বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭৩)

তারা খালেদাকেও দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চাইছেন

স্টাফ রিপোর্টার

১১ জুন ২০২১, শুক্রবার, ১২:২০ অপরাহ্ন

সোমবার ৯ জুন ২০০৮ দিন ৪২৪
এ অবৈধ সরকার দ্বিতীয়বারের মতো বাজেট পেশ করেছে এবং সংবিধান লঙ্ঘন করে তা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। সংবিধানের ৮১ ও ৮২ ধারা অনুসারে একটি অর্থবিল সংসদে পেশকৃত ও গৃহীত না হলে তা বাজেট হতে পারে না। ৮৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদের আইনবলে প্রদত্ত ক্ষমতা দেওয়া না হলে কেউ কর আরোপ কিংবা আদায় করতে পারবেন না। যদি প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের অধীনে সংবিধান কিংবা এর সংশ্লিষ্ট কোনো ধারা রহিত করা হতো তাহলে এটি হতো অন্য একটি বিষয়। কিন্তু সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায় এবং সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেগুলো সক্রিয় থাকাকালে এই সরকারের বাজেট পেশ করার কিংবা কোনো কর আরোপ আদায়ের ক্ষমতা নেই। তবে সরকার তা করছেন, কারণ দেশ সংবিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে না, পরিচালনা করছেন জেনারেলরা। যা খুশি তাই করছে।

মঙ্গলবার ১০ জুন ২০০৮ দিন ৪২৫
একটি আজব অথচ মজাদার ঘটনা ঘটেছে। একরকম হঠাৎ করেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জরুরি ভিত্তিতে আমার স্বাস্থ্য ও ডিটেনশন সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে একজন সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠন করা একটি মেডিক্যাল বোর্ড আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে জেলগেটে। এ নিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ বেশ উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত বলে মনে হলো। উচ্চতর পর্যায় অথবা বিদেশি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কড়া চাপ না থাকলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের কোনো চিঠি আসা স্বাভাবিক ছিল না। তবে এ চাপ কারা প্রয়োগ করেছে তা আমার জানা নেই। হতে পারে তা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। সেখানে আমার কিছুসংখ্যক ব্যক্তিগত সুহৃদ ও শুভাকাক্সক্ষী রয়েছেন। আর হাসনা তো রয়েছেই।
আমাকে নেওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। দিনে দিনে ওজন কেবল আমার কমছেই। দু’পায়ের পেশীতে সারারাত প্রবল যন্ত্রণা হয়। আবার পা দু’টো ফুলতে শুরু করেছে।

বুধবার ১১ জুন ২০০৮ দিন ৪২৬
রাষ্ট্রপতির এক প্রশাসনিক নির্দেশে শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার্থে বিদেশ যাওয়ার জন্য প্যারোলে ৮ সপ্তাহের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি গতকাল বাসায় ফেরত গেছেন, নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং দু’-একদিনের মধ্যে পাড়ি জমাবেন বিদেশে। এতে প্রমাণিত হলো যে, সরকারের সঙ্গে তার সমঝোতা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে।
একেই বলে রাজনীতি। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা কিংবা সুবিধার কাছে আইন, বিধি, আদালতের সিদ্ধান্ত কিংবা সংবিধানের পবিত্রতা সবকিছুই তুচ্ছ হয়ে যায়। হাতের এক তুড়িতে সেনাবাহিনী, জরুরি আইন ও আপিল বিভাগের জামিন প্রত্যাখ্যানকে ধরাশায়ী করে জেলের বাইরে এসে যখন হাসিনা মুক্তির স্বাদ নিচ্ছিলেন তখন ট্রায়াল কোর্টের দিনগুলোর কথা মনে করে নিশ্চয়ই তিনি মুচকি হেসেছিলেন। এভাবে দেখা যাচ্ছে, আইনের অপব্যবহার করে রাজনীতিকদের যেমন নাজেহাল করা যায়, তেমনি পাঁচটি মামলা বিচারাধীন এবং আরো ৮টি মামলা বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা সত্ত্বেও বিনা জামিনে আইনের অপব্যবহার করে একজন রাজনীতিবিদকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেওয়া যায়। অন্যদিকে, গত এক বছরে সেনাবাহিনী যেখানে প্রতিনিয়ত তাকে নাজেহাল, নির্যাতন, অপমান করেছে অব্যাহতভাবে। সংবাদপত্রে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রপাগান্ডা চালিয়েছে এবং দিনের পর দিন সংবাদ মাধ্যমের সাহায্যে শেখ হাসিনার চরিত্রহনন করেছে সেই নির্যাতক সেনা সরকারই নিজ হাতে আজ তার মুক্তি নিশ্চিত করেছে।
এখন দেখা যাক বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্যে কী আছে!

বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০০৮ দিন ৪২৭
বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সরকারের মাঝরাতের দেনদরবার চলছে। প্রায় প্রতিরাতেই সিনিয়র আর্মি অফিসাররা খালেদার সাথে দেখা করছেন সাব-জেলে। সেনা অফিসাররা চাচ্ছেন হাসিনার মতো খালেদাও দেশ ছেড়ে চলে যান এবং তিনি রাজি হলে তার ব্যাপারে শেখ হাসিনার মতোই অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাইকো মামলার শুনানি চলাকালে কোর্টে আমার পাশে বসে আজ বেগম জিয়া আমাকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন। তিনি দেশ ছাড়ার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর প্রথম শর্ত হলো, তার দুই ছেলের মুক্তি। সামরিক অফিসাররা কোকোকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছেন, তবে তারেক রহমানকে নয়। খালেদা জিয়া এতে রাজি হননি। তিনি আমাকে বলেছেন যে, জেনারেল মইনের গ্রুপের একটি অংশ এখনো মাইনাস-টু থিওরি বাস্তবায়নে আগ্রহী এবং সেজন্যই তারা খালেদাকেও দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চাইছেন। হাসিনার সম্মতির পাশাপাশি এবার তারা খালেদার কাছ থেকেও দেশ ছাড়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে রাজনীতিতে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চাইছেন। এ কারণে তারা খালেদার ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করছেন। এখন বেগম জিয়া এক প্রচণ্ড স্নায়ুযুদ্ধে পড়েছেন।

শুক্রবার ১৩ জুন ২০০৮ দিন ৪২৮
রাজনীতি একটি গতিশীল বিজ্ঞান। এর গতিপথ অত্যন্ত অনিশ্চিত এবং যে কোনো সময়ে এই গতিপথে পরিবর্তন আসতে পারে। খুব বেশিদিন হয়নি যে, শেখ হাসিনাকে ১৩টি মামলায় জড়িয়ে নিগৃহীত করার জন্য দুর্নীতিবাজদের তালিকাভুক্ত করে ১১ মাস জেলে রেখে এবং দেশের উচ্চতম আদালত থেকে জামিন নামঞ্জুর করিয়ে নাজেহালপর্ব চালানোর পর এখন সেই সামরিক সরকারই তাদের মাথা নত করে তার তোষামোদ করছেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সাথে টেলিফোনে প্রায় ২০ মিনিট কথা বলেছেন এবং চার উপদেষ্টা বন্দিকালীন জীবনে হাসিনার ওপর যে ঝড় বয়ে গেছে তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেও সান্তনা দিতে ছুটে গিয়েছেন তার বাসায়।

শনিবার ১৪ জুন ২০০৮ দিন ৪২৯
তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থা এখন কী দাঁড়াচ্ছে? দুর্নীতি ও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি, যা ছিল সরকারের এক নম্বর এজেন্ডা তার অবস্থানই বা এখন কোথায়? আমি বারবার বলেছি যে, এই প্রচারণা ছিল দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা এবং প্রজাতন্ত্রকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে হয়তো একদিন মুক্তি দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু জাতির যে বিশাল ক্ষতিসাধন করা হয়েছে তার খেসারত দেবে কারা?

রবিবার ১৫ জুন ২০০৮ দিন ৪৩০
আয় ও সম্পদ বিষয়ক মামলার অভিযোগের শুনানির জন্য আমাকে নেওয়া হয়েছিল শেরেবাংলা নগরের ৬নং ট্রাইব্যুনালে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর একটি প্রিজন ভ্যানে চড়িয়ে সেখানে নেওয়া হয় আমাকে। আমার বিরুদ্ধে আনীত ব্যয়সংক্রান্ত বানোয়াট মামলার বিরুদ্ধে করা একটি রিট আবেদন হাইকোর্ট ডিভিশনে বিচারাধীন থাকায় বিষয়টি মুলতবি রাখা হয়। অন্যথায় এই আদালতে একবার শুনানি আরম্ভ হলে আমার সাজা হবে তা একরকম অবধারিত। কারণ ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলো মামলার বৈধতা, সাক্ষ্যপ্রমাণের অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি বাছবিচার না করে ওপর থেকে যে আদেশ দেওয়া হয় সে অনুসারেই কাজ করে। কাজেই আমি এ ব্যাপারে কোনো। ঝুঁকি নিতে চাই না।

