মত-মতান্তর
নগরের নান্দনিক বিভা
ড. মাহফুজ পারভেজ
১৮ জুন ২০২১, শুক্রবার, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন
ইরানের নান্দনিক নগর স্থাপনা।
'গ্রিন সিটি', 'হেলদি সিটি', 'কালচারাল সিটি' ইত্যাদি প্রজেক্টের কথা প্রায়শই উচ্চারিত হয় উন্নত নগরায়নের প্রসঙ্গে। সবুজ প্রকৃতি, শিল্প ও সাহিত্য-বান্ধব নগরই একবিংশ শতকের প্রযুক্তি তাড়িত বিশ্ববাসীর কাছে প্রত্যাশিত। এজন্য বৈশ্বিক নগরগুলোতে উদ্যান ও বৃক্ষায়নের পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয় শিল্প ও সাহিত্যের নান্দনিক বিষয়সমূহ।
এজন্যই উন্নত, অগ্রসর ও পরিকল্পিত নগরে বাগান, পুষ্পায়নের পাশে সুন্দর সুন্দর নামকরণ হয় সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্যিকের নামে। রাজধানী ঢাকার বাসাবো-শাহজানপুরে কবি জসীমউদদীন সড়ক রয়েছে কবির বসবাসের স্মৃতি নিয়ে। ঢাকার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সাবেক ময়মনসিংহ রোডের নামও রাখা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে।
পাশের দেশের কলকাতাতেও বিমানবন্দর থেকে দমদম হয়ে শহরের প্রধান রাস্তার নাম কাজী নজরুল ইসলামের নামে। রবীন্দ্রনাথের নামে সড়ক ছাড়াও সেতু, সরোবর আছে কলকাতায়। সেখানে পার্ক সার্কাসের ঐতিহাসিক থিয়েটার রোডের নামও বদলে রাখা হয়েছে শেকসপিয়ারের নামে। বিখ্যাত বিধান সরণির পাশেই ছোট্ট একটা রাস্তা, যার নাম বিশ্বকোষ লেন।
ইংল্যান্ডে নেইল গেইম্যানের লেখা বইয়ের নামানুসারে সাউথসির একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘দ্য ওশান অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য লেন’। এমন দৃষ্টান্ত আরও অনেক আছে ইউরোপের দেশে দেশে। লোরকা'র নামে ট্রেন, বোদলেয়ারের নামে স্টেশন, সার্ত্রের নামে উদ্যান, শেলী, মিল্টন বা কীটসের নামেও বিভিন্ন নগরে রয়েছে নানা স্থাপনা। জেমস জয়েসের ধ্রুপদী উপন্যাস 'ইউলিসি'র চরিত্রের মর্যাদা পেয়েছে ডাবলিন শহরের বহু রাস্তা, এলাকা ও দ্রষ্টব্য।
তবে সুবিন্যস্ত নগরায়ন, পুষ্পের বাহার ও সাহিত্যিক দ্যোতনায় সব দেশকে টেক্কা দিয়েছে প্রাচীন পারস্য তথা আজকের ইরান। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর, আকর্ষণীয়, মনমুগ্ধকর, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থানে পরিপূর্ণ ইরানকে বলা হয় 'সাংস্কৃতিক মাধুর্য'র দেশ। 'সভ্যতার দোলনা' নামে খ্যাত ইরানে রয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত ২৩টি স্থাপনা। বিশ্বে আর কোনও দেশে এতো ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গৌরব নেই, যা আছে ইরানে।
ইরানের জনজীবনে, এমনকি পথেঘাটে দেখা যাবে উচ্চতর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। ধরা যাক ইরানের কোনও এক রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। হঠাৎই যেতে যেতে এক পথযাত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট'র কাছে কীভাবে পৌঁছাব?’ সাগ্রহে লোকটি প্রত্যুত্তর দেবেন, ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড' শেষ করে 'দ্য গ্রিন মাইল'। তারপরেই 'দ্য অ্যালকেমিস্ট!’
