দেশ বিদেশ

নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক বাড়ছে শিশু মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার

১৭ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৮:৫৯ অপরাহ্ন

অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগজীবাণু ব্যাপকভাবে প্রতিরোধী হয়ে বাংলাদেশের শিশুদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ফলে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু ঘটছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এবং ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটালের (এমজিএইচ) গবেষকদের নতুন এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৫ই জুলাই আইসিডিডিআর,বির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গবেষণার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগজীবাণু প্রতিরোধী হয়ে উঠছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই গবেষণার ফলাফল ওপেন ফোরাম ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আইসিডিডিআর,বি’র নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস ডিভিশনের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ড. মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতি এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। যখন আইসিডিডিআর,বি’র হাসপাতালে অনেক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত কমবয়সী শিশু ভর্তি হচ্ছে, যারা উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার বিরুদ্ধে উচ্চ মাত্রায় প্রতিরোধী জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত, তখন এই গবেষণা পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। গবেষণার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক এবং শ্বাসতন্ত্রের উন্নততর চিকিৎসা সত্ত্বেও ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক ডজন শিশু নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের একটি সংক্রমণ যার ফলে এর বায়ু থলিগুলোতে তরল পদার্থ ও পুঁজ জমা হয় এবং এতে কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। কার্যকর চিকিৎসা ছাড়া এই সংক্রমণে প্রাণহানি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ নিউমোনিয়া। কমবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ভাইরাসের কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে, তবে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়ার কারণেও নিউমোনিয়া হতে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উচ্চ-আয়ের দেশে স্ট্যাফিলোকক্কাস (স্ট্যাফ), স্ট্রেপটোকক্কাস (স্ট্রেপ) এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার কারণ, যা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে উপশম হয়। শেষের দুটি জীবাণুর ক্ষেত্রে টিকা বিশ্বব্যাপী অসংখ্য জীবন রক্ষা করেছে। যখন ড. চিশতি এবং তার সহকর্মীরা ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পাঁচ বছরের কমবয়সী চার হাজারেরও বেশি শিশুর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রেকর্ড পরীক্ষা করলেন, তখন তারা দেখতে পেলেন ব্যাকটেরিয়াজনিত একদম ভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য স্থানে নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী সাধারণ স্ট্যাফ ও স্ট্রেপের কারণে সংঘটিত সংক্রমণের হার এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ছিল।
এসব শিশুর মধ্যে যাদের পজেটিভ কালচার ছিল তাদের মধ্যে গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া ৭৭ শতাংশ সংক্রমণের জন্য দায়ী ছিল, এসব জীবাণুর মধ্যে ছিল সিউডোমোনাস, ই. কোলাই এবং ক্লেবসিয়েলা। এই গবেষণার সহপ্রধান, লেখক ও ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল ফর চিলড্রেনের পেডিয়ট্রিক গ্লোবাল হেলথ্ বিভাগের প্রধান ড. জেসন হ্যারিস বলেন, বোস্টনে আমি যে কাজ করি তার থেকে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুর্ভাগ্যবশত এসব শিশুর মধ্যে আমরা যে গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দেখেছি সেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। এই গবেষণায় পাওয়া প্রায় ৪০ শতাংশ গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় সচরাচর ব্যবহৃত প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধকে প্রতিরোধ করে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, যেসব শিশুর ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ ছিল না তাদের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ১৭ গুণ বেশি ছিল। ড. হ্যারিস মনে করেন, এসব গবেষণালব্ধ ফলাফল সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এমন দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ এখন আর তাত্ত্বিক নয়, বরং এই সমস্যা এরইমধ্যে শেকড় গেড়ে বসেছে। তিনি আরও বলেন, এসব শিশু এরইমধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে অকালে মারা যাচ্ছে। একই কারণে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ভয়াবহ সংক্রমণের সৃষ্টি হবে। তার মতে, কোভিড-১৯ যদি একটি জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে, তবে উদ্ভবশীল অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের সমস্যা একটি বন্যার পানির মতো এবং বাংলাদেশের শিশুরা এরইমধ্যে এতে তলিয়ে যাচ্ছে।
আইসিডিডিআর,বি’র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও এই গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে যেসব কারণে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঘটনা ঘটছে সেগুলোর সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে যারা বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না তারা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনতে পারে এবং অনেক মানুষ আমাশয়, সর্দি, কাশি ও জ্বরের মতো সাধারণ অসুস্থতায় নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে নিজেদের চিকিৎসা করে থাকে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার বৃদ্ধি করে। তিনি আরও বলেন, আমরা হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের যথাযথ তত্ত্বাবধান, বিশেষ করে হাসপাতালে ভর্তি নেই এমন মানুষদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের উন্নয়ন সাধন করে এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ সংক্রান্ত সমস্যা হ্রাস করতে পারি। দেশে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ শনাক্ত করার মতো ল্যাবও অপ্রতুল। এ ছাড়া পরিষ্কার পানি ও সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারে বড় কারণ হিসেবে কাজ করে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status