বাংলারজমিন

বাজার ফান্ডের ভূমি রেজিঃ স্থগিত, ব্যাংক ঋণ বন্ধে দিশাহারা পাহাড়ের অর্থনীতি

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি থেকে

২০ জুন ২০২১, রবিবার, ৯:৩৭ অপরাহ্ন

ব্যাংক ঋণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ৩ পার্বত্য জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব পড়েছে। অলিখিতভাবে জেলা প্রশাসক কার্যালয় ভূমি বন্ধকের অনুমতি আটকে রাখায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ভূমি রেজিস্ট্রেশনের মিউটেশন ও মিস মামলার কার্যক্রম। ফলে রাঙামাটিতেই প্রায় ৩ শতাধিক মিউট ও মিস মামলার নিষ্পত্তি আটকে গেছে। বিষয়টিকে ব্যবসায়ীরা ‘আমলাতান্ত্রিক ইগো’ হিসেবে উল্লেখ করে এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমি রেজিস্ট্রেশন জটিলতায় প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ৩ জেলায় অন্তত ১৩০-১৪০ কোটি টাকার ঋণ কার্যক্রম আটকে গেছে। রাঙামাটির বাজার ফান্ড এলাকাগুলোতেই ৫০ কোটি টাকার ঋণ কার্যক্রম আটকে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এ তথ্য জানিয়েছে। এদিকে, ঋণ নিতে না পেরে ইতিমধ্যে এ জেলার অন্তত ৪০ জন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এমন অভিযোগ রাঙামাটি চেম্বার নেতৃবৃন্দের। জেলার ১৭টি ব্যাংকের একাধিক ম্যানেজার জানিয়েছেন, জটিলতার কারণে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতি হারাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সরকারি জমি বাজার ফান্ডের অন্তর্ভুক্ত করে যথাযথ নিয়মানুসারে নাগরিকদের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেয়া হলেও রহস্যজনকভাবে খাগড়াছড়ির ডিসি এসব জমিকে খাসজমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এক ব্যাংক কর্মকর্তার দাবি, ডিসি আইনের কিছু ধারা পড়েছেন, আর কিছু ধারা পড়েননি। ফলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ১২ ধারা (২) মোতাবেক ব্যাংকের সঙ্গে ঋণগ্রহীতার চুক্তিনামা রেজিস্ট্রেশনের এখতিয়ার পার্বত্য জেলা প্রশাসকগণের। অবশিষ্ট ৬১ জেলায় ব্যাংক ঋণের জন্য সাব-রেজিস্ট্রারের অনাপত্তিই যথেষ্ট। কিন্তু পাহাড়ে জেলা প্রশাসকের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে চুক্তি হয় এবং সেই চুক্তি তারই একজন ম্যাজিস্ট্রেট রেজিস্ট্রারভুক্ত করেন। ২০১৭ সালে রাঙামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান প্রথমে এই প্রক্রিয়ার ওপর প্রশ্ন তুলে ঋণ চুক্তি অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে নানা দেন-দরবারের পর তা খুলে দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ জানান, ‘২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো বাজার ফান্ড এলাকায় ভূমি রেজিস্ট্রির মিউটেশন ও মিস মামলাগুলোর নিষ্পত্তি স্থগিত করা হয়।  পরবর্তীতে চাপে পড়ে ডিসি মানজারুল মান্নান রাঙামাটি চেম্বারের ৫ জন পরিচালককে তার কার্যালয়ে ডেকে নেন। তিনি আমাদেরকে ভিক্ষুক ফান্ডে অনুদানের শর্তে মিউট ও মিস মামলা নিষ্পত্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার আশ্বাস দেন। শর্তানুযায়ী আমরা ভিক্ষুক ফান্ডে অনুদান প্রদান করি এবং প্রক্রিয়াটি চালু হয়। দুর্ভাগ্যবশত: তার কিছুদিন পর তিনি বদলি হয়ে যান। পরবর্তী ডিসি মামুনুর রশিদ ২০১৯ সালের দিকে বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের বরাত দিয়ে রাঙামাটির বাজার ফান্ড এলাকার জমির ঋণ অনুমোদন কার্যক্রম বন্ধ করেন। এতে ঋণ প্রক্রিয়া আটকে যায়। রাঙামাটির অন্তত ২ হাজার ছোট বড় ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী পথে বসে যান।
জানা গেছে, রাঙামাটির এমপি সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে একাধিকবার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদকে তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসি মানজারুল মান্নানের সূত্র ধরেই খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক ঋণ প্রস্তাবনা অনুমোদন ও রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। জেলা প্রশাসনের তহবিলে টাকা জমা দেয়ার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাজার ফান্ড এলাকায় বন্দোবস্ত দেয়া জমিকে খাসজমি উল্লেখ করেন। ওইসব জমির বিপরীতে ঋণ প্রদানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চেয়ে চিঠি দেন। এর প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়েল উপ-সচিব আসমা তাসকিন ৩ পার্বত্য জেলা পরিষদের মতামত চেয়ে চিঠি দেন। ওই চিঠির আলোকে রাঙামাটি জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা বিষয়টিকে জনগুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ইতিবাচক মতামত দেন। খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তথা বাজার ফান্ড প্রশাসক কংজরি চৌধুরীও (তৎকালীন) ২০২০ সালের ৮ই জানুয়ারি পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া চিঠির জবাব দেন। জেলা প্রশাসক- ‘আইনের অধীনে বন্দোবস্ত দেয়া ভূমিকে খাসজমি’ হিসেবে অভিহিত করার বিষয়টি দুঃখজনক হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। এমন বাধ্যকতা আরোপ করা হলে এলাকার জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবে বলেও মন্তব্য করেন কংজরি। তবে বিষয়টি আর এগোয়নি।
এ বিষয়ে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ব্যাংক ঋণচুক্তি অনুমোদন ও নবায়ন প্রক্রিয়া ৩ পার্বত্য জেলাতেই বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। ভূমি মন্ত্রণালয় আমাদেরকে করণীয় নির্ধারণে অবহিত করার কথা। কিন্তু তেমন কোনো নির্দেশনা এখনও আসেনি। তিনি বলেন, আমি যোগদানের পর বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক খোঁজখবর নিয়েছি। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতার বিষয়টি আমার গোচরে নেই। প্রয়োজনে বিষয়টি নিয়ে আবারও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status