বই থেকে নেয়া
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮২)
‘বেগম জিয়াকে ঘিরে রাখা তোষামোদকারীদের দৌরাত্ম্যেই বিএনপির পতন সূচিত হয়েছে’
স্টাফ রিপোর্টার
২২ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১২:০৪ অপরাহ্ন

সোমবার ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৫
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমার পরে আরো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। হাইকোর্ট বিভাগ থেকে দেওয়া তার জামিন স্থগিত করে দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ।
আরেকভাবে বলা যায়, সরকার বাছাই করে করে জামিনের ওপর বিরোধিতা করে চলেছেন। এখন সরকার আর ঢালাওভাবে সকল জামিনের বিরুদ্ধাচরণ না করে আমার ও মোশাররফের জামিন ঠেকিয়ে যাচ্ছেন। আপিল বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এই ধরনের বৈষম্যমূলক আদেশ জারি করা হতো না। এখন যারা জেলে আছেন, তারা মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে জামিনের আবেদন জানাচ্ছেন। শেখ সেলিম জেলখানা থেকে স্থানান্তরিত হয়েছেন পিজি হাসপাতালে। আগামীকাল যাবেন আতিকুল্লাহ মাসুদ ও নাজমুল হুদা, ড. মোশাররফ চলে গেলে, বাকি থাকবো আমি। ২৬নং সেল চম্পাকলিতে আমি হবো নিঃসঙ্গ।
মঙ্গলবার ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৬
গতকাল হাইকোর্ট ডিভিশন আমার বিরুদ্ধে আনীত মামলার কার্যক্রম বন্ধ করে নতুন ফাইল করা দুটি মামলায় জামিন দিয়ে রুল ইস্যু করেছে। এর একটি হলো কর ফাঁকি ও আরেকটি এফডিআর-এ মিথ্যা তথ্যদানের মামলা। আসল ফলাফল জানা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। গতকাল রেডিওতে শুনেছি একটি মামলার কথা অথচ আজ খবরের কাগজে দেখা যাচ্ছে দুটি। এই সবই সম্ভব হয়েছে আল্লাহর অশেষ করুণায়। কঠোর পরিশ্রম করায় ব্যারিস্টার খোকন এবং ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি নিশ্চিত যে, সরকার আবার আপিল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে এর বিরুদ্ধে আপিল জানিয়ে আমার মুক্তির প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করবে।
আজ বেগম জিয়া গ্যাটকো ও নাইকো মামলায় জামিন পেয়েছেন। আপিল বিভাগে গিয়ে সরকার তাতে বাদ না সাধলে এবার তিনি মুক্তির স্বাদ নিতে পারবেন। তিনি মুক্তি পেলে রাজনীতি নিঃসন্দেহে নতুন মোড় নেবে।
মধ্যবিত্তদের একটি অংশ অত্যন্ত হীনমন্যতায় ভুগছেন এবং নীচ মনের পরিচয় দিচ্ছেন। তারা প্রকাশ্যভাবে রাজনীতিবিদদের জামিন হয়ে যাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। নিজেদের তারা শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী বলে মনে করেন অথচ তারা জানেন না যে, কারাগারে অন্তরীণ প্রতিটি নাগরিকের জন্য জামিন হলো একটি আইনগত অধিকার। দেশে জরুরি আইন না থাকলে অন্তরীণ প্রতিটি ব্যক্তি আদালতে উপস্থিত হওয়ার প্রথম দিনেই জামিন পেয়ে যেতেন।
আমাকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। ডা. হেলাল ও আমার নির্বাচনী এলাকার কয়েকজন কর্মী সেখানে গিয়েছিল আমার সাথে দেখা করতে, কিন্তু আমাকে তাদের সাথে আলাপের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
বুধবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৭
