বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮৫)

‘গণতন্ত্র বিনষ্টের জন্য রাজনৈতিক ব্যর্থতা সর্বাংশে সত্য নয়’

স্টাফ রিপোর্টার

২৫ জুন ২০২১, শুক্রবার, ১০:৫২ পূর্বাহ্ন

বৃহস্পতিবার ৯ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪৬
এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশকে ঘিরে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। গণতন্ত্রকে বিনষ্টের জন্য রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করা হলেও এটা সর্বাংশে সত্য নয়। গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য সংবাদপত্রের ভূমিকা, সিভিল সোসাইটি এবং সুপ্রীম কোর্টের ভূমিকাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। বাস্তবভিত্তিক যে কোনো বিশ্লেষণই দেখাতে পারে সমস্যা আসলে কত জটিল এবং তা করতে পারলেই আমরা ষড়যন্ত্রের গোড়া সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হতে পারবো।
আমাদের গৃহকর্মী, ১৬ বছর বয়সের মুনীর ফিরে আসেনি। তার বাবা-মা তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র ১৩ বছর বয়স্ক  গ্রামের এক মামাতো বোনের সাথে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে কেবল এ কারণে যে, মেয়েটি এখন মুনিরের বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারবে। বাচ্চা মেয়েটি এখন রান্নাবান্নার কাজ করে, আবার স্কুলেও যায়। এ মৌসুমে মুনিরের বাবা ৭ বিঘা জমি বর্গাচাষী হিসাবে চাষ করেছিল। কিন্তু ভাগ্য তাদের প্রতি সুপ্রসন্ন হয়নি। প্রবল বন্যায় ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কোনো ফসল তাদের ভাগ্যে জোটেনি, উপরন্তু তাদের বিনিয়োগ ও শ্রম বৃথা নষ্ট হয়েছে। ফলে বিরাট ক্ষতি হয়েছে পরিবারটির। এখন পরিবারটিকে না খেয়ে থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার জন্য মহাজনের কাছ থেকে ধার করা টাকা উচ্চহারে ৮০ শতাংশ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এখন মুনীরকে কাজ করতে হবে তার বাবার সাথে ক্ষেতেখামারে।

শুক্রবার ১০ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪৭
ইত্তেফাক-এর সালেহ উদ্দিন এবং আমার দেশ-এর নোমান জানিয়েছেন যে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এটিএম আমিন গুণ্ডাদের সর্দার, এখন আর ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান নন। গত ১৮ মাসে সকল অনাচার, দুষ্কর্ম, নির্যাতন, অত্যাচার, গ্রেফতার ও আটক- শত শত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের ওপর নির্যাতন তার তত্ত্বাবধানে এবং প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপেই সংঘটিত হয়েছে। তাকে প্রমোশন দিয়ে আনসার বাহিনীর মহাপরিচালক করা হয়েছে। সকল দুষ্কর্মের জন্য একদিন এই লোকটিকে শাস্তি পেতে হবে।
সারাদিন আমি পেটের ব্যথায় ভুগেছি। আজ সপ্তাহান্ত থাকায় ডাক্তারের দেখা পাওয়া যাবে না। কাল অবধি আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

শনিবার ১১ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪৮
ব্যারিস্টার খোকন এসেছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টের ভিত্তিতে এখন ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সাথে পরামর্শক্রমে আমার জন্য মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে জামিনের জন্য আবেদন করা হবে।
হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চগুলো এমন নগ্নভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে যে, নিম্নমানের বিচারপতিদের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহের বিচারের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রধান বিচারপতি সবাইকে হতাশ করেছেন। অদক্ষ ও অপরিপক্ক বিচারপতি যারা সহজেই সরকারের চাপে নত হয়ে পড়বেন তাদেরকে দেওয়া হয়েছে রীট ও ফৌজদারি মোশন মামলার ভার। হাইকোর্ট ডিভিশনেও সুবিচারের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।

