বিশ্বজমিন

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত, নেপালের কূটনৈতিক, বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীদের হতাশা, প্রশ্ন

মানবজমিন ডেস্ক

২২ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ২:৪৩ অপরাহ্ন

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভোটে এবং তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ ৩৬ টি দেশ। এর ফলে নেপালে কূটনৈতিক মহল, বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের নেপাল সরকারের সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের সদস্য হওয়া সত্তে¡ও নেপাল ভোটদানে বিরত থাকার মাধ্যমে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে তার যে প্রতিশ্রæতি তা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। এ নিয়ে সব মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন কাঠমান্ডু পোস্ট।

সাংবাদিক অনীল গিরির লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রত্যাশা ছিল জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ১৯৩ সদস্যের সবাই সর্বসম্মত ভোট দেবে। কিন্তু প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ১১৯টি দেশ। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে একমাত্র বেলারুশ। ভোটদান থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, চীন, রাশিয়াসহ ৩৬টি দেশ। মিয়ানমারে সামরিক জান্তা যে নৃশংসতা চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে উত্থাপিত প্রস্তাব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে নেপাল। এতে নেপালের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।  

নেপাল যেহেতু বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদস্য, তাই তাদের এমন উদ্যোগ অনেককে বিস্মিত করেছে। এতে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে। তারা বলেছেন, এতে নেপালের বিশ্বাসযোগ্যতায় মারাত্মকভাবে আঘাত করতে পারে। জাতিসংঘের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কুল চন্দ্র গৌতম কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেছেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশই জাতিসংঘে ওই প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে। এই প্রস্তাবে নেপালের সমর্থন জানানোতে আপত্তি থাকার কিছুই নেই।

প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে নন-এলাইনড মুভমেন্ট এবং ৭৭টি উন্নয়নশীল দেশের গ্রুপ। ফেব্রুয়ারিতে যখন মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে তখন এর প্রেক্ষিতে নেপাল যে বিবৃতি দিয়েছে তাও অনেকে হতাশ হয়েছেন। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতি তাদের প্রতিশ্রæতির বিষয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুধু বলা হয়েছিল তারা মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখছে। একই সঙ্গে তারা অং সান সুচি ও অন্য নেতাদের মুক্তি দাবি করে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদস্য হওয়া সত্তে¡ও অতীতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নৃশংসতার বিষয়ে নেপাল এবারও তার চোখ বন্ধ করে আছে।

এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংসতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রস্তাব এনে ভোট দেয়া হয়। সেই সময়ও ভোটদানে বিরত ২৬টি দেশের মধ্যে ছিল নেপাল। এবার ১লা ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য নেপাল সরকারের ওপর চাপ ছিল। মিয়ানমারে সামরিক জান্তার নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে কাঠমান্ডুর রাস্তায় বিক্ষোভ করেন নাগরিক সমাজের সদস্যরা।
স্থানীয় মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এসিসট্যান্স এসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থান বিরোধীদের ওপর সামরিক জান্তার নৃশংসতায় কমপক্ষে ৮৭১ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন।