বেগম জিয়ার জামিনের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছে এবং সে আপিলের ওপর শুনানী হবে সোমবার। তবে এর আগেই তিনি মুক্তি পেয়ে গেলে আপিল এমনিতেই নাকচ হয়ে যাবে। সরকার চাইলে জেল কর্তৃপক্ষকে মুক্তির আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে বিলম্ব করার নির্দেশ দিতে পারেন, তবে তা ঘটবে বলে আমি মনে করি না। বেগম জিয়া অচিরেই মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। কেবলমাত্র জনগণকে দেখানোর জন্যই আপিলের আবেদন করা হয়েছে।
আমি হাজিরা দিতে গিয়েছিলাম নাইকো মামলায়। বেগম জিয়ার ফাইল করা আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটির কার্যক্রম হাইকোর্ট ডিভিশন ইতিমধ্যেই স্থগিত ঘোষণা করেছে।
বর্তমানে আমি জ্যেষ্ঠতম রাজনৈতিক বন্দী। কতদিন বন্দীজীবনে আমি টিকে থাকতে পারবো তা নির্ভর করছে আমার স্বাস্থ্যের ওপর।
দেশের সবচাইতে প্রতিশ্রুতিশীল গার্মেন্টস শিল্পখাত এখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন। অস্থিরতা ও সন্ত্রাসের কবলে ৪০ শতাংশ শিল্প আক্রান্ত ও বন্ধের সম্মুখীন। বিরাট সংখ্যার জনগণ মনে করেন যে, এই ধ্বংসের পেছনে রয়েছে এক ধরনের ষড়যন্ত্র এবং এর লক্ষ্য পার্শ্ববর্তী একটি দেশের জন্য বাইরের বাজার নিশ্চিত করা। বিদেশ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকেরা ফেরত আসছে বলে সৃষ্টি হচ্ছে আরেকটি সমস্যা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এই বৃহত্তম খাতের অবদান এখন দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনে দিনে চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতা ভরে থাকছে রাজধানীতে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, হাইজ্যাক ইত্যাদির খবর। গ্রামাঞ্চলে এই অরাজকতা আরো কয়েকগুণ বেশি। কারাগারে বন্দীদের ওপর চলছে নির্যাতন। ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে অব্যাহত গতিতে।
বৃহস্পতিবার ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৮
এক বছর সাত দিন শেরেবাংলা নগরের এক সাব-জেলে অন্তরীণ থাকার পর বেগম জিয়া সবকয়টি মামলায় জামিন পেয়ে আজ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। অর্ধেক শহর অচল করে দিয়ে হাজার হাজার লোক তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। জেল থেকে বের হয়ে তিনি প্রথমে যান শহীদ জিয়ার মাজারে। সেখান থেকে পিজি হাসপাতালে তার অসুস্থ ছেলের কাছে। বাসায় ফেরার আগে তিনি নয়া পল্টনে পার্টি অফিসে যাত্রাবিরতি করেন। প্রতিটি স্থানে অসংখ্য লোকজন তাকে স্বাগত জানায়।
শেখ হাসিনার মুক্তি ও তার যুক্তরাষ্ট্রে গমনের তুলনায় খালেদার মুক্তি ছিল অনেক বেশি মহিমান্বিত ও সম্মানজনক। সুপ্রীম কোর্টের জামিন প্রত্যাখ্যাত হবার পর সরকারের সাথে পেছনের দরজা দিয়ে দেনদরবার করে জেনারেলদের করুণায় প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন হাসিনা, আর খালেদা জিয়া যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়ায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছেন। হাসিনা জনগণের কাছে ভাবমূর্তি হারিয়েছেন, বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি বেড়েছে বহুগুণ। হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার নামে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে লন্ডন, কানাডা ও ফিনল্যান্ডে অবসর কাটাতে গিয়ে হাসির পাত্র হয়েছেন। দুয়েক দিনের মধ্যে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবে তারেক রহমান।
কর ফাঁকির মামলায় হাজিরা দিতে আমি গিয়েছিলাম কোর্টে। কিন্তু মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিচার এখনো শুরু হয়নি।
শুক্রবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৯
বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন যে, বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে এবং একইভাবে সাধারণ নির্বাচনেও অংশ নেবে। তবে তিনি জরুরি আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচন স্থগিত রাখার দাবি উত্থাপন করেছেন। অন্যদিকে তিনি এও ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন যে, এই মুহূর্তে তারেক রহমান কিছুদিনের জন্য তার চোখের আড়ালে থাকলেই ভালো হবে। এমনও হতে পারে তিনি জেনারেলদের সাথে এই সমঝোতা করেছিলেন যে, তারেক রহমান আপাতত নিজেকে রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং এ মর্মে তারেক রহমান কোনো সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকতে পারেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ও বাস্তবসম্মত। গতরাতে পরিবার নিয়ে তারেক রহমান লন্ডন চলে গেছে। এখন বেগম জিয়াকে তার পুত্রদের সঙ্গ-বর্জিত অবস্থায় একা একা থাকতে হবে। নিঃসন্দেহে এ ছিল খালেদা জিয়ার জন্য একটি বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত এবং একজন মায়ের চরম আত্মত্যাগ।
শনিবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫২০
জেল থেকে আমার মুক্তির বিষয়টি সরকারের জন্য একটি ইগো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেগম জিয়া এবং তার ছেলেদের মুক্তি দেওয়ার পর সরকার এখন আমাকে একহাত দেখে নিতে চাইছে। এটা হলো এক ধরনের দুঃখবাদী ক্ষণ-প্রক্রিয়া, এক ধরনের ঝধফরংস। তা না হলে কেন আমাকে বিনা কারণে শাস্তি দেওয়ার জন্য এমন আচরণ করা হবে?
ব্যারিস্টার খোকন, দুলি ও তার স্বামী ফাহমী এসেছিল আমাকে দেখতে।
রবিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫২১
এক বছর সাত মাস পরে আজ বিএনপির পল্টন কার্যালয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে সাইফুর রহমান এবং জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অবঃ) যারা বেগম জিয়াকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করার জন্য মান্নান ভাইয়ার সাথে যোগ দিয়েছিলেন, তারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সংলাপ এবং সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এখনো যারা মুক্তি পায়নি তাদের মুক্তির জন্য কোনো দাবি উত্থাপন করা হয়নি। আমি ও ড. মোশাররফ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী এবং বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনাও করেছি। সম্প্রতি সরকার ড. মোশাররফের স্ত্রীর নামে কর ফাঁকির নতুন একটি মামলা দায়ের করেছে। তার ছেলে ইতিমধ্যেই কারাভ্যন্তরে। জানি না বেগম জিয়া আমাদের মুক্তির ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা। আপাতত তার যা দরকার তা তিনি পেয়েছেন। তারেক রহমান ও কোকোকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য তাদের দেশের বাইরে যাবার অনুমতি তিনি আদায় করতে পেরেছেন।
আমি আগেই বলেছি, সব সাজাপ্রাপ্ত ও অভিযুক্ত রাজনীতিবিদই আমার আগে জেল থেকে নিষ্কৃতি পাবেন। এদের মধ্যে সত্যিকারের দুর্নীতিবাজরাও রয়েছেন। এভাবে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে গোটা অভিযানই ভেস্তে যেতে বসেছে। কমিশনের কখনো কোনো সৎ উদ্দেশ্য ছিল না। অন্যদিকে গোটা জাতি গত দুই বছরে অসীম দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে শুধুমাত্র এই জালেম সরকারের দুরাচারের কারণে।
সোমবার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫২২