রবিবার ১২ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪৯
যেসব লোক প্রতিনিয়ত সংবিধান লঙ্ঘন করে চলেছেন তাদের দ্বারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? উপরন্তু তারা যদি একটি পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো কিছু প্রত্যাশাই করা যাবে না। যে সামরিক বাহিনী একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে তারা তা বহাল রাখতে চাইবে। কেবলমাত্র জনগণের আন্দোলনের মুখে তাদের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যমেই এর সুরাহা হতে পারে। এমতাবস্থায় একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও জেনারেলদের বর্তমান কোটারী নিশ্চিত করতে চাইবে যে, তাদের কোনো ক্ষতি হবে না এবং নতুন সরকারের তাড়া খেয়ে বেড়াতে হবে না। এখন পর্যন্ত তাদের একটি অংশ সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতাভিষিক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা চাইছে সেনাবাহিনী প্রধানকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে একটি পার্লামেন্ট গঠন করা এবং একধরনের জাতীয় সরকার হবে, যেখানে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত থাকবে না। তারা আশা করছে যে, এতে বাংলাদেশ শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে এবং জনগণের জন্য একাধারে দুধ ও মধুর নহর বয়ে যাবে।
প্রফেসর সিরাজুল করিম ও প্রফেসর রায়হান আমাকে দেখতে এসেছিলেন এবং আমার উন্নতি পর্যবেক্ষণ করে জটিল অপারেশনের পর আমার অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সোমবার ১৩ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫০
পেটের ব্যথা আর নেই। এজন্য আরো পরীক্ষা করাতে হবে। রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে ওঠানামা করছে। প্রচুরসংখ্যক ওষুধ খেতে হচ্ছে ও দুর্বল বোধ করছি।
কাজের প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর ও সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জহিরুদ্দিন আহমেদ সৌজন্য সাক্ষাতে এসে আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। প্রস্টেট সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আনোয়ারুল ইসলাম এবং বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর নজরুল ইসলামও এসে আমাকে পরীক্ষা করে গেছেন। এই প্রফেসরদের সবাই অনেক ভালো ও অভিজ্ঞ। আমার জন্য তারা যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

মঙ্গলবার ১৪ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫১
হাসপাতালে সাধারণ সেবার মান খুবই করুণ। উদাহরণস্বরূপ আজ আমার আন্ট্রাসনোগ্রাম ও স্পেশাল ব্লাড টেস্ট হওয়ার কথা এবং সকালে আমার কোনো কিছু খাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কেউ আমাকে তা জানায়নি। ডাক্তার কিংবা নার্স কেউ না। দেশের সর্বোচ্চ মানের একটি হাসপাতালে আমার মতো একজন রোগীর যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে হাসপাতালে অন্যান্য সাধারণ রোগীদের বেলায় কী ঘটছে তা সহজেই অনুমেয়। সেবা ও সিস্টেমের মানের অভাবে লোকজন চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যায়। অন্যথায় আমাদের সবই আছে, কেবল নেই ব্যবস্থাপনা।
সারাদিন একজন নার্সও আমার অবস্থা নিয়ে কোনো খোঁজখবর করেনি। ঘরে কোনো কলবেল কিংবা ইন্টারকম সিস্টেম না থাকায় কোনো নার্স বা ডাক্তার ডাকাও সম্ভব নয়। এমনকি আমি ঠিকমতো ওষুধপত্র খাচ্ছি কি না তা চেক করতেও কেউ আসে না। অথচ আমাকে দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত নার্সের জন্য তা রুটিনমাফিক একটি কর্তব্য।
আমার রক্তচাপ অত্যন্ত অস্বাভাবিক হারে ওঠানামা করছে যার জন্য ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে। সারাদিন আমার ব্লাড প্রেসার চেক করার জন্য একজনও আসেনি। অথচ দিনে অন্তত দুবার প্রেসার পরীক্ষা করা নার্স ও ডাক্তারের রুটিন কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। এতে বোঝা যায়, এখানে ডাক্তাররা ভালো হলেও সেবার মান এবং ব্যাক-আপ সাপোর্ট সিস্টেম অত্যন্ত দুর্বল।
হাসপাতালের খাবার নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। হাসপাতালে অভিযোগ থাকার কথা নয়। গত আটদিন ধরে সবজির নামে সরবরাহ করা হচ্ছে শুধু বাঁধাকপি। রান্নার মান এতো নিম্ন যে, কোনো পশুও তা সহজে খেতে চাইবে না। কোনো রোগী এ ধরনের খাবার খেলে তাদের রোগ বরং আরো বেড়ে যাবে এবং স্বাস্থ্যহানি ঘটবে। কেবিনে অবস্থানরত একজন রোগীর বেলায়ই যদি এমনটি ঘটে, তাহলে সাধারণ ওয়ার্ডের রোগীদের কপালে কী জুটছে তা সহজেই অনুমেয়।
আমার সরকারি গাড়ির ড্রাইভার আবদুস সালাম এক রকম হঠাৎ করেই এসেছিল আমাকে দেখতে। প্রধানমন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতি থাকাকালসহ যখনই আমি সরকারে ছিলাম, সে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ড্রাইভার হিসেবে আমার কাজ করেছে। আমার সামনে বসে আজ বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ব্যারিস্টার খোকন হঠাৎ করে নতুন জটিলতার প্রেক্ষাপটে আমার জামিন আবেদন করার বিষয়ে পরামর্শ করতে এসেছিল।

