মত-মতান্তর

নায়িকা সমাচার!

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৭ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৪:২৩ অপরাহ্ন

মঙ্গলবার পহেলা আষাঢ় মোতাবেক ১৫ জুনের বর্ষণসিক্ত দিনটি অতিক্রান্ত হয়েছিল ঘটনাবহুল আবহে। মিডিয়ার পুরোটাই ছিল নায়িকা সমাচারে ভরপুর। ফোকাসে পরীমনি। টক অব দ্য টাউন ছিল তাকে ধর্ষণ ও হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে আবর্তিত। মধ্যরাতে বোট ক্লাবের ঘটনার পর থানা, পুলিশ, কোর্ট, কাচারি, আটক, পাল্টা-অভিযোগ ইত্যাদি নাটকীয়তায় চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স রূপে এখনও অব্যাহত। 
 
পরীমনি সংক্রান্ত ঘটনাবলি আমজনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদেরও স্পর্শ করে। জাপা এমপি মজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘সংসদে একজন সদস্য নায়িকা পরীমনির জন্য বিচার চেয়েছেন। একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। আমি তাকে চিনি। তিনি উত্তরা ক্লাবের তিনবারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেই লোকটি জাতীয় পার্টি করেন। তিনি ভালো লোক।’ 
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর 'সিনেমার সাইনিংয়ের জন্য চিত্রনায়িকা পরীমনি এতো রাতে বোট ক্লাবে না গেলেও পারতেন' বলে মন্তব্য করেন।
পরীমনি আখ্যানের পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা উচ্চারিত হচ্ছে। টাকা, মদ, মারপিট, অভিযুক্তের সঙ্গে রক্ষিতা আটকের মতো আরও অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ও প্রকাশ পাচ্ছে। ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই পরীমনিকে নিয়ে গুলশানের একটি অভিযোগ সামনে এসেছে। এমনকি বৃহস্পতিবার (১৭ জুন) হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জাতীয় সংসদ। বিতর্কের বিষয় ক্লাব, মদ ও জুয়া। সকালে বৈঠকের শুরুতে এই অনির্ধারিত আলোচনায় আওয়ানী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও তরিকত ফেডারেশনের পাঁচ সাংসদ অংশ নেন। 
 
বাংলাদেশে বহু নারী নির্যাতনের ঘটনা, এমনকি চাঞ্চল্যকর নারী হত্যার বিষয় চাপা পড়লেও পরীমনি ইস্যু অনেকদূর যাবে বলেই মনে হচ্ছে। আশা করা যায় যে, পরিস্থিতি নিয়ে উদ্ভূত পক্ষে-বিপক্ষের বিতণ্ডা ও 'ঘোলা জল' সরিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার সাপেক্ষে প্রকৃত দোষীকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
 
ঢাকার মতোই, মাত্র কিছুদিন আগেই কলকাতার আরেক নায়িকা নুসরাত জাহানও মিডিয়ার স্পটলাইটে এসেছিলেন। তাকে ঘিরে প্রশ্ন ছিল: তিনি সত্যি সত্যিই মা হচ্ছেন কিনা? হলে পিতৃত্ব কার? আগে তিনি বিয়ে না সহবাস করেছেন? এখন কার সঙ্গে কোন পরিচয়ে থাকছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরীমনির মতো কেবলই নায়িকা নন নুসরাত। তিনি ভারতের সংসদ সদস্য। তবে তিনি বা পরীমনি তাদের পেশাগত দক্ষতা তথা অভিনয় শৈলীর জন্য আলোচনায় আসেন নি। তাদের কোনও ছবি আদৌ আলোচ্য হওয়ার মর্যাদা রাখে বলেও মনে হয় না। হলে বোদ্ধারা সেসবও এ প্রসঙ্গে বলতেন এবং তারা বা ছবিগুলো পুরস্কৃত হওয়ার খবরও পাওয়া যেতো। বস্তুত, তারা আলোচনায় এসেছেন অভিনয়-বহির্ভূত কারণে ও ইস্যুতে।
 
