শেষের পাতা

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৫২৯১ কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৯ জুন ২০২১, শনিবার, ৯:০২ অপরাহ্ন

নাম-পরিচয় গোপন রেখে অর্থ জমা রাখার জন্য ধনীদের আকর্ষণীয় গন্তব্য হলো সুইজারল্যান্ড। সুইস ব্যাংকে থাকা এই অর্থের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। নাম-পরিচয় গোপন থাকায় সুইস ব্যাংকগুলোতে সারা বিশ্ব থেকেই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ রাখা হয়। সুইজারল্যান্ডের সংবিধান এবং ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী, সেখানে ব্যাংক গ্রাহকদের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। তবে ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর হওয়ার পর বার্ষিক ভিত্তিতে জমা টাকার হিসাব দিচ্ছে সুইজারল্যান্ড। বছর ভিত্তিতে কোন দেশের কত টাকা জমা আছে, সে তথ্য তারা প্রকাশ করছে। তবে কারো ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা হয় না।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সাল শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ আগের বছরের ৬০ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক থেকে কমে ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক হয়েছে। দেশীয় মুদ্রায় যা ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯৪ টাকা হিসাবে)। তবে আগের বছরের চেয়ে এ আমানত ৩৭৬ কোটি টাকা কমেছে। অর্থাৎ ২০১৯ সালে যা ছিল ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। এই নিয়ে পরপর তিন বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ কমলো। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২০’- বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ, ২০১৮ সাল শেষে এই অর্থের পরিমাণ কমে হয় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। ২০১৯ সালে দাঁড়ায় ৬০ কোটি ৩০ লাখে। ২০২০ সাল শেষে হলো ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। তবে ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানুষের কমলেও সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে। ২০২০ সাল শেষে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ২৬০ কোটি সুইস ফ্রাঁ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৮৯ কোটি ৯০ লাখ। পাকিস্তানের আমানতও বেড়েছে ৭৭.৮ শতাংশ, হয়েছে ৬৪ কোটি সুইস ফ্রাঁ।
সুইজারল্যান্ডের ২৪৩টি ব্যাংকের যে হিসাব দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে, তাতে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ৩৭৭ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ। এর পরের অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জমার পরিমাণ ১৫২ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ। তালিকায় এর পরে রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ফ্রান্স, হংকং, জার্মানি, সিঙ্গাপুর ও লুক্সেমবার্গের নাম।
অর্থনীতিবিদরা জানান, বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া অর্থ যেমন সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। তাই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের মোট অর্থের মধ্যে বৈধ-অবৈধ সব অর্থই রয়েছে। সাধারণত কেউ অর্থ পাচার করছেন আন্ডার-ইনভয়েসিং (দাম কম দেখিয়ে পণ্য রপ্তানি) এবং ওভার-ইনভয়েসিংয়ের (আমদানিতে দাম বেশি দেখিয়ে) নামে। কেউ পাচার করেন অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যাংক থেকে অর্থ লুট, জালিয়াতি এবং বিভিন্ন অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা পাচার হচ্ছে। তবে অর্থ পাচারের অধিকাংশই বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে। আর বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশ থেকে এ অর্থপাচার হচ্ছে। মীর্জ্জা আজিজ বলেন, টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশিদের আমানত: ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে যা ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৮ সালে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি ০৮ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্র্যাংক। স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না। এছাড়া ২০১০ সালে ছিল ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্রাংক, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৭ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৪ সালে ৪ কোটি ১০ লাখ, ২০০৩ সালে ৩ কোটি ৯০ লাখ ফ্রাংক এবং ২০০২ সালে ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ ফ্রাংক।
মোট আমানত: প্রতিবেদন অনুসারে আলোচ্য সময়ে বিশ্বের সব দেশের আমানত বেড়েছে। আলোচ্য বছরে সুইজারল্যান্ডের ২৫৬টি ব্যাংকে আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি ফ্রাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ফ্রাংক। এ হিসাবে ১ বছরে আমানত কমেছে ৬ হাজার কোটি ফ্রাংক। এছাড়া ২০১৮ সালে যা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি ফ্রাংক। ২০১৭ সালে ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি ফ্রাংক।
অন্যদিকে গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে। ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। একক বছর হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা।

টাকা পাচারের তথ্য এসেছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি’র রিপোর্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে।
দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পুরোটাই পাচার নয়। এখানে বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের বৈধ কিছু অর্থ থাকতে পারে। তবে এ অর্থের সিংহভাগই কালোটাকা। কারা এ অর্থ নিয়েছে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা উদ্যোগ নিলে সুইস ব্যাংক এ তথ্য দেবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status