বুধবার ১৫ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫২
যখনই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে বা টেস্ট করতে কেবিনের বাইরে যেতে হয়, তখন আমার জন্য একটা হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু আজ অনেকক্ষণ অবধি হুইলচেয়ার পাওয়া যায়নি।
পেট এখনো ভালো হয়নি। নানান রকম ওষুধ জটিলতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ভীষণ রকমের দুর্বল লাগে। আমার শরীর-স্বাস্থ্য আর যেন তা সহ্য করতে পারছে না।
হাসপাতালের খাবার খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। সকালে বাসি নাস্তা খেতে একরকম বাধ্য হলেও দুপুরের খাওয়া গুলশানের বাসা থেকে নিয়ে আসতে বলেছি।
ইত্তেফাক-এর সিনিয়র একজন রিপোর্টার সালেহউদ্দিন আমার সত্যিকারের শুভাকাক্সক্ষী। সে দেশের একজন অত্যন্ত মেধাবী সাংবাদিক, জ্ঞানসম্পন্ন এবং প্রচুর যোগাযোগ রাখে। অস্ট্রেলিয়া থেকে সে ফিরে এসেছে এবং নানাভাবে সাহায্য করছে আমাকে।
জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকায় লোকজনের ক্রয়ক্ষমতা কেবল কমেই চলেছে। যারা আগে তিনবার আহার করতো, তারা এখন খাচ্ছে দু’বেলা। যারা দু’বেলা আহার করতো তারা খাবার নিচ্ছে একবেলা। দিনে অন্তত একবার যাদের কপালে খাবার জুটতো, তারা এখন কোনো রকমে দু’দিনে একবেলা খাবার জোগাড় করতে পারছে। মোটকথা বিরাট সংখ্যার মানুষের খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। খাবার কেনার পরে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় আর কোনো কিছু কেনার সামর্থ্য তাদের থাকে না। নতুন কাপড়চোপড়, বিয়ে বা জন্মদিন উপলক্ষ্যে দেওয়া উপহার সামগ্রী কেনার পরিমাণ চরমভাবে হ্রাস পেয়েছে। সমাজের সর্বস্তরে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে অনুষ্ঠান, ভ্রমণ কিংবা যেকোনো ধরনের আমোদ-প্রমোদের মাত্রা অনেক কমে গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন এখন খুব কমই বেড়াতে যান অথবা তারা দাওয়াত এড়িয়ে চলেন। এমতাবস্থায় সবচাইতে করুণ অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন ঘরের গৃহকত্রীরা।

বৃহস্পতিবার ১৬ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫৩
এক অস্ত্র মামলায় সতের বছরের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর হয়তো খুব শিগগিরই জামিনে ছাড়া পাবে। প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে সে গতবার বিএনপি সরকারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারেক রহমান, কোকো ও খালেদা জিয়া এখন মুক্ত, হারিস চৌধুরীও একরকম মুক্তই, কারণ আইনের গণ্ডি এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। অথচ আমি আজও জেলখানায়।
হাসপাতালের খাবার খেতে হচ্ছে না বলে আমার অবস্থা এখন আগের চাইতে সামান্য ভালো। কেবল সকালে নাস্তার জন্য হাসপাতালের খাবারই খেতে হচ্ছে।
আমার পাণ্ডুলিপি সংশোধনীর কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। মাঝে-মধ্যে মনে হয় এত কষ্ট ও পরিশ্রম করে লেখার প্রয়োজনই বা কি? এগুলো পড়বে কারা? কীভাবেই বা এসব লেখা লোকজনের উপকারে আসবে? বাংলাদেশে লোকজনের পাঠ্যাভ্যাস দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন, এমনকি নেপালেরও নিচে।
আমার সুস্বাস্থ্য ও আশু মুক্তির জন্য চেম্বারের ফরিদ মিরপুর মাজারে এক দোয়া মাহফিল ও কাঙালি ভোজের ব্যবস্থা করেছিল।

(চলবে..)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status