বিশ্বজমিন

ভারতে মুসলিম নারীদের ‘নিলামে’ বিক্রির অ্যাপ, আতঙ্কে নারীরা

মানবজমিন ডেস্ক

১০ জুলাই ২০২১, শনিবার, ১০:৫৯ পূর্বাহ্ন

ভারতে মুসলিম নারীদের অবমাননার এক নতুন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। কয়েক ডজন মুসলিম যুবতী ও নারীর সম্মতি না নিয়েই তাদের ছবি ব্যবহার করে অনলাইনে তাদেরকে বিক্রি করে দেয়ার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন বাণিজ্যিক একটি বিমান সংস্থার একজন পাইলটও। এ তথ্য ফাঁস হওয়ার পর তাদের শিরদাড়া বেয়ে নামছে হিম আতঙ্ক। তবে অভিযোগ করার পর ওই অ্যাপ ও তাদের ওয়েবসাইট সাসপেন্ড করা হয়েছে। ঘটনার শিকার নারীরা ন্যায়বিচার দাবি করেছেন। এ নিয়ে অনলাইন বিবিসিতে রিপোর্ট লিখেছেন সাংবাদিক গীতা পান্ডে।

তিনি লিখেছেন, কয়েক ডজন নারী নিজেদেরকে এভাবে অনলাইনে আবিষ্কার করেন, যেখানে তাদেরকে বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক একজন পাইলট মিস হেনা খানের নাম রয়েছে। তিনি বলেছেন, একজন বন্ধু তাকে বিষয়টি অবহিত করেন টুইটে। ‘সুলি ডিলস’ নামের একটি অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট ব্যবহার করে এসব করা হয়। এসব অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে নারীদের ছবি ব্যবহার করে তাদের জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা হয় এবং তা প্রকাশ করা হয়। এসব নারীকে বর্ণনা করা হয় ‘ডিলস অব দ্য ডে’ হিসেবে।

সুলি ডিলস অ্যাপের প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যবহার করা হয়েছে একজন অজ্ঞাত নারীর ছবি। পরের দুটি পৃষ্ঠায় মিস হেনা খান দেখতে পেয়েছেন তার বন্ধুদের ছবি। এরপরের পেইজেই তিনি নিজের ছবি দেখতে পান। হেনা খান বলেন, ওই অ্যাপে আমি ৮৩টি নাম দেখতে পেয়েছি। সেখানে এর চেয়েও বেশি থাকতে পারে। তারা টুইটার থেকে আমার ছবি ও ইউজার নাম ব্যবহার করেছে। এই অ্যাপটি পরিচালনা করা হয় ২০ দিন ধরে। এমনকি এ বিষয়ে আমরা জানিও না। এখন এসব দেখে আমার শিরদাড়া বেয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে পুরো শরীরে।

এই অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ‘সুলি’ কিনতে প্রস্তাব দেয়া হয়। ‘সুলি’ শব্দটি মুসলিম নারীদের অবমাননা করতে অশ্লীলভাবে ব্যবহার করে ডানপন্থি হিন্দুরা। তবে ওই অ্যাপে বাস্তবে কোনো অকশন বা নিলাম হয়নি। এর উদ্দেশ্য শুধু অবমাননা এবং অপদস্ত করা। মিস হেনা খান বলেন, তাকে টার্গেট করা হয়েছে শুধু তার ধর্মের কারণে। তার ভাষায়, আমি একজন মুসলিম নারী। এটা তারা জানতে পেরেছে। তারা আমাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চায়।

গিটহাব- নামের ওয়েবপ্লাটফর্মটি এই অ্যাপের ওপেন সোর্স। অভিযোগ করার পরই তারা দ্রুততার সঙ্গে এটা বন্ধ করে দিয়েছে। কোম্পানি এক বিবৃতিতে বলেছে, এমন কর্মকা-ের বিষয়ে তদন্ত করে আমরা ইউজারদের একাউন্ট সাসপেন্ড করে দিয়েছি। কারণ, এমন কর্মকা- আমাদের নীতির লঙ্ঘন। কিন্তু এরই মধ্যে যে কা- ঘটে গেছে তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নারীরা। যাদের ছবি বা ফিচার ব্যবহার করা হয়েছে ওই অ্যাপে, তারা সবাই প্রতিবাদী মুসলিম নারী। এর মধ্যে আছেন সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, আর্টিস্ট ও গবেষক। তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তাদের একাউন্ট মুছে দিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, আরো হযরানি করার আতঙ্কে তারা আতঙ্কিত।

অন্য একজন নারী বলেছেন, আপনি যত শক্তিশালীই হোন না কেন। এসব ক্ষেত্রে তাতে কিছুই যায় আসে না। যদি আপনার ছবি ব্যবহার করা হয় এবং ব্যক্তিগত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়, তাতে আপনি ভীত হবেনই। কারণ, এতে আপনি বিরক্ত হবেন। অন্যদিকে যেসব নারীর ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য এভাবে ওই অ্যাপে প্রকাশ করা হয়েছে, এতে জড়িতদের খুঁজে বের করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোর দাবি জানিয়েছেন এবং তারা লড়াই করে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। ডজনখানেক নারী হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপ সৃষ্টি করেছেন ওই অপরাধী চক্রকে ধরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে এবং তাদেরকে সমর্থন করার জন্য। এর মধ্যে আছেন মিস হেনা খানও। তারা এ বিষয়ে পুলিশে অভিযোগও দিয়েছেন।