স্ট্যান্ডিং কমিটির বিগত বৈঠকে তানভীর সিদ্দিকী বেগম জিয়াকে দলের আজীবন চেয়ারম্যান বানানোর প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রথমবারেই প্রস্তাবটি গ্রহণ না করা উচিত ছিল তার। আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাব দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির অন্যান্য সব সদস্যের সমর্থন পেয়েছিল। যেখানে দেশে ব্যাপকভাবে অভিযোগ রয়েছে যে, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই এবং দলের গণতন্ত্রায়নের জন্য সংস্কার প্রয়োজন, সেখানে এ ধরনের প্রস্তাব পাস হওয়াটাই অবাস্তব এবং অবিবেচনাপ্রসূত ছিল। এই নীচু মানসিকতা এবং বেগম জিয়ার চারপাশ ঘিরে রাখা তোষামোদকারীদের দৌরাত্ম্যেই বিএনপির পতন সূচিত হয়েছে।
সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনেক রকম সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এটা কি ধরনের নির্বাচন হবে? জেনারেলরা এ নিয়ে কী ভাবছেন? বর্তমান পরিস্থিতিতে কি জরুরি আইন প্রত্যাহার করা হবে? নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা কি অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে? সেনাবাহিনী কি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে? এগুলো দার্শনিক কোনো প্রশ্ন নয়, বরং সবটাই বাস্তবসম্মত। এসব প্রশ্নের সঠিক জবাবের ওপরই নির্বাচনের গুণগত মান ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্ভর করবে।
তারেক রহমান যখন বিদেশে, আমি ও ড. মোশাররফ জেলখানায় অন্তরীণ এবং সাইফুর রহমান ও মান্নান ভূঁইয়া বিদ্রোহী সেজেছেন, এই সংকটময় মুহূর্তে বেগম জিয়াকে পরামর্শ দেবেন কারা? কীভাবে বেগম জিয়া সবকিছু সামলাবেন? এ বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অনেক রাজনীতিবিদ যখন অনেক দিক দিয়েই বিপদগ্রস্ত এবং জরুরি আইনের বিধানবলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যেগ্যতা রাখে না, সেখানে দলের পক্ষে যোগ্য ৩০০ প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে? উপরন্তু, নির্বাচন কমিশনের আচরণ পুরোপুরি রহস্যজনক। তারা সকালে এক সুরে কথা বলেন, একই দিন বিকালে সেই সুর পাল্টিয়ে ফেলেন।
(চলবে..)
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমার পরে আরো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। হাইকোর্ট বিভাগ থেকে দেওয়া তার জামিন স্থগিত করে দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ।
আরেকভাবে বলা যায়, সরকার বাছাই করে করে জামিনের ওপর বিরোধিতা করে চলেছেন। এখন সরকার আর ঢালাওভাবে সকল জামিনের বিরুদ্ধাচরণ না করে আমার ও মোশাররফের জামিন ঠেকিয়ে যাচ্ছেন। আপিল বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এই ধরনের বৈষম্যমূলক আদেশ জারি করা হতো না। এখন যারা জেলে আছেন, তারা মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে জামিনের আবেদন জানাচ্ছেন। শেখ সেলিম জেলখানা থেকে স্থানান্তরিত হয়েছেন পিজি হাসপাতালে। আগামীকাল যাবেন আতিকুল্লাহ মাসুদ ও নাজমুল হুদা, ড. মোশাররফ চলে গেলে, বাকি থাকবো আমি। ২৬নং সেল চম্পাকলিতে আমি হবো নিঃসঙ্গ।
মঙ্গলবার ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৬
