প্রথম পাতা

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন

রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন এখনো বহাল কেন?

স্টাফ রিপোর্টার

১৭ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৯:১৮ অপরাহ্ন

বৃটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনটি এখনো কেন বহাল রয়েছে সে প্রশ্ন তুলেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আইনটি বাতিল চেয়ে করা একটি মামলার শুনানি চলছে দেশটির প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে। শুনানি চলাকালে আদালত ৭৫ বছর আগের আইনটির এখনো কার্যকর থাকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনটির প্রয়োগ নিয়ে নানা সময়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ফৌজদারি আইন নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের এ সংক্রান্ত আইনটি হুবহু একই।

বিজেপি শাসিত কেন্দ্র সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনটি ভিন্নমত দমনে অপব্যবহার করছে সে কথা শুনানিতে উল্লেখ করেছেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। এ নিয়ে বিবিসি বাংলা’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছে,  যে আইন ঔপনিবেশিক প্রশাসন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতো, সেটার এখনও প্রয়োজন কেন- এই প্রশ্নও তুলেছে আদালত।

ভারতীয় দণ্ডবিধির যে ‘১২৪ এ’ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হয়, তার যে ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে দেশজুড়ে, সেই কথা জানিয়েছে বেঞ্চ। কলকাতার অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী প্রসূন চ্যাটার্জী বলছেন এই আইনটির অপব্যবহারের অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি তিনি নিজেই। মাওবাদীদের সমর্থিত লালগড় আন্দোলনের নেতা ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গেই ২০০৯ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে এবং নিম্ন আদালতে তার যাবজ্জীবন সাজাও হয়েছিল। মি. চ্যাটার্জী বলছেন, ‘আমাদের ১২৪ এ তে লাইফ সাজা দেয়া হয় এই কারণে যে ছত্রধর মাহাতো একটা মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এ রকম একটা স্টিল ছবি ছিল - ভিডিও রেকর্ডিং নয় কিন্তু। ভয়েস রেকর্ডিংও নেই। তো সেই স্টিল ছবি দেখেই জজের মনে হয়েছিল যে ছত্রধর রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক ভাষণ দিচ্ছে - তাতে তার যাবজ্জীবন সাজা হলো। আর আমরা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি অর্থাৎ আমরাও ষড়যন্ত্রের অংশীদার।’ মি. চ্যাটার্জী বলছেন ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গে তাদেরও সমান দোষে দোষী করে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছিল।

‘হাইকোর্ট থেকে আমরা ছাড়া পেলাম। সেখানে বিশেষ কিছু না বলেই সরকার পক্ষ জানায় যে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দাঁড়ায়নি। তাই বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে,’ বলেন প্রসূন চ্যাটার্জী। কিন্তু যখন মি. চ্যাটার্জী ছাড়া পেলেন, ততদিনে তার দশ বছরের থেকে এক মাস কম জেল খাটা হয়ে গেছে।
সুপ্রিম কোর্ট গত বৃহস্পতিবার যেসব মন্তব্য করেছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন নিয়ে, তাতে এও বলা হয়েছে যে, এই আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হারও খুবই কম। ‘আর্টিকেল ১৪’ নামে একটি আইনি অধিকার বিষয়ক ওয়েবসাইট হিসাব করে বলছে গত এক দশকে ৮১৬টি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে। তারা এটাও বলছে যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তার মধ্যে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতারা যেমন আছেন, তেমনই আছেন আন্দোলনকারী, ছাত্র, সাংবাদিক এমনকি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমও।

নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে যেমন রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার সংখ্যা বেড়েছে, তেমনই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো এ ধরনের মামলা দেয়ায় শীর্ষে রয়েছে বলেও ওই ওয়েবসাইটটি জানাচ্ছে। কলকাতা হাইকোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী ভারতী মুৎসুদ্দি বলছেন, ‘অনেক সময়েই আমাদেরও মনে এই প্রশ্নটা এসেছে, যেটা ছিল ইংরেজদের একটা হাতিয়ার ভারতকে পরাধীন করে রাখার, মানুষ যাতে মুখ খুলতে না পারে, নিজেদের স্বাধীনতা না চাইতে পারে, সেইরকম একটা আইনকে কেন ভারত সরকার রেখে দিয়েছিল!

‘বিশেষ করে বর্তমানে যে শাসনব্যবস্থার মধ্যে আমরা আছি, তারাও তো মানুষের কণ্ঠ রোধ করে দিতে চাইছে - কোনও প্রতিবাদ, অধিকারের কথা বলা, নিজেদের অসুবিধার কথা বলার যে অধিকার সংবিধান দিয়েছে, সেগুলোকেও তারা বন্ধ করে দিতে চাইছে,’ মন্তব্য করেন এই বর্ষীয়ান আইনজীবী।
একই ধারার অন্য আইন

সুপ্রিম কোর্ট সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ওই আইনটি কেন তুলে দেয়া হবে না।
তবে অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী ও নিজেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেল খেটে আসা প্রসূন চ্যাটার্জী বলছিলেন এই আইনটি তুলে দিলেও unlawful activities prevention act বা ইউএপিএ নামে যে সন্ত্রাস দমন আইন আছে, সেখানেও একই ধরনের ধারা রয়েছে।

‘এই যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ ঘোষণা, অর্থ সংগ্রহ, অস্ত্র সংগ্রহ এবং ভাষণ, কবিতা, গান, নাটক বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক প্রচার, এই যে ধারাগুলো- ঠিক এর সমকক্ষ ধারা কিন্তু ইউএপি এতেও আছে। ১৬ নম্বর থেকে ২০ নম্বর ধারায় এই একই ধরনের কথা লেখা আছে ইউএপিএ-তে।’
কিন্তু আদালত সরকারকে কোথাও বলেনি যে, এই ধারাকে বাতিল কর,’ বলছেন মি. চ্যাটার্জী।
সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন নিয়ে কড়া মন্তব্য করলেও এর আগে ১৯৬২ সালে কেদার নাথ সিং বনাম বিহার রাজ্যের মামলায় সর্বোচ্চ আদালতই বলেছিল যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারাটি সংবিধান সম্মত। গত বৃহস্পতিবারের মন্তব্যের পরে সেই রায় নিয়েও আলোচনা নতুন করে শুরু হবে বলেই আইনজীবীরা মনে করছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status