প্রথম পাতা

করোনায় সুদি কারবারিদের জাল

আলতাফ হোসাইন

১৩ জুন ২০২১, রবিবার, ৯:৪১ অপরাহ্ন

করোনাকালে অভাবে পড়ে গ্রামের এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন নাটোরের গোপাল মণ্ডল। চক্রবৃদ্ধি হারে সেই ঋণ এক বছরে বেড়ে হয়েছিল ৭ লাখ টাকা। টাকা দিতে না পারায় মারধরের শিকার হন প্রভাবশালী ওই দাদন ব্যবসায়ীর হাতে। অপমান সইতে না পেরে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। এমন চড়া সুদে ঋণ নিয়েছিলেন বড়াইগ্রাম উপজেলার কয়েন গ্রামের ভ্যানচালক রেজাউল। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে মহাজনের চাপে ২২ দিনের শিশু সন্তানকে বিক্রি করে দেন তিনি। যদিও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর শিশুটিকে উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। শুধু রেজাউল কিংবা গোপাল মণ্ডল নন, উচ্চহারে সুদে ঋণ নিয়ে এবং তা পরিশোধ করতে না পেরে নাটোরে গত দেড় বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৯টি, খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩টি, আর রেজাউলের মতো এমন অনেকেই হয়েছেন নিঃস্ব। শুধু নাটোরে নয়, রাজধানীসহ সারা দেশেই করোনাকালে মানুষের সংকটকে পুঁজি করে সুদের ব্যবসা করা এসব মহাজনের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। এদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার। চড়া সুদ ও ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে স্ত্রী-সন্তান, বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
করোনাকালে আয় কমে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে ভুগছেন দেশের অনেক মানুষ। রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি জেলা-উপজেলায় খোঁজ নিয়ে এবং নিম্ন আয়ের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভাবে পড়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী কিংবা বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে থাকেন তারা। বিশেষ করে রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ নিম্ন্ন শ্রেণির মানুষ কিংবা স্বল্প আয়ের মানুষেরা বাধ্য হয়ে চড়া সুদে ঋণ নেন। কিন্তু ঋণের জালে বন্দি হয়ে দুঃখ-দুর্দশা আরও বাড়াচ্ছেন, পড়ছেন পারিবারিক অশান্তির দাবানলে। ঋণ নিয়ে সাময়িকভাবে অর্থ কষ্ট ঘুচলেও, পরে শরীর ঘামানো কষ্টের টাকার সবটাই চলে যায় মহাজনদের পকেটে। আর টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে নেমে আসে মানসিক চাপ। এমনকি শিকার হতে হয় শারীরিক নির্যাতনের। এসব সুদের কারবারিদের সঙ্গে এলাকার প্রভাবশালীদের থাকে সম্পৃক্ততা। প্রভাবশালী মহাজনদের ভয়ে সাধারণ মানুষ মুখ খুলতেও চান না।
রাজধানীর বাড্ডার বাসিন্দা রিকশাচালক আবেদ আলী। দুই বছর ধরে তার স্ত্রী অসুস্থ। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিই। পরিবারে রয়েছে ৬ বছর বয়সী এক ছেলে আর ১৬ বছর বয়সী মেয়ে। গত বছর করোনার সময় লকডাউনে রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ এবং হাটবাজার করার টাকা না থাকায় তার রিকশার মহাজনের কাছ থেকে দিনে ১৫০ টাকা হারে সুদে ৪ মাস মেয়াদে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি। কিছুদিন  কোনোমতে বাজার-সদাই করে খেলেও এক মাস না যেতেই সেই টাকা শেষ হয়ে যায়। এতেই কঠিন চাপে পড়েন তিনি। কয়েকদিন পর রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হন। কিন্তু অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় দিনে মাত্র ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। এরমধ্যে ২০০ টাকা রিকশার জমা আর দেড়শ’ টাকা সুদ দিয়েই সব শেষ হয়ে যায়। এমন বিপদের সময় তিনি আরেকজনের কাছ থেকে দিনে ১০০ টাকা সুদে আরো ৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। কিন্তু এতে অভাবতো ঘুচেই না, বরং ঋণের বোঝা মাথায় চেপে ধরে। দুশ্চিন্তায় কি করবে তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামে চলে যান। আবেদ আলীর গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদি উপজেলায়। তিনি বলেন, গ্রামে গিয়াও তেমন কোনো কাজ না থাহায় প্রতিবেশীগো থাইক্যা ধারদেনা লয়া চলতে হইতো। এরপর পরিস্থতি একটু স্বাভাবিক হইলে ঢাকায় চইলা আসি। রিকশা চালায়া ধীরে ধীরে ঋণ পরিশাধ করি। মাইয়ারে একটা কারখানায় কাজ করতে দিছি। তয় মোর বড় এটা শিক্ষা হইলো ভাই। আর জীবনেও এমন ঋণের ফাঁদে পা দিতাম না। কষ্ট কইরা খামু, না