মনে হবে, নিশ্চয়ই এই কথোপকথন দুই বইপাগলের, নয় তো নিতান্তই হেঁয়ালি? না, আসলে মোটেও তা নয়। বরং অতি বাস্তব ঘটনা। ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’, ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড’ বা ‘দ্য গ্রিন মাইল’— এসবই বিশ্ববিশ্রুত সাহিত্যের শিরোনামে রাস্তার নাম রয়েছে সেখানে।
পশ্চিম-মধ্য ইরানের হামাজান প্রদেশের ছোট্ট শহর তাজবাদ সোফলা, যা স্থানীয় মানুষদের কাছে রসুলবাদ বলে পরিচিত এক জনবসতি। ঘটনাটি সেখানকার। সেখানে গোটা অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল মধ্যযুগীয় স্থাপত্য, নির্মাণ। ছোটো ছোটো টিলার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ছবির মতো রাস্তা। দু’ধারে বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি। এমন জায়গা পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ ক্ষেত্র হবে— তাতে আর নতুন কী? কিন্তু এলাকাবাসীদের সাংস্কৃতিক উচ্চতার জন্যেও অঞ্চলটির বেশ আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে।
জনসংখ্যা একেবারে অল্প হলেও, গ্রামের সকলেই আদ্যন্ত বইপাগল। শুধু ইরানি/ফারসি কিংবা আরবি নয়— সমস্ত ভাষার বই-ই সমান প্রধান্য পায় এই ছোট্ট জনবসতিতে। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারের জন্য রয়েছে একটা আস্ত লাইব্রেরিও। সেখানে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন ভাষার প্রায় ৬ হাজার বইয়ের সংগ্রহ। ভাঁটা পড়ে না পড়ুয়াদের ভিড়ও। আর পর্যটকরাও আসেন প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক মাধুর্যের টানে মিছিল করে।
নিজেদের এলাকাটি বইপ্রেমী এবং ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যানুযায়ী গড়ে তুলতে অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছিল গ্রামবাসীরা। বছর দুয়েক আগের কথা। ২০১৯ সালে রসুলবাদের বাসিন্দারা ঠিক করেছিল গ্রামের সমস্ত রাস্তার আবার নতুন করে নামকরণ করা হবে। আর সেই নাম হবে বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন বইয়ের নামে।
কিন্তু বিশ্বের সেরা সাহিত্যের তালিকা প্রস্তুত করা তো মুখের কথা নয়। প্রত্যেকের পছন্দ যে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। এতএব উপায়? শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাভুটির মাধ্যমেই ঠিক করা হয় ৩০টির রাস্তার নাম। এবং আশ্চর্যের বিষয় কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট গল্পের চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবিক মিল রয়েছে শহরের রাস্তাগুলোর।
নামগুলো মধ্যে রয়েছে ফারসি কবি শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’ ও ‘বোস্তা’, পাওলো কয়েলহোর ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’, স্টিফেন কিং-এর ‘দ্য গ্রিন মাইল’, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড’, ফরাসি সাহিত্যিক অ্যান্টোনিও দে সেন্টের ‘দ্য লিটল প্রিন্স’-সহ একাধিক বিশ্বমানের সাহিত্যগ্রন্থ।
এমন নগরের নান্দনিক বিভা তো ছড়াবেই। জনপদের সৌরভ মৌ মৌ করবেই দেশ পেরিয়ে বিশ্বময়।
এজন্যই উন্নত, অগ্রসর ও পরিকল্পিত নগরে বাগান, পুষ্পায়নের পাশে সুন্দর সুন্দর নামকরণ হয় সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্যিকের নামে। রাজধানী ঢাকার বাসাবো-শাহজানপুরে কবি জসীমউদদীন সড়ক রয়েছে কবির বসবাসের স্মৃতি নিয়ে। ঢাকার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সাবেক ময়মনসিংহ রোডের নামও রাখা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে।
পাশের দেশের কলকাতাতেও বিমানবন্দর থেকে দমদম হয়ে শহরের প্রধান রাস্তার নাম কাজী নজরুল ইসলামের নামে। রবীন্দ্রনাথের নামে সড়ক ছাড়াও সেতু, সরোবর আছে কলকাতায়। সেখানে পার্ক সার্কাসের ঐতিহাসিক থিয়েটার রোডের নামও বদলে রাখা হয়েছে শেকসপিয়ারের নামে। বিখ্যাত বিধান সরণির পাশেই ছোট্ট একটা রাস্তা, যার নাম বিশ্বকোষ লেন।
ইংল্যান্ডে নেইল গেইম্যানের লেখা বইয়ের নামানুসারে সাউথসির একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘দ্য ওশান অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য লেন’। এমন দৃষ্টান্ত আরও অনেক আছে ইউরোপের দেশে দেশে। লোরকা'র নামে ট্রেন, বোদলেয়ারের নামে স্টেশন, সার্ত্রের নামে উদ্যান, শেলী, মিল্টন বা কীটসের নামেও বিভিন্ন নগরে রয়েছে নানা স্থাপনা। জেমস জয়েসের ধ্রুপদী উপন্যাস 'ইউলিসি'র চরিত্রের মর্যাদা পেয়েছে ডাবলিন শহরের বহু রাস্তা, এলাকা ও দ্রষ্টব্য।
তবে সুবিন্যস্ত নগরায়ন, পুষ্পের বাহার ও সাহিত্যিক দ্যোতনায় সব দেশকে টেক্কা দিয়েছে প্রাচীন পারস্য তথা আজকের ইরান। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর, আকর্ষণীয়, মনমুগ্ধকর, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থানে পরিপূর্ণ ইরানকে বলা হয় 'সাংস্কৃতিক মাধুর্য'র দেশ। 'সভ্যতার দোলনা' নামে খ্যাত ইরানে রয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত ২৩টি স্থাপনা। বিশ্বে আর কোনও দেশে এতো ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গৌরব নেই, যা আছে ইরানে।
ইরানের জনজীবনে, এমনকি পথেঘাটে দেখা যাবে উচ্চতর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। ধরা যাক ইরানের কোনও এক রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। হঠাৎই যেতে যেতে এক পথযাত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট'র কাছে কীভাবে পৌঁছাব?’ সাগ্রহে লোকটি প্রত্যুত্তর দেবেন, ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড' শেষ করে 'দ্য গ্রিন মাইল'। তারপরেই 'দ্য অ্যালকেমিস্ট!’
