ তিনি জানান, ‘সিলেটে সরবরাহ করা অক্সিজেন আসে ঢাকা থেকে। সড়ক পথে আসার সময় গাড়ি যানজটে ঘণ্টার ঘণ্টা বসে থাকে। এ কারণে মাঝে মধ্যে অক্সিজেনের সংকট দেখা দেয়। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি গতকাল সকালে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। পথে অক্সিজেনবাহী গাড়ি থাকলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিলেটে পৌঁছাতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়; সেই নির্দেশনা ইতিমধ্যে প্রশাসনিক ভাবে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।’