হয় না খাইয়া মইরা যামু তবু এমন ভুল আর করুম না। আবেদ আলী জানান, বাড্ডা, রামপুরা এলাকায় অনেক প্রভাবশালী সুদের মহাজন রয়েছে। এরসঙ্গে স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও জড়িত। এছাড়া বাড়িওয়ালারাও এই সংকটকে পুঁজি করে তাদের ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকেও উচ্চহারে সুদ খেয়ে আসছে। ভাড়াটিয়ারা বাসা ভাড়া দিতে না পারলে তাদেরকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা বলে সুদের কারবার করছে। আবেদ আলী জানান, এসব এলাকার অনেকেই ছিলেন যারা সুদের জালে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গ্রামে চলে গেছেন।
নাটোরের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনাকালে এই অঞ্চলের সুদের মহাজনদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। গ্রামের অসহায় মানুষদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। প্রশাসনের দৃষ্টিতে এলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কারণ এদের সবাই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী কিংবা রাজনৈতিক নেতা। সম্প্রতি নাটোর সদরের বাসিন্দা গোপাল মণ্ডল পড়েছিলেন এসব দাদন ব্যবসায়ীর জালে। মাত্র ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিলে এক বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখে। তার পক্ষে এই টাকা পরিশোধ করা ছিল অসম্ভব। কারণ ভিটেবাড়ি ছাড়া আর তেমন কোনো সম্পদ ছিল না। আর তাই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যা করেন গোপাল মণ্ডল। তার মা রানী মণ্ডল একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। তার স্ত্রী জানান, সুদের টাকা চাইতে প্রায়ই বাড়িতে আসতো ওই দাদন ব্যবসায়ী। টাকা দিতে না পারায় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হতো। এরমধ্যেই একদিন তাকে ধরে মারধর করা হয়। এই অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন গোপাল।
গত মার্চে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য ভ্যানচালক রেজাউল তার ২২ দিনের মেয়েশিশুকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। রেজাউলের পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, রেজাউল করিম এক দাদন ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ, সানোয়ার হোসেন ও কালাম হোসেন নামের ৩ জনের কাছ থেকে চড়া সুদে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। কিছু টাকা পরিশোধ করলেও তার সুদে-আসলে ৮০ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। টাকা পরিশোধের জন্য দাদন ব্যবসায়ীরা তাকে চাপ দিতে থাকেন। টাকা দিতে না পারায় দাদন ব্যবসায়ী কামাল হোসেন তার ভ্যানটিও কেড়ে নিয়ে নেন। পরে রেজাউল আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে ২২ দিনের শিশু সন্তানকে নিয়ে বিক্রি করে দেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, করোনাকালে সারা দেশেই সুদ কারবারিদের কারণে আত্মহত্যা, হামলা-মামলা এমনকি খুনের মতো ঘটনাও ঘটছে। ব্যক্তিগতভাবে সুদের কারবারসহ গ্রামে-গঞ্জে নামে- বেনামে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সমিতির মাধ্যমেও এই সুদের ব্যবসা করছেন প্রভাবশালীরা। এসব সুদের ব্যবসায়ীরা রাতারাতি হয়ে যান বিরাট ধন-সম্পদের মালিক। আর অসহায় দরিদ্র মানুষগুলো আরও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, করোনাকালে যেসব মানুষ আর্থিক সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে নিম্ন শ্রেণির যারা তাদের জন্য সরকার তেমন কিছু ভাবছে না। এবারের বাজেটেও তাদের জন্য তেমন কিছু রাখা হয়নি। যারা প্রকৃতভাবে কাজ হারিয়ে এই সময়ে অর্থ সংকটে পড়েছে, ব্যাংক কিংবা এনজিও সংস্থার মাধ্যমে তাদের কাছে অর্থ পৌঁছানোর দরকার ছিল। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকলেতো তারা এসব সুদ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়তো না। তিনি বলেন, সংকটে পড়ে গ্রামে-গঞ্জের মানুষদের পাশাপাশি এখন শহরের খেটে খাওয়া মানুষও এভাবে উচ্চহারে সুদ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। যদিও শহরে বিভিন্ন কাজের সুযোগ থাকে, কিন্তু গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় দরিদ্র মানুষগুলো আরও সমস্যায় আছে। সেজন্য সরকারের উচিত এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এসব দাদন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status