এই হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন সুপরিচিত নাগরিক, অধিকারকর্মী ও নেতারা। পুলিশ এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছে। তবে ওই অ্যাপের নেপথ্যে কে বা কারা আছে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। যারা এই অ্যাপ তৈরি করেছে, তারা নিজেদের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করেছে। কিন্তু বিরোধী কংগ্রেস দলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়ক সমন্বয়ক হাসিবা আমিন এর জন্য বেশ কিছু একাউন্টকে দায়ী করেছেন। এসব একাউন্ট থেকে নিয়মিত মুসলিমদের, বিশেষ করে মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হয়। একই সঙ্গে ওইসব একাউন্ট থেকে ডানপন্থি রাজনীতিতে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানানো হয়।


মিসেস আমিন বলেন, এটাই প্রথম এমন নয়। মুসলিম নারীদের এভাবেই টার্গেট করা হয়। ১৩ই মে মুসলিমরা যখন পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন, তখন ইউটিউবে একটি চ্যানেল চালু করা হয়। এর নাম দেয়া হয় ‘ইদ স্পেশাল’। এটি ভারত ও পাকিস্তানি মুসলিম নারীদের সরাসরি ‘নিলামে’ বিক্রির একটি প্লাটফর্ম বলে প্রচারণা চালানো হয়। মিস হেনা খান বলেন, এতে নারীদের শারীরিক গঠনের ওপর ভিত্তি করে তারা প্রতিজন নারীর মূল্য নির্ধারণ করে ৫ রুপি থেকে ১০ রুপি (৬৭ সেন্ট, ৪৮ সেন্ট)। এমনকি তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের বর্ণনা দেয়া হয়। হুমকি দেয়া হয় ধর্ষণের।

মিস আমিন বলেন, এর পরের দিন অজ্ঞাত একটি একাউন্ট থেকে তাকে টুইটারে নিলামে বিক্রির চেষ্টা করে। এতে অনেকের মধ্যে যোগ দেয় @সুলিডিলস১০১ নামের একটি একাউন্ট। এই একাউন্টটি বন্ধ রয়েছে। এই একাউন্ট থেকে আমাকে অবমাননা করার হুমকি দেয়া হয়। আমার শারীরিক গঠন নিয়ে লজ্জাকর কথা বলা হয়। একই সঙ্গে ভয়াবহ যৌনতার হুমকি দেয়া হয়। তিনি বিশ্বাস করেন, তাকে টুইটারে যারা নিলামে বিক্রির চেষ্টা করেছিল, তারাই সর্বশেষ সুলি ডিলস অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত এবং ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত।

গত সপ্তাহে টুইটার বেশ কিছু একাউন্ট সাসপেন্ড করেছে। অভিযোগ আছে, তারা এসব অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত। তারা শিগগিরই আবার আসার হুমকি দিয়েছে। অধিকারকর্মীরা বলেছেন, নারীদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে ভীতি প্রদর্শনের জন্য এসব করা হচ্ছে। তাই গত সপ্তাহে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের কমপক্ষে ২০০ অভিনেতা, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক এবং সরকারি কর্মকর্তা একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। এতে নারীর নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য ফেসবুক, গুগল, টিকটক এবং টুইটারের প্রধান নির্বাহীদের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

গত বছর ভারতে অনলাইনে হয়রানি নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তাতে দেখা যায়, যে নারী যত প্রতিবাদী, তাকে ততবেশি টার্গেট করা হয়। এক্ষেত্রে বৃটেনে এবং যুক্তরাষ্ট্রেও কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের বেশি টার্গেট করা হয়। ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অনগ্রসর সম্প্রদায়ের নারীরা বেশি টার্গেট হন। লেখক ও অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার সাবেক মুখপাত্র নাজিয়া ইরম বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব কম মুসলিম নারী আছেন। যারা আছেন, তাদের পিছনে অসৎ উদ্দেশের লোক লেগে থাকে। মিস আমিন বলেন, যারা এসব করছে তাদের কোনই ভয় নেই। কারণ, তারা জানে তাদেরকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের সমর্থকদের উৎসাহে কিছু নৃশংসতার কথা তুলে ধরেন তিনি। এর মধ্যে একজন মুসলিমকে পিটিয়ে মারা কারণে আটজন হিন্দুকে ফুলের মালা পরিয়েছেন একজন মন্ত্রী। নতুন সম্প্রচার বিষয়ক মন্ত্রীর গত বছর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। সেই ভিডিওতে তিনি মুসলিমদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখন যেসব নারীর পরিচয় ও ছবি নিয়ে সুলি ডিলস অ্যাপ চালু করা হয়েছিল তাদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া হয়ে পড়বে সুদূরপ্রসারী এবং কঠিন। যদি পুলিশ তাদেরকে খুঁজে না বের করে তাহলে আদালতে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন মিস হেনা খান। তিনি বলেছেন, আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status