অনলাইন

এই ভ্যাকসিন ধনীদের...

আমীর খসরু

১৩ জুন ২০২১, রবিবার, ৯:২০ পূর্বাহ্ন

Vaccines for all অথবা vaccines bring us closer- এ স্লোগান দুটো প্রায়শই আমাদের শুনতে হয়। বোঝানো হয়- এ ভ্যাকসিন সবার জন্যই, ভ্যাকসিনে রয়েছে সমাধিকার। কিন্তু এসব স্লোগানের বক্তব্য বাস্তবে উল্টো। ভ্যাকসিন সবার জন্য নয়। আসলে বলতে হয়, Vaccines for few অর্থাৎ সামান্য কয়েকজনের জন্যই এ ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিনের সাথে কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার যেমন জড়িত, তেমনি আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন বাণিজ্যও এর সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য ইকনোমিষ্ট বলছে, বিশ্বের ৮৫টিরও বেশি দেশ ২০২৩ সাল পর্যন্তও ভ্যাকসিনের আওতায় আসতে পারবে না। আর বর্তমানে ভ্যাকসিন না পাওয়া দেশ ও জনগণের সংখ্যা অনেক অনেক গুনে বেশি। ২০২৩ পর্যন্ত বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিনের বাইরেই থেকে যাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে। অথচ ধনী দেশগুলোর চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ভ্যাকসিন মজুত রয়েছে। ভ্যাকসিনকে এ কারণে বলা হয়- যেমনটিকে অক্সফাম বলছে, করোনা হচ্ছে the inequality virus অর্থাৎ অসমতার ভাইরাস । বৃটিশ প্রভাবশালী দ্য গার্ডিয়ান বলছে, The virus isn't a leveler. It has made the rich richer অর্থাৎ এ ভাইরাস বৈষম্য বা ধনী-গরিবের পার্থক্য মোচনকারী নয়। এটি ধনীক শ্রেণিকে আরো ধনী বানিয়েছে। ২০ মে ২০২১ প্রকাশিত অক্সফামের জরিপে বলা হয়েছে, করোনা ভ্যাকসিনের বাণিজ্য করে ইতোমধ্যে বিশ্ব ৯ জন নতুন বিলিয়নিয়ারের জন্ম দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বিশাল নতুন এক ধনীক গোষ্ঠী। অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, আটটি কোম্পানি এবং গ্রুপ তাদের আগের সম্পদের পাহাড়কে দ্বিগুণ করেছে-যার মধ্যে ভারত এবং চীনের কোম্পানিই অর্ধেকের মতো । এই ১৭টি কোম্পানি বা ব্যক্তির ভ্যাকসিন বাণিজ্যের লাভ হয়েছে এ পর্যন্ত ৩২ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। আর গত জানুয়ারিতেই ভ্যাকসিনের বাজার ছিল ৯৩ বিলিয়নের চেয়ে বড়। এ বাজার এখন আরো বড় হয়ে শত কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, আমাজনের জেফ বেজোসসহ বিশ্বের ১০ জন ধনী ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ এখন ৫৪০ বিলিয়ন ডলার। তাদের সামান্য অর্থেই বিশ্বের সব মানুষের ভ্যাকসিন প্রদান সম্ভব। অথচ বিশ্বে যাদের ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে এ পর্যন্ত তাদের সংখ্যা দশমিক পাঁচ শতাংশও হবে না। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শতকরা ৭০ ভাগ মানুষের ভ্যাকসিন না দেয়া পর্যন্ত এ মহামারীর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।
এসব প্রশ্নের অবতারণা করা হলো এই কারণে যে, বাণিজ্য, ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের কূটনীতি এখন পুরো বিশ্বের ভ্যাকসিন বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভ্যাকসিন বাণিজ্যের বড় শিকার। ভারত ও চীন সব সময় আমাদের বলে থাকে, তারা আমাদের বড় বন্ধু। ভারত ভ্যাকসিন দেয়নি, আর চীন ভ্যাকসিন বিক্রি করছে ডোজপ্রতি ১০ ডলারে। অথচ আফ্রিকার দেশ সেনেগাল চীনের সিনোফার্ম থেকে প্রতি ডোজ ৩ দশমিক ৭ ডলার করে ভ্যাকসিন পেয়েছে। বৃহৎ আফ্রিকার অন্তত ৪০টি দেশ চীনের ভ্যাকসিন পেয়েছে ৫ ডলারেরও কম দামে। Statista নামের একটি গবেষণা সংস্থা ৩ মার্চ ২০২১ প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলেছে, চীন ১৪ কোটি ডোজেরও বেশি ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র করেছে ১০ কোটির মতো। জার্মানি-বেলজিয়াম করেছে ৭ কোটি, ভারত সাড়ে চার কোটি, যুক্তরাজ্য ১ কোটি ২০ লাখ এবং রাশিয়া তৈরি করেছে ১ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন। অথচ বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্যাকসিনের জন্য ঘুরছে। আর গুণতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। বাংলাদেশেও লাভবান হয়েছে ভ্যাকসিন ব্যবসায়ী এবং এর সাথে সম্পৃক্তরা। ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্য যেসব চুক্তিগুলো হচ্ছে এবং যে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে তা সাধারণ মানুষের জন্য গোপন করে রাখা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অতীব গোপনীয়তার শর্তে চীনের সাথে ভ্যাকসিন কেনা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি হয়েছে বলে শনিরাব বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন।

এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ভ্যাকসিন নিয়ে কয়েকটি প্রশ্নের এখনও মীমাংসা করা যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খুব ক্ষীণ কণ্ঠে ''সবার জন্য ভ্যাকসিন'' বললেও সঙ্গত: কারণেই এ বিষয়টিকে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। যেসব প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি সেসব সেগুলো হচ্ছে- ভ্যাকসিন কি সর্বজনের স্বাস্থ্যগত জরুরি প্রয়োজনীয় বিষয় অথবা বাণিজ্যের লাভা-লাভের বিষয়। এটা মনে রাখতে হবে, টিকার উৎপাদনকারী দেশ এবং কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিনকে সর্বজনের স্বাস্থ্যগত জরুরি প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে না দেখে এটিকে বাণিজ্যের এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দরিদ্র্য দেশ এর দুর্ভাগ্যজনক শিকার।

দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি ব্যবসার একটি মানদণ্ড থাকে, যা অবশ্যই পালনীয়। কিন্তু করোনা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে কোন মানদণ্ড বিশ্বজনিন নিয়ম-নীতি নেই। কারণ বিভিন্ন দেশ এবং বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এর সুযোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশের উদাহরণই যদি দেয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, চীনের ভ্যাকসিন কেনা নিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। চীন বাংলাদেশের সাথে প্রতি ডোজ সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের দাম ১০ ডলারে বিক্রির বিষয়টি চূড়ান্ত করে। এক্ষেত্রে মূল চুক্তি ছাড়াও দামের গোপনীয়তার বিষয়ে আলাদা একটি চুক্তি করতে সম্মত হয়। কিন্তু তথাকথিত গোপনীয়তার অর্থাৎ ১০ ডলারের কথাটি সংবাদমাধ্যমে চলে আসে। ওই ১০ ডলারের ভ্যাকসিন যখন ১৪ ডলার দামে শ্রীলংকার কাছে বিক্রি করা হয় তখনই ঝামেলা বেধে যায়। ইন্দোনেশিয়া এর আগে প্রতি ডোজ ১৭ ডলারে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন কিনেছে। চীন বেঁকে বসেছিল এই কারণ দেখিয়ে যে, বাংলাদেশ যেহেতু গোপনীয়তার শর্ত ভঙ্গ করেছে সে কারণে ১০ ডলার দামে দেড় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তারা আগের দামে বিক্রি করবে কিনা? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন তখন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, চীন থেকে এখন ১০ ডলারে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এখন দাম অনেক অনেক বেড়ে যেতে পারে। অনেক ঘটনার পরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঘোষণা দিয়েছেন, চীন থেকে ভ্যাকসিন কেনা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে তিনি ভ্যাকসিনের প্রতি ডোজের দাম কতো এবং চুক্তি স্বাক্ষরের দিন-তারিখ সম্পর্কে কিছুই জানাননি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এও বলেছেন, এবারের চুক্তির ব্যাপারে কঠিন-কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হবে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিনের বাকি অর্থও ফেরত চাওয়া হয়েছে কিনা - জানা যায়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে- গোপনীয়তার চুক্তি থাকতে হবে কেন এবং ভ্যাকসিন মূল্যের একটি সমতা কেন থাকবে না? শুধু চীনই নয়,  অন্যান্য দেশ এবং ওষুধ কোম্পানিও এই একই কাজটি করছে।

তৃতীয়ত, ভ্যাকসিন বা ওষুধের ক্ষেত্রে ডব্লিউটিও-র বাণিজ্যভিত্তিক মেধা-সম্পত্তি চুক্তির শর্তাবলী কেন এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে? তাহলে কি ধরে নিতে হবে করোনা বিভিন্ন দেশ, কোম্পানি ও ব্যক্তিবর্গের কাছে আশীর্বাদ এবং বাংলাদেশসহ দরিদ্র দেশগুলোর জন্য একটি অভিশাপ। একথা নির্ধিদ্বায় বলা যায়, বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন নিয়ে যা হচ্ছে তা আসলে একথাই প্রমাণ করে দেয় যে, এই ভ্যাকসিন ধনীদের...।

(আমীর খসরু, প্রধান নির্বাহী, স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল অ্যাফেয়ার্স, ঢাকা)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status