শেষের পাতা

কদমতলীতে তিন খুন

মুনের স্বামীকে ঘিরে রহস্য

শুভ্র দেব

২২ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:১৩ অপরাহ্ন

পুলিশের কাছে বাবা-মা ও ছোট বোনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে ঘাতক মেহজাবিন মুন। গত রোববার আদালত প্রাঙ্গণেও মুন সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, তিনজনকে সে একাই হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আর কেউ জড়িত নয়। তিন খুনের জন্য সে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়। পরিবারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। এ ছাড়া ছোট বোনের সঙ্গে তার স্বামীর পরকীয়া ছিল। তাই তাদেরকে হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। মুনের এমন স্বীকারোক্তির পরেও যেন রহস্য কাটছে না কদমতলীর তিন হত্যাকাণ্ডের। এ ঘটনায় ঘুরেফিরেই মুনের স্বামী শফিকুল ইসলামের নাম উঠে আসছে। মামলার বাদী মুনের চাচা, তার খালাসহ অন্য স্বজনরাও সন্দেহের তীর তুলেছেন শফিকুলের ওপর। স্বজনদের ধারণা মুনের বাবার সমস্ত সম্পত্তি একা ভোগ করার জন্য শফিকুল তার স্ত্রী মুনের সঙ্গে পরিকল্পনা করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পরিবারের ওপর আগে থেকে মুনের ক্ষোভ ছিল। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে শফিকুল। তবে পুলিশ বলছে, শফিকুলকে নিয়ে বেশকিছু অভিযোগ নিহতদের স্বজনরা করেছেন। শফিকুল অসুস্থ থাকায় তাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। কিছুটা সুস্থ হওয়াতে এখন পুলিশি হেফাজতে নিয়ে থাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই তিন খুনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মেহজাবিন মুন বাবা-মা ও ছোট বোনকে হত্যার দ্বায় স্বীকার করার পরেও শফিকুল ইসলামকে কেন মামলার আসামি করা হয়েছে? জানতে চাইলে ডিএমপির ওয়ারী জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ গতকাল মানবজমিনকে বলেন, কোথাও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি থানায় যে অভিযোগ দেন তাৎক্ষণিক সেটি ভেরিফাই করার সুযোগ থাকে না। কারণ এখানে একটা ইমোশন জড়িত থাকে। তারা যেভাবে এজাহার দেন সেভাবেই আমরা গ্রহণ করি। কিন্তু আমাদের কাছে সুযোগ থাকে পরবর্তীতে তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তি ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না সেটি জানার। এ কারণেই এজাহারে শফিকুলের নাম ছিল, আমরাও মামলা রেকর্ড করেছি। আমাদের তদন্তে যদি অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির যদি কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া না যায় তবে তাকে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়। শফিকুলের বিরুদ্ধে স্বজনদের করা অভিযোগ নিয়ে ডিসি বলেন, মুনের খালা ও মামলার বাদী অভিযোগ করেছেন মুন ও তার স্বামী শফিকুল সম্পত্তির হিসাব চেয়েছিল। এই হিসাব না দেয়ার জন্য হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ছাড়া মুনের ছোট বোনের সঙ্গে শফিকুলের অনৈতিক সম্পর্কেরও একটা অভিযোগ উঠেছে। আমরা সবগুলো বিষয় বিস্তর তদন্ত করে যাচাই-বাছাই করছি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও মুনের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজে বাধ্য করায় ছোট বেলা থেকে মায়ের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল মুন। প্রবাসী বাবাকে এ বিষয়ে অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার পায়নি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করা অনেকটা স্বাভাবিক হলেও মনের ভেতরে ক্ষোভ কমেনি। ওদিকে প্রবাসে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এমন খবরে বাবার ওপরে চটেছিল মুন। এসব ঘটনা ও শাসনহীন জীবনে খারাপ বন্ধুদের সঙ্গ অনেকটা বেপরোয়া করে তুলেছিল মুনকে। শফিকুলের সঙ্গে বিয়ের আগে আমিন নামে এক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তো সে। ওই শিক্ষক মেহজাবিনের সঙ্গে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক ও পরে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেন। বিষয়টি জানাজানি হয়েছিল সর্বত্র। পরে রাতারাতি শফিকুলের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয় মুনকে। কিন্তু বিয়ের পর শফিকুলও আমিনের বিষয়ে জেনে যান। তখন থেকে তার মনে সন্দেহ জন্মে। শফিকুলের ধারণা ছিল বিয়ের পরেও আমিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়মিত করে যাচ্ছে মুন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ ঝগড়াঝাটি হতো। মুনকে এ নিয়ে একাধিকবার মারপিটও করেছেন শফিকুল। ২০১৬ সালে আমিন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
মেহজাবিনের খালা ইয়াসমিন বলেন, আমিনকে হত্যার পর যে মামলা হয়েছিল শফিকুল, তার শাশুড়ি, খালা শাশুড়ি ও মুনকে আসামি করা হয়েছিল। শফিকুল সম্পত্তির লোভে তার শ্যালিকা জান্নাতুলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করেছিল। সেই সম্পর্ক শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়িয়েছিল। শফিকুল জান্নাতুলের বেশকিছু ভিডিও ধারণ করে রেখেছিল।
সে জান্নাতুলকে বলতো তার কথা না শুনলে ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দিবে। আর স্ত্রী মুনকে বলতো এসব বিষয় কাউকে বললে খুন করে ফেলবে। নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলারও হুমকি দিতো। অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে জান্নাতুলের সঙ্গে সম্পর্ক করে শফিকুল। তার উদ্দেশ্য ছিল নিজের কব্জায় দুই বোনকে রাখতে পারলে পুরো সম্পত্তির মালিক সে একাই হবে। এজন্য জান্নাতুলকে কোথাও বিয়ে দিতে রাজি হতো না শফিকুল। বিয়ের প্রস্তাব আসলে নানান কথা বলে ফিরিয়ে দিতো।
এদিকে মুনের একাধিক স্বজনরা আরও অভিযোগ করে বলেন, এ ঘটনা মুনের একার পক্ষে ঘটানো সম্ভব না। কারণ শুধু মুনের ক্ষোভই ছিল না নিহতদের ওপর। নানা কারণে শফিকুলেরও ক্ষোভ ছিল। আমিন হত্যা মামলার সমাধানের জন্য নিহত মাসুদ রানার কাছে বিশ লাখ টাকা চেয়েছিল শফিকুল। সে টাকা তাকে দেয়া হয়নি। সম্পত্তির হিসাব চেয়েও পায়নি। শ্যালিকা জান্নাতুলকে পরিবারের লোকজন বুঝিয়ে শুনিয়ে অনৈতিক সম্পর্কের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। সবমিলিয়ে শফিকুলের মনেও একটা চাপা ক্ষোভ ছিল। আর সেটি মুনকে কাজে লাগিয়ে সে বাস্তবায়ন করে থাকতে পারেন। স্বজনরা আরও বলেছেন, বিষাক্ত দ্রব্য খেয়ে মুনের মা, বাবা ও ছোট বোন মারা গেল। অথচ শফিকুল ও তার মেয়ের তেমন কিছু হয়নি। এটি তাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। কারণ ওই তিনজনকে হত্যা করলে পুরো সম্পত্তি তাদের হতো। এমন ধারণা থেকেই হয়তো এটি তারা পরিকল্পিতভাবে করেছে। এজন্য স্বজনরা শফিকুলের পূর্ব কর্মকাণ্ড ও গতিবিধির কথা বিবেচনা করেই মামলায় শফিকুলকে আসামি করেছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status