সোমবার ১৬ জুন ২০০৮ দিন ৪৩১
আজ আমি জানতে পারলাম যে, দেশের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের একজন পরিচালক আবু সুফিয়ান, যাকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের অন্ধকূপে চার মাস আটক রেখে বারবার যৌথবাহিনীর সদস্যরা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন করেছে, এবার তাকে বিপুল নগদ অর্থের বিনিময়ে হাজির করা হচ্ছে আদালতের সামনে। আমাদের নিজ নিজ ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে যাওয়ার পথে প্রিজন ভ্যানে সুফিয়ান আমাকে এসব জানিয়েছে। ইতিমধ্যেই ভগ্নস্বাস্থ্যের সুফিয়ান এসব ঘটনা আমাকে জানানোর সময় অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। আমি তাকে অনেক বছর ধরে একজন অমায়িক ও ভদ্রলোক বলে জানি।
শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই চলে গেছেন দেশ ছেড়ে। খালেদা জিয়ার সাথে চলছে গোপন দেনদরবার। আমার দুই হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা। ফলে প্রাত্যহিক কর্মসূচি হিসেবে ১৫ মিনিট বারান্দায় হাঁটাহাঁটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।
ডা. মোহসিন বলেছেন, মনে হচ্ছে ড. কামাল হোসেন তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আমার মনে হয় তার ধারণা সঠিক, কারণ তা না হলে তার মতো একজন লোক ক্ষমতাসীন এই সরকারকে সমর্থন করতে পারেন না এবং বলতে পারেন না যে, এই সরকার এবং জরুরি অবস্থা অনির্দিষ্টকাল যাবৎ বহাল থাকতে পারে। কামাল হোসেন কি সেনাসমর্থিত কোনো সরকারের প্রধান হতে চাইছেন?

মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০০৮ দিন ৪৩২
ফিজিওথেরাপি এবং দাঁতের চিকিৎসার জন্য আমি গিয়েছিলাম হাসপাতালে। ডা. হেলাল সারাক্ষণ ছিল আমার পাশে।
বেগম জিয়া তাঁর দুই ছেলের মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি ছাড়া অন্য কিছু বিবেচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, বেগম জিয়া শুধু একজন রাজনীতিবিদই নন, তিনি একজন মা। তাঁর কাছে তাঁর নিজের জীবনের চাইতে সন্তানদের মূল্য অনেক বেশি।

বুধবার ১৮ জুন ২০০৮ দিন ৪৩৩
নাইকো মামলায় বিচারক প্রচলিত নীতিমালা অনুসরণ না করে শুনানি শুরু করার জন্য চাপ দিলে আদালতে বিশৃঙ্খলার একপর্যায়ে মামলা মুলতবি রাখা হয়। বেগম জিয়ার কাছ থেকে আজ অনেক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পেলাম। সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে তিনি আমাকে জানালেন যে, (১) সেনাপ্রধান বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোতে একটি পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে সেনাবাহিনী মনোনীত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো হবে যাতে করে দু’জনের ক্ষমতার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। আমি তাকে বোঝালাম যে, এমনটি করা হলে সংসদীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে এবং রাষ্ট্র মূলত একটি সামরিক কর্তৃত্বপরায়ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সেনাবাহিনী প্রধানকে প্রেসিডেন্টের পদে পার্লামেন্টের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হলে সামরিক সরকারের কর্তৃত্ব বর্তমান সংবিধানে উল্লিখিত প্রতিটি গণতান্ত্রিক খুঁটিকে উপড়ে ফেলবে। বেগম জিয়া আমাকে জানালেন যে, প্রস্তাবটি তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। (২) নয়া পার্লামেন্টে বর্তমান সরকারের করা প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার ব্যবস্থা রেখে সরকারের দেওয়া প্রতিটি আদেশ, বিধি, সিদ্ধান্ত ইত্যাদিকে বৈধ বিবেচনা করতে হবে। বেগম জিয়া এ নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন যে, এ বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে পার্লামেন্টের হাতে।

চলবে...
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status