শেষের পাতা

সিপিডি’র সংলাপ

বাজেটে জীবন জীবিকার সঠিক পদক্ষেপ নেই

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৩ জুন ২০২১, রবিবার, ৯:৩৯ অপরাহ্ন

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করোনা মোকাবিলা ও জীবন-জীবিকার সঠিক পদক্ষেপ উপেক্ষিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া বাজেট বাস্তবায়নের কোনো দিক নির্দেশনা নেই। পাশাপাশি প্রস্তাবিত বাজেটকে কল্যাণমুখী করতে ও সুশাসন নিশ্চিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি জরুরি। গতকাল বেসরকারি 
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল ‘বাজেট ডায়ালগ-২০২১’ শীর্ষক বাজেট পরবর্তী সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সিপিডি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, রুমিন ফারহানা, এফবিসিসিআই সভাপতি জসীম উদ্দিন, এমসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবীর, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম বক্তব্য দেন। সংলাপে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
বক্তারা বলেন, অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটটি সুলিখিত তবে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার কোনো দিক নির্দেশনা নেই। এমনকি বাজেট তৈরি এবং বাস্তবায়নে সংসদ সদস্যদের কোনো ভূমিকা নেই, শুধু সংসদে বিল পাশের দিন হ্যাঁ এবং না বলাটাই আইন প্রণেতাদের মূল দায়িত্বে পরিণত হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা জানান, করোনার প্রভাবে সরকারি অর্থের গুণগত ব্যয় হচ্ছে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটকে কল্যাণমুখী করতে, সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
সিপিডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে করোনার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে আরো বেশি বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। সংস্থাটি বলছে, নতুন করে দরিদ্র হয়েছে অনেকে। আয় কমেছে ৪৫ শতাংশ পেশাজীবী ও শ্রমজীবীর।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এবারের বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। এটা আরো কমানো যেতো, ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা যেতো। যদি আমরা ভ্যাটকে আরো সুন্দরভাবে আদায় করতে পারতাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটা অদ্ভুত দেশ, যেখানে ভ্যাট দিলে ব্যবসা কমে যাবে বলা হয়, অথচ ভ্যাট দেন ভোক্তারা। রেমিট্যান্সে প্রণোদনার বিষয়ে তিনি বলেন, এখন দুই শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। যারা ক্ষুদ্র কাজ করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন, বড় চাকরি করে টাকা পাঠাচ্ছেন সবাই এই প্রণোদনা পাচ্ছেন। যদি আমরা নির্দিষ্ট করে দরিদ্রদের দিতে পারতাম সেক্ষেত্রে এই প্রণোদনা ৪ শতাংশের সুপারিশ করতাম। করোনার প্রভাবে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাচ্ছে এমন বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন। তবে এটা নিয়ে আরো কাজ করতে হবে।
ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, বলেন, তথ্যের ঘাটতি শুধু নয়, তথ্যের অসঙ্গতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। পরিসংখ্যন ব্যুরোর (বিবিএস) সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ দেশে নতুন দারিদ্র্য বেড়েছে কিনা সেটি তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে আসতে হবে। তিনি বলেন, শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছে ২০১৬ সালে। কিন্তু ২০২১ সালের যে বাস্তবতা সেটা ওই জরিপের তথ্য দিয়ে বোঝা যাবে না। যতদিন পরিসংখ্যান নিয়ে ভিন্নমত থাকবে ততদিন আমরা সঠিক রেজাল্ট পাবো না।
বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ঘাটতি আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটা আমাদের ঠিক করতে হবে। আবার যদি আমরা মনে করি যে শুধু সরকার যেটা দেবে, সেটাকেই পাস করে দেয়া, তাহলে তো আমাদের বাজেট অধিবেশনের প্রয়োজন নাই।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বেকারদের সহায়তা দিতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নতুন বেকারদের সহায়তা করা। অর্থমন্ত্রী কর কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে চাইছেন। কিন্তু এর জন্য কর্মসংস্থান তৈরিতে আরো দুই-এক বছর সময় প্রয়োজন। তৈরি পোশাকশিল্প সুগঠিত। এখাতে বেকারদের পরীক্ষামূলকভাবে ভাতা চালু করা যেতে পারে। যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, নীতিনির্ধারণে তাদের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
মূল প্রবন্ধে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, কর ছাড় দিলে বিনিয়োগ বাড়বে, এটা ঠিক নয়। বিনিয়োগ পরিবেশের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। করোনার প্রভাব কতদিন থাকবে সেটা অনিশ্চিত। দেশে করোনার টিকা কার্যক্রমের জন্য বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল রাখার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবতা বিবেচনায় এটা পর্যাপ্ত নয় বলে তিনি মনে করেন। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনাকে মাথায় রেখে এবারের বাজেট হয়নি। দেশে দরিদ্র, নিম্নবিত্তদের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সরাসরি কিছু উল্লেখ করা হয়নি। করোনার প্রভাবে দেশে নিম্ন আয়ের অনেকেই দরিদ্র হয়ে পড়েছে। ফলে আয় বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আরো প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১০ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে। এই বাস্তবায়ন দিয়ে আমরা কীভাবে করোনা মোকাবিলা করতে পারবো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য। আগের বাজেটে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এবারের বাজেটে সংস্কারের কথা কিছুই নেই।
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজাতে হবে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় প্রতি মাসে ২৫ লাখ টিকা দেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু এ টিকা কোত্থেকে আসবে সেটি বলা হয়নি। তাছাড়া এই হারে টিকা দেয়া হলে কমপক্ষে চার বছর লেগে যাবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। কিন্তু অগ্রিম কর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের দাবি ছিল এই অগ্রিম কর পুরোপুরি উঠিয়ে দেয়া। কারণ অগ্রিম কর দেয়ার ফলে ব্যবসার খরচ আরো বেড়ে যাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সংস্কারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, করের নীতি ও বাস্তবায়ন আলাদা করতে হবে। এটা আমাদের জোর দাবি।
বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসাবান্ধব বলতেই পারি। তবে পোশাকখাতের জন্য তেমন পরিবর্তন হয়নি। কর প্রণোদনা যাই হোক সেটি কমপক্ষে ৫ বছরের জন্য নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। কারণ প্রতিবার কর পরিবর্তন হলে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বাধাগ্রস্ত হয়।


 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status