গতকাল হাইকোর্ট ডিভিশন আমার বিরুদ্ধে আনীত মামলার কার্যক্রম বন্ধ করে নতুন ফাইল করা দুটি মামলায় জামিন দিয়ে রুল ইস্যু করেছে। এর একটি হলো কর ফাঁকি ও আরেকটি এফডিআর-এ মিথ্যা তথ্যদানের মামলা। আসল ফলাফল জানা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। গতকাল রেডিওতে শুনেছি একটি মামলার কথা অথচ আজ খবরের কাগজে দেখা যাচ্ছে দুটি। এই সবই সম্ভব হয়েছে আল্লাহর অশেষ করুণায়। কঠোর পরিশ্রম করায় ব্যারিস্টার খোকন এবং ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি নিশ্চিত যে, সরকার আবার আপিল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে এর বিরুদ্ধে আপিল জানিয়ে আমার মুক্তির প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করবে।
আজ বেগম জিয়া গ্যাটকো ও নাইকো মামলায় জামিন পেয়েছেন। আপিল বিভাগে গিয়ে সরকার তাতে বাদ না সাধলে এবার তিনি মুক্তির স্বাদ নিতে পারবেন। তিনি মুক্তি পেলে রাজনীতি নিঃসন্দেহে নতুন মোড় নেবে।
মধ্যবিত্তদের একটি অংশ অত্যন্ত হীনমন্যতায় ভুগছেন এবং নীচ মনের পরিচয় দিচ্ছেন। তারা প্রকাশ্যভাবে রাজনীতিবিদদের জামিন হয়ে যাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। নিজেদের তারা শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী বলে মনে করেন অথচ তারা জানেন না যে, কারাগারে অন্তরীণ প্রতিটি নাগরিকের জন্য জামিন হলো একটি আইনগত অধিকার। দেশে জরুরি আইন না থাকলে অন্তরীণ প্রতিটি ব্যক্তি আদালতে উপস্থিত হওয়ার প্রথম দিনেই জামিন পেয়ে যেতেন।
আমাকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। ডা. হেলাল ও আমার নির্বাচনী এলাকার কয়েকজন কর্মী সেখানে গিয়েছিল আমার সাথে দেখা করতে, কিন্তু আমাকে তাদের সাথে আলাপের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
বুধবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৭
বেগম জিয়ার জামিনের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছে এবং সে আপিলের ওপর শুনানী হবে সোমবার। তবে এর আগেই তিনি মুক্তি পেয়ে গেলে আপিল এমনিতেই নাকচ হয়ে যাবে। সরকার চাইলে জেল কর্তৃপক্ষকে মুক্তির আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে বিলম্ব করার নির্দেশ দিতে পারেন, তবে তা ঘটবে বলে আমি মনে করি না। বেগম জিয়া অচিরেই মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। কেবলমাত্র জনগণকে দেখানোর জন্যই আপিলের আবেদন করা হয়েছে।
আমি হাজিরা দিতে গিয়েছিলাম নাইকো মামলায়। বেগম জিয়ার ফাইল করা আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটির কার্যক্রম হাইকোর্ট ডিভিশন ইতিমধ্যেই স্থগিত ঘোষণা করেছে।
বর্তমানে আমি জ্যেষ্ঠতম রাজনৈতিক বন্দী। কতদিন বন্দীজীবনে আমি টিকে থাকতে পারবো তা নির্ভর করছে আমার স্বাস্থ্যের ওপর।
দেশের সবচাইতে প্রতিশ্রুতিশীল গার্মেন্টস শিল্পখাত এখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন। অস্থিরতা ও সন্ত্রাসের কবলে ৪০ শতাংশ শিল্প আক্রান্ত ও বন্ধের সম্মুখীন। বিরাট সংখ্যার জনগণ মনে করেন যে, এই ধ্বংসের পেছনে রয়েছে এক ধরনের ষড়যন্ত্র এবং এর লক্ষ্য পার্শ্ববর্তী একটি দেশের জন্য বাইরের বাজার নিশ্চিত করা। বিদেশ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকেরা ফেরত আসছে বলে সৃষ্টি হচ্ছে আরেকটি সমস্যা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এই বৃহত্তম খাতের অবদান এখন দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনে দিনে চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতা ভরে থাকছে রাজধানীতে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, হাইজ্যাক ইত্যাদির খবর। গ্রামাঞ্চলে এই অরাজকতা আরো কয়েকগুণ বেশি। কারাগারে বন্দীদের ওপর চলছে নির্যাতন। ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে অব্যাহত গতিতে।
