প্রথম পাতা

দেবপ্রিয়’র দৃষ্টিতে বাজেটে তিন শুভঙ্করের ফাঁকি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৮ জুন ২০২১, শুক্রবার, ৯:২২ অপরাহ্ন

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তিনটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। এগুলো হলো- বরাদ্দ যা নয় তারচেয়ে বেশি করে বলা, গরিবদের যে অনুপাতে পাওয়ার কথা, সেই অনুপাতে পাচ্ছে না। আর যাদের পাওয়া উচিত, তারা পায় না। গতকাল সিপিডি, অক্সফাম ও নাগরিক প্ল্যাটফরমের উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় তিনি এই ফাঁকিগুলো তুলে ধরেন। ‘কোভিডকালে এই বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের জন্য কী আছে?’ শীর্ষক সংলাপে সভাপতিত্ব করেন দেবপ্রিয়। সংলাপে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। আরও বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্য আলী আশরাফ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আলোচনায় অংশ নেন।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। এগুলো হলো- বরাদ্দের চেয়ে বেশি দেখানো হয়; যত টাকা পাওয়ার কথা, তা দেয়া হয় না এবং প্রকৃত সুবিধাভোগীরা পান না। দেবপ্রিয় প্রশ্ন তোলেন, বলা হয় ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তাহলে তাতে গরিবদের হিস্যা কেন বাড়বে না? তিনি বলেন, পেনশনের মতো বিভিন্ন খাতকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বেশি বলে মনে হয়। আসলে অর্থ বরাদ্দ কমছে।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সংসদে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া একটি নাটক মঞ্চস্থের মতো। সংসদে বাজেট নিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল আলোচনা হয় না। রেহমান সোবহান বক্তব্যের একপর্যায়ে আলোচনা সভায় উপস্থিত সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন ও আলী আশরাফকে প্রশ্ন করেন, বাজেট আলোচনায় কতক্ষণ সময় পেয়েছেন?
জবাবে রাশেদ খান মেনন বলেন, ১০ মিনিট। মেনন আরও বলেন, স্যার নাটক বলেছেন। তবে আমি বলবো নাটক না, স্টেটম্যানেজ। একটি স্টেজ থাকে, সেখানে গিয়ে আমরা হাজির হই। তিনি বলেন, সংসদে বাজেট নিয়ে যে আলোচনা হয় তা অর্থহীন। কথা বলতে হয় তাই বলি বলে জানান মেনন। ১০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকলে কী হয়, একটি পয়েন্ট আলোচনা করতেই ১০ মিনিট চলে যায়।
রেহমান সোবহান বলেন, বাজেট আলোচনা এক ধরনের নাটক। সংসদ সদস্যরা নিজেদের এলাকার প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। প্ল্যাকার্ড নিয়ে সংসদ সদস্য সংসদে কথা বলেন। বাজেট আলোচনায় গড়ে ১০ মিনিট সময় দেয়ার কোনো মানে নেই। তিনি বলেন, গরিব আর নতুন গরিব এটি পরিসংখ্যানগত ধূম্রজাল। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় অভীষ্ট মানুষেরা বাদ পড়ে যাচ্ছে, অন্যরা ঢুকে পড়েছে। তিনি বলেন, করোনাকালে নতুন গরিব বেড়েছে। নতুন গরিব ও পুরনো গরিব, এই পরিসংখানগত বিতর্কে না গিয়ে কারা প্রকৃত গরিব তাদের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে কাঠামোগত ও বিতরণে সমস্যা আছে। মানুষ কতটা ঝুঁকিতে আছে- সেটাই বড় বিবেচ্য বিষয়। তিনি গরিব মানুষ ও দরিদ্রপ্রবণ এলাকা বিবেচনায় গরিব মানুষের জন্য বীমা সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।
রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, প্রান্তিক মানুষের কথা বাজেটে না এলে বাজেট অর্থহীন। তিনি মনে করেন, বাজেট অনেকটা আমলানির্ভর হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাজেট তৈরির প্রক্রিয়াটি আরও অংশগ্রহণমূলক হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
পরে সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্য আলী আশরাফ মনে করেন, তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনা করেই বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। তিনি বলেন, রাশেদ খান মেনন বলছেন, বাজেট আমলানির্ভর হয়ে গেছে। এটি যদি হয়, তাহলে তা ভালো লক্ষণ নয়।
মূল প্রবন্ধে কোভিডের কারণে কর্মসংস্থানে প্রভাব বিষয়ক এক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে চাকরি হারানোর চিত্র তুলে ধরেন  তৌফিকুল ইসলাম। এতে বলা হয়, করোনার কারণে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তারা গড়ে ৯৫ দিনের মতো কাজ পাননি। পরে তাদের অনেকেই কাজ পেয়েছেন। তবে আয় কমেছে। এর পরিমাণ গড়ে ১২ শতাংশ। করোনার কারণে সেবা খাতে চাকরি কমেছে। আর কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬ জেলার ২৬০০ খানার ওপর এই জরিপ চালানো হয়।
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদের সহায়তা এবং কৃষি ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাজেটের মধ্যে এই তিনটি কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে সিপিডি’র। এই তিনটি কর্মসূচি বাদ দিলে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ ১,৮৭৮ কোটি টাকা বা ২.৯ শতাংশ বাড়লেও প্রকৃত পক্ষে আগের অর্থবছরের চেয়ে অর্থ বরাদ্দ কমেছে। এ ছাড়া চলমান করোনার প্রভাবে গ্রাম ও শহরে নতুন দরিদ্র বেড়েছে। গ্রামে ১১ শতাংশ আর শহরে ১২ শতাংশ করে দরিদ্র বেড়েছে। সেই সঙ্গে আয়বৈষম্য চরম পর্যায়ে গেছে। কিন্তু এর তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটে সেইভাবে অর্থ বরাদ্দ বাড়েননি বলে জানান তিনি।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ পরামর্শ দেন, করোনার সময় যেসব প্রতিষ্ঠান কোনো কর্মী ছাঁটাই করবে না, তারা আড়াই শতাংশ কর ছাড় পাবে। আর যারা ১০ শতাংশ নতুন কর্মী নিয়োগ দেবে, তারা আরও কর ছাড় পাবে। সেই ব্যবস্থা করা গেলে কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক লায়লা আশরাফুন বলেন, মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিতে হবে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আশিকুর রহমান মনে করেন, এ দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোয় শহরের গরিবদের উপেক্ষা করা হয়।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। তাই সেই অনুযায়ী এটি মোকাবিলা করা উচিত। তিনি ডেটার প্রয়োজনীয়তা এবং একটি অংশগ্রহণমূলক বাজেট গঠনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনায় নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে, যা নীতি নির্ধারকদের পক্ষে থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের জরিপে বলা হয়েছে দেড় থেকে আড়াই কোটি লোক দরিদ্র হয়েছে। এই বিষয়টা বাজেটে উপেক্ষিত হয়েছে। উল্টো কর্মসংস্থান তৈরিতে যেসব মন্ত্রণালয় জড়িত সেই সব মন্ত্রণালয়ের অর্থ বরাদ্দ কমছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status