মনে হবে, নিশ্চয়ই এই কথোপকথন দুই বইপাগলের, নয় তো নিতান্তই হেঁয়ালি? না, আসলে মোটেও তা নয়। বরং অতি বাস্তব ঘটনা। ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’, ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড’ বা ‘দ্য গ্রিন মাইল’— এসবই বিশ্ববিশ্রুত সাহিত্যের শিরোনামে রাস্তার নাম রয়েছে সেখানে।
পশ্চিম-মধ্য ইরানের হামাজান প্রদেশের ছোট্ট শহর তাজবাদ সোফলা, যা স্থানীয় মানুষদের কাছে রসুলবাদ বলে পরিচিত এক জনবসতি। ঘটনাটি সেখানকার। সেখানে গোটা অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল মধ্যযুগীয় স্থাপত্য, নির্মাণ। ছোটো ছোটো টিলার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ছবির মতো রাস্তা। দু’ধারে বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি। এমন জায়গা পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ ক্ষেত্র হবে— তাতে আর নতুন কী? কিন্তু এলাকাবাসীদের সাংস্কৃতিক উচ্চতার জন্যেও অঞ্চলটির বেশ আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে।
জনসংখ্যা একেবারে অল্প হলেও, গ্রামের সকলেই আদ্যন্ত বইপাগল। শুধু ইরানি/ফারসি কিংবা আরবি নয়— সমস্ত ভাষার বই-ই সমান প্রধান্য পায় এই ছোট্ট জনবসতিতে। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারের জন্য রয়েছে একটা আস্ত লাইব্রেরিও। সেখানে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন ভাষার প্রায় ৬ হাজার বইয়ের সংগ্রহ। ভাঁটা পড়ে না পড়ুয়াদের ভিড়ও। আর পর্যটকরাও আসেন প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক মাধুর্যের টানে মিছিল করে।
নিজেদের এলাকাটি বইপ্রেমী এবং ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যানুযায়ী গড়ে তুলতে অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছিল গ্রামবাসীরা। বছর দুয়েক আগের কথা। ২০১৯ সালে রসুলবাদের বাসিন্দারা ঠিক করেছিল গ্রামের সমস্ত রাস্তার আবার নতুন করে নামকরণ করা হবে। আর সেই নাম হবে বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন বইয়ের নামে।
কিন্তু বিশ্বের সেরা সাহিত্যের তালিকা প্রস্তুত করা তো মুখের কথা নয়। প্রত্যেকের পছন্দ যে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। এতএব উপায়? শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাভুটির মাধ্যমেই ঠিক করা হয় ৩০টির রাস্তার নাম। এবং আশ্চর্যের বিষয় কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট গল্পের চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবিক মিল রয়েছে শহরের রাস্তাগুলোর।
নামগুলো মধ্যে রয়েছে ফারসি কবি শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’ ও ‘বোস্তা’, পাওলো কয়েলহোর ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’, স্টিফেন কিং-এর ‘দ্য গ্রিন মাইল’, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড’, ফরাসি সাহিত্যিক অ্যান্টোনিও দে সেন্টের ‘দ্য লিটল প্রিন্স’-সহ একাধিক বিশ্বমানের সাহিত্যগ্রন্থ।
এমন নগরের নান্দনিক বিভা তো ছড়াবেই। জনপদের সৌরভ মৌ মৌ করবেই দেশ পেরিয়ে বিশ্বময়।