বৃহস্পতিবার ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৮
এক বছর সাত দিন শেরেবাংলা নগরের এক সাব-জেলে অন্তরীণ থাকার পর বেগম জিয়া সবকয়টি মামলায় জামিন পেয়ে আজ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। অর্ধেক শহর অচল করে দিয়ে হাজার হাজার লোক তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। জেল থেকে বের হয়ে তিনি প্রথমে যান শহীদ জিয়ার মাজারে। সেখান থেকে পিজি হাসপাতালে তার অসুস্থ ছেলের কাছে। বাসায় ফেরার আগে তিনি নয়া পল্টনে পার্টি অফিসে যাত্রাবিরতি করেন। প্রতিটি স্থানে অসংখ্য লোকজন তাকে স্বাগত জানায়।
শেখ হাসিনার মুক্তি ও তার যুক্তরাষ্ট্রে গমনের তুলনায় খালেদার মুক্তি ছিল অনেক বেশি মহিমান্বিত ও সম্মানজনক। সুপ্রীম কোর্টের জামিন প্রত্যাখ্যাত হবার পর সরকারের সাথে পেছনের দরজা দিয়ে দেনদরবার করে জেনারেলদের করুণায় প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন হাসিনা, আর খালেদা জিয়া যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়ায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছেন। হাসিনা জনগণের কাছে ভাবমূর্তি হারিয়েছেন, বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি বেড়েছে বহুগুণ। হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার নামে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে লন্ডন, কানাডা ও ফিনল্যান্ডে অবসর কাটাতে গিয়ে হাসির পাত্র হয়েছেন। দুয়েক দিনের মধ্যে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবে তারেক রহমান।
কর ফাঁকির মামলায় হাজিরা দিতে আমি গিয়েছিলাম কোর্টে। কিন্তু মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিচার এখনো শুরু হয়নি।
শুক্রবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫১৯
বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন যে, বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে এবং একইভাবে সাধারণ নির্বাচনেও অংশ নেবে। তবে তিনি জরুরি আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচন স্থগিত রাখার দাবি উত্থাপন করেছেন। অন্যদিকে তিনি এও ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন যে, এই মুহূর্তে তারেক রহমান কিছুদিনের জন্য তার চোখের আড়ালে থাকলেই ভালো হবে। এমনও হতে পারে তিনি জেনারেলদের সাথে এই সমঝোতা করেছিলেন যে, তারেক রহমান আপাতত নিজেকে রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং এ মর্মে তারেক রহমান কোনো সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকতে পারেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ও বাস্তবসম্মত। গতরাতে পরিবার নিয়ে তারেক রহমান লন্ডন চলে গেছে। এখন বেগম জিয়াকে তার পুত্রদের সঙ্গ-বর্জিত অবস্থায় একা একা থাকতে হবে। নিঃসন্দেহে এ ছিল খালেদা জিয়ার জন্য একটি বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত এবং একজন মায়ের চরম আত্মত্যাগ।
শনিবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫২০
জেল থেকে আমার মুক্তির বিষয়টি সরকারের জন্য একটি ইগো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেগম জিয়া এবং তার ছেলেদের মুক্তি দেওয়ার পর সরকার এখন আমাকে একহাত দেখে নিতে চাইছে। এটা হলো এক ধরনের দুঃখবাদী ক্ষণ-প্রক্রিয়া, এক ধরনের ঝধফরংস। তা না হলে কেন আমাকে বিনা কারণে শাস্তি দেওয়ার জন্য এমন আচরণ করা হবে?
