এক্সক্লুসিভ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপেক্ষিত ৫৫ হাজার অফিস সহকারীর বোবা কান্না

জিয়া শাহীন

১২ জুন ২০২১, শনিবার, ৭:৩৫ অপরাহ্ন

সরকার দেশের উন্নয়নে এরই মধ্যে সারা বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাখাতে আমূল পরিবর্তন সরকারকে এনে দিয়েছে “শিক্ষাবান্ধব” উপাধি। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করা, শিক্ষকদের পদ ও বেতন বৃদ্ধি অন্যতম। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি “জনবল কাঠামো ২০২১’’ জারি করেন সরকার। সব কিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তাদের একটি বিষয় বারংবার এড়িয়ে যাওয়াটা এবার ছিল অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীই থাকেন না। কর্মচারীরাও থাকেন। এই কর্মচারীদের কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভুলেই গেছেন। কর্মচারীদের মধ্যে অফিস সহকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ রয়ে গেছে। যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় প্রতিনিয়ত। একজন দক্ষ অফিস সহকারী মানে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দক্ষভাবে পরিচালিত হওয়াকে বুঝায়। একজন অফিস সহকারী অফিসের যাবতীয় কাজ করার পরেও কম্পিউটারের সব কাজ এমনকি ক্লাস পর্যন্ত নেন। জনবল কাঠামো ঘোষণার সময় এই পদটি কীভাবে উপেক্ষিত রয়ে গেল সেটাই ভাববার বিষয়।
গত এক বছর যাবৎ দেশের ৫৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারীরা তাদের দাবি দাওয়ার জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিল। দেশের প্রতিটি জেলা- উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকদের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্মারকলিপি দেয়া হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। কিন্তু জনবল কাঠামোতে তাদের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে তাদের মাঝে। কাজের পর কাজ, পদবি নিয়ে শিক্ষকদের “কেরানি” বলে টিটকারি, পরিবারে চরম অভাব অনটন সব মিলিয়ে ৫৫ হাজার অফিস সহকারীর বোবা কান্না দেখার মতো কেউ নেই।
কি ছিল তাদের দাবিগুলো: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারীদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল তাদের বেতন গ্রেড পরিবর্তনের। বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী পরিষদের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মন্টু জানান, শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের অফিসের সময় নির্ধারণ থাকলেও একজন অফিস সহকারীর কোনো অফিস সময় নেই। তাদের সকাল ৯টা থেকে রাত অবধি কাজ করতে হয়। অথচ তাদের বেতন স্কেল ৯৩০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে তারা বেতন পান ৩৭০ টাকার মতো। সবচেয়ে দুঃখজনক হলোÑ ১০ বছর নিরবচ্ছিন্ন কাজ করার পর তাদের বেতন বৃদ্ধি হয় মাসিক মাত্র ৪০০ টাকা। এই স্বল্প বেতনে তাদের সংসার নির্বাহ করা অত্যন্ত দুরূহ। তাই বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে অফিস সহকারীরা ১১তম গ্রেড দাবি করছে। যা অত্যন্ত যৌক্তিক বলে তিনি জানান।
সিনিয়র সহ-সভাপতি জিয়া শাহীন বলেন, একজন অফিস সহকারী চাকরিতে যোগদানের সময় কম্পিউটারের কোনো অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় না। এ ছাড়া ২০/৩০ বছর আগে যারা চাকরিতে যোগদান করেছেন তাদের কম্পিউটারে অভিজ্ঞতা থাকার কথাই না। সেই অফিস সহকারীদের দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটারের সকল কাজ করানো হচ্ছে। এসএসসি, জেএসসি’র ফরম পূরণ, নিবন্ধন, ইএমআইএস, বেনবেইজ জরিপের কাজগুলোও করানো হচ্ছে অন লাইনে। সম্প্রতি উপবৃত্তির মতো জটিল কাজও করানো হচ্ছে অফিস সহকারীদের দিয়ে। অথচ এ বিষয়গুলোতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক বা সাধারণ শিক্ষকরা। অফিস সহকারীরা কম্পিউটারের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু নতুন জনবল কাঠামোতে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদ থেকে কম্পিউটার অপারেটর শব্দটি বিস্ময়করভাবে বাদ দেয়া হয়। এখন কম্পিউটারের কাজ করবে তাও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করায় প্রশিক্ষণবিহীন অফিস সহকারীদের দিয়েই এসব কাজ করানো হচ্ছে।
সহ-সভাপতি আলিম দারিয়া জানান, নতুন জনবল কাঠামোতে শিক্ষার্থী বাড়লে শিক্ষক বৃদ্ধির সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে অফিস সহকারী পদটি স্থির রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ২০০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন অফিস সহকারী, ১০০০ শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন। এটি অবিশ্বাস্য বলে তিনি দাবি করেন।
সহ-সভাপতি কার্তিক দাস জানান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেভাবে অফিস সহকারীদের কাজের পরিধি বাড়ছে, তার জন্য অফিস সহকারী পদটি পরিবর্তন আবশ্যক। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেও ব্যত্যয় ঘটে না। তার কাজ অন্য শিক্ষক বা অফিস সহকারীকে দিয়ে চালিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু অফিস সহকারী অনুপস্থিত থাকলে প্রশাসনিক কাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম ঘটে। এ জন্য অফিস সহকারীদের পদটি “প্রশাসনিক কর্মকর্তা’’ করার দাবি জানান।
সংগঠনের অন্যতম নেতা ভোলার কামরুল ইসলাম বলেন, অফিস সহকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পদোন্নতি। এখন কর্মরত অফিস সহকারীদের বেশির ভাগ স্নাতক পাস। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা ক্লাস নেন। তাই যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রয়োজন। এতদিন শিক্ষা কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, শিক্ষক হতে হলে এনটিআরসি পাস হতে হবে। অথচ দেশের ৫০ হাজার সহকারী গ্রন্থাগারিকদের এক কলমের খোঁচায় শিক্ষক হিসেবে ঘোষণা করা হলো। সে হিসেবে তিনি যোগ্য অফিস সহকারীদের শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দাবি করেন।
অফিস সহকারীদের এসব দাবির প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও সমর্থন জানিয়েছেন। সমর্থন জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারাও। জেলায় জেলায় এ সংগঠনের সম্মেলনে উপস্থিত থাকা সংসদ সদস্য, বোর্ড চেয়ারম্যান কিংবা মেয়রবৃন্দ অফিস সহকারীদের দাবিগুলোকে ন্যায্য বলে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, বরিশাল আঞ্চলিক সভাপতি অধ্যক্ষ মহসিন-উল ইসলাম হাবুল অফিস সহকারীদের ৫টি দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, নতুন জনবল কাঠামোতে অফিস সহকারীদের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। সমর্থন সবাই করেছেন, কিন্তু যাদের কর্ণকুহরে দাবিগুলো পৌঁছানোর কথা, তারা চরমভাবে অবজ্ঞা করেছেন বিষয়টিÑ এমন দাবি অফিস সহকারীদের। এ কারণেই কান্না চেপে ঈদের পর রাজপথে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অর্ধ লক্ষাধিক অফিস সহকারী।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status