নেপালি একজন কূটনীতিক সরকারের নির্দেশনা সম্পর্কে জানেন। তিনি কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেছেন, বেশ কিছু কারণে নেপাল ভোটদানে বিরত ছিল এবং জাতিসংঘ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়নি। তিনি বলেছেন, প্রথমত- আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কা প্রস্তাবের ওপর ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে। দ্বিতীয়ত ভেটো দেয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি দেশ চীন এবং রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল। তৃতীয়ত থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ব্রুনেইয়ের মতো আসিয়ানের দেশগুলো ভোটদানে বিরত ছিল। এই ভোটদানে বিরত থাকার অর্থ হলো নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কূটনীতিক বলেন, যখন ভারত, চীন, রাশিয়া ও অন্যদেশগুলো ভোটদানে বিরত থাকে, তখন নেপালের ভোটদানে বিরত থাকার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। সর্বোপরি মিয়ানমারে বসবাসকারী প্রায় তিন লাখ নেপালি বংশোদ্ভূত মানুষের পরিণতির কথা আমাদেরকে চিন্তা করতে হয় এমন প্রস্তাবে। তাদের বিরুদ্ধে যদি মিয়ানমার সরকার কঠোর অবস্থা নেয় তাহলে তাদের কি হবে? সরকারের কর্মকর্তারাও ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তারাও বলেছেন, বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ভুটান, শ্রীলঙ্কার মতো আঞ্চলিক দেশগুলো যে অবস্থান নিয়েছে নেপালও একই অবস্থানে ছিল।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে ভোটদানে বিরত থাকা অর্থ নিরপেক্ষতা নিয়ে। নেপাল যেখানে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদস্য, সেখানে কিভাবে তারা নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে পারে? বিশেষ করে যখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রস্তাব এনে ভোট দেয়া হয়, তখন কিভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারে নেপাল। কুল চন্দ্র গৌতম বলেছেন, নেপাল বিবেকপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো আঞ্চলিক দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে বলেই নেপাল ভোটদানে বিরত থেকেছে। এখানে এমন যুক্তি আনা যেতে পারে না। সার্কভুক্ত দুটি দেশ আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ তো প্রস্তাবের ওপর ভোট দিয়েছে। আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম সহ ৬টি দেশ প্রস্তাবের ওপর ভোট দিয়েছে।

মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে শক্ত অবস্থান দেখানোর বড় একটি সুযোগ নেপাল নষ্ট করেছে। এটা নেপালের জন্য এক লজ্জা বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও গণতন্ত্রের অধিকারের পক্ষের লোকজন। অনেকেই বিশ্বাস করেন ভারত ও চীনের নির্দেশনায়ই ভোটদানে বিরত থেকেছে নেপাল। জাতিসংঘে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন একজন নেপালি কূটনীতিক বলেছেন, নেপাল হয়তো তার বৃহৎ দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারতের নির্দেশনা মতো পথ অবলম্বন করেছে। তাদেরকে অনুসরণ করেছে। এতে মনে হয়েছে, মূলনীতির চেয়ে নেপাল নিরাপদ অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেছে।

মিয়ানমারে চীনের নিজস্ব স্বার্থ আছে। তাই তারা ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। মিয়ানমারে ভারতেরও স্বার্থ আছে। এ জন্যই হয়তো তারা ভোটদানে বিরত থেকেছে। ভারত বলেছে, মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে তাদের সরাসরি অংশীদারিত্ব আছে। আঞ্চলিক সমীকরণে মিয়ানমার হলো ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। তাই তারা মিয়ানমারের জেনারেলদের সঙ্গে যোগাযোগ হারাতে চায় না। তাদেরকে ব্যবহার করে চীনকে টেক্কা দিতে চায় ভারত। ভারতের এই ভোটদানে বিরত থাকা নতুন কিছু নয়।

নেপালের ভোটদানে বিরত থাকায় বিস্মিত হয়েছেন নেপালের মানবাধিকারকর্মীরা। ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের সাবেক সদস্য মোহনা আনসারি বলেছেন, ভোটদানে নেপাল বিরত ছিল এটা জেনে আমি হতাশ। আমার শেষ কথা হলো ভারতের লাইন অনুসরণ করেছে নেপাল। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদস্য হওয়া সত্তে¡ও ওই প্রস্তাবে ভোট দেয়া থেকে নেপালের বিরত থাকাটা হতাশার। তিনি প্রশ্ন রাখেন, পরিষদের সদস্য হওয়ার ফলেও মানবাধিকারের পক্ষে যে প্রস্তাব তাতে কি ভোট দেয়া দায়িত্ব ছিল না নেপালের? তিনি আরো প্রশ্ন রাখেন, আমরা কি তাহলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সেখানে বেসামরিক জনগণের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেবো না? মানবাধিকার পরিষদের সদস্য হওয়ায় এত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নেপালের ন্যূনতম সততা রাখা উচিত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status