ব্যারিস্টার খোকন, দুলি ও তার স্বামী ফাহমী এসেছিল আমাকে দেখতে।
রবিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫২১
এক বছর সাত মাস পরে আজ বিএনপির পল্টন কার্যালয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে সাইফুর রহমান এবং জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অবঃ) যারা বেগম জিয়াকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করার জন্য মান্নান ভাইয়ার সাথে যোগ দিয়েছিলেন, তারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সংলাপ এবং সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এখনো যারা মুক্তি পায়নি তাদের মুক্তির জন্য কোনো দাবি উত্থাপন করা হয়নি। আমি ও ড. মোশাররফ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী এবং বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনাও করেছি। সম্প্রতি সরকার ড. মোশাররফের স্ত্রীর নামে কর ফাঁকির নতুন একটি মামলা দায়ের করেছে। তার ছেলে ইতিমধ্যেই কারাভ্যন্তরে। জানি না বেগম জিয়া আমাদের মুক্তির ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা। আপাতত তার যা দরকার তা তিনি পেয়েছেন। তারেক রহমান ও কোকোকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য তাদের দেশের বাইরে যাবার অনুমতি তিনি আদায় করতে পেরেছেন।
আমি আগেই বলেছি, সব সাজাপ্রাপ্ত ও অভিযুক্ত রাজনীতিবিদই আমার আগে জেল থেকে নিষ্কৃতি পাবেন। এদের মধ্যে সত্যিকারের দুর্নীতিবাজরাও রয়েছেন। এভাবে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে গোটা অভিযানই ভেস্তে যেতে বসেছে। কমিশনের কখনো কোনো সৎ উদ্দেশ্য ছিল না। অন্যদিকে গোটা জাতি গত দুই বছরে অসীম দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে শুধুমাত্র এই জালেম সরকারের দুরাচারের কারণে।
সোমবার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫২২
স্ট্যান্ডিং কমিটির বিগত বৈঠকে তানভীর সিদ্দিকী বেগম জিয়াকে দলের আজীবন চেয়ারম্যান বানানোর প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রথমবারেই প্রস্তাবটি গ্রহণ না করা উচিত ছিল তার। আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাব দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির অন্যান্য সব সদস্যের সমর্থন পেয়েছিল। যেখানে দেশে ব্যাপকভাবে অভিযোগ রয়েছে যে, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই এবং দলের গণতন্ত্রায়নের জন্য সংস্কার প্রয়োজন, সেখানে এ ধরনের প্রস্তাব পাস হওয়াটাই অবাস্তব এবং অবিবেচনাপ্রসূত ছিল। এই নীচু মানসিকতা এবং বেগম জিয়ার চারপাশ ঘিরে রাখা তোষামোদকারীদের দৌরাত্ম্যেই বিএনপির পতন সূচিত হয়েছে।
সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনেক রকম সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এটা কি ধরনের নির্বাচন হবে? জেনারেলরা এ নিয়ে কী ভাবছেন? বর্তমান পরিস্থিতিতে কি জরুরি আইন প্রত্যাহার করা হবে? নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা কি অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে? সেনাবাহিনী কি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে? এগুলো দার্শনিক কোনো প্রশ্ন নয়, বরং সবটাই বাস্তবসম্মত। এসব প্রশ্নের সঠিক জবাবের ওপরই নির্বাচনের গুণগত মান ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্ভর করবে।
তারেক রহমান যখন বিদেশে, আমি ও ড. মোশাররফ জেলখানায় অন্তরীণ এবং সাইফুর রহমান ও মান্নান ভূঁইয়া বিদ্রোহী সেজেছেন, এই সংকটময় মুহূর্তে বেগম জিয়াকে পরামর্শ দেবেন কারা? কীভাবে বেগম জিয়া সবকিছু সামলাবেন? এ বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অনেক রাজনীতিবিদ যখন অনেক দিক দিয়েই বিপদগ্রস্ত এবং জরুরি আইনের বিধানবলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যেগ্যতা রাখে না, সেখানে দলের পক্ষে যোগ্য ৩০০ প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে? উপরন্তু, নির্বাচন কমিশনের আচরণ পুরোপুরি রহস্যজনক। তারা সকালে এক সুরে কথা বলেন, একই দিন বিকালে সেই সুর পাল্টিয়ে ফেলেন।
(চলবে..)