অথচ নায়িকা বলতেই আমরা গ্ল্যামারের পাশাপাশি অভিনয় কৃতিত্বের মনোমুগ্ধকর দক্ষতার কথা ভাবি। অড্রে হেপবার্ন, সোফিয়া লোরেন, গ্রেটা গার্বো প্রমুখের নাম উচ্চারিত হলেই বিশ্বচলচ্চিত্রের ধ্রুপদী ছবিগুলোর কথা চলে আসে। কাম সেপ্টেম্বর, মাই ফেয়ার লেডি, রোমান হলিডে, সানফ্লাওয়ার ইত্যাদি কালজয়ী চলচ্চিত্রের সঙ্গে মিশে আছে নায়িকাদের যাবতীয় সমাচার।
 
উপমহাদেশেও নার্গিস, সুরাইয়া, মধুবালা, হেমা মালিনি, রেখা, শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, শ্রীদেবী, মাধুরী, দিব্যা ভারতীয় হয়ে হালআমলের অনুশকা শর্মা, ক্যাটরিনা কাইফ, দীপিকা পর্যন্ত প্রতিটি নায়িকার সমাচার পূর্ণ হয়ে আছে অপূর্ব অভিনয়শৈলী, একাধিক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার আর নানাবিধ সৃজনশীল কৃতিত্বে।
 
বাংলাদেশেও সুচন্দা, শবনম, কবরী, শাবানা, ববিতার ভাণ্ডার ভরপুর নানাবিধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায়। সিনে ম্যাগাজিন আর বিনোদন পাতায় এসব নায়িকাদের সমাচার গর্ব, গৌরব ও অর্জনের দীপ্তিতে উজ্জ্বল। তাদের কারো কারো জীবনে কখনও কখনও 'গসিপ' বা 'স্ক্যান্ডাল' স্পর্শ করলেও 'ক্রাইম' ঘেঁষতে পারেনি। 
 
অতীত থেকে বর্তমানের নায়িকাদের সমাচার বিষয়ক ইস্যুসমূহের আমূল ও নেতিবাচক পরিবর্তন কিসের ইঙ্গিতবহ? এতে শিল্প, সংস্কৃতি, অভিনয়-কলার আদৌ কোনও লাভ হচ্ছে? নাকি ক্ষতি হচ্ছে? 
 
ফলে আইন-আদালতের ইস্যুগুলোর সঙ্গে সঙ্গে শিল্প, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিন্যাসের ক্ষয়-অবক্ষয়ের বিষয়গুলোও সামনে আসে। ঢাকার ক্যাসিনোর মতো ক্লাব কালচারের অন্ধকার দিকগুলোও কিছুটা আলোয় এসেছে ঘটনার সূত্রে। ওখানে কারা যান, কখন যান, কি করেন, এসবের বৈধ ও অবৈধ দিকগুলো নিয়েও চলছে রহস্যের আবর্ত। সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে রাজধানীর সামাজিক নাগরিক সংস্কৃতির আড়ালে বিকাশমান কালো ও অন্ধকার দিকগুলো। 
 
প্রাসঙ্গিকভাবেই এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। শুধু সেনসিটিভ খবরই শেষ কথা নয়। খবরের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া ও মূল্যায়নও পাঠকের কাছে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। নিশ্চয় খবরের পাঠক ও চলচ্চিত্রের দর্শকরা সেসব বিশ্লেষণ করছেন। খুঁজে বের করছেন এসব পতন ও অধঃপতনের কার্যকারণ। নির্ণয় করছেন অধঃপতিত পরিস্থিতিতে ব্যক্তি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার মধ্যকার বিকৃতি আর আন্তঃসম্পর্ক। এবং এভাবে পাঠক-দর্শক তথা মানুষই লিপিবদ্ধ করছেন প্রকৃত 'নায়িকা সমাচার'!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status