বিশ্বজমিন

বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন কৌশল ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়ার

মানবজমিন ডেস্ক

৮ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:৫৮ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন কৌশল ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়ার। তার জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। আঞ্চলিক বিভিন্ন সঙ্কট, নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইন অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটে প্রকাশিত ‘কিক-স্টার্টিং এ নিউ স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স পার্টনারশিপ উইথ বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক মন্তব্য প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন ডেভিড ব্রিউস্টার। তিনি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের সিনিয়র গবেষক। ওই প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বিষয়ক কৌশল আপডেট করা হয়েছে। এতে শনাক্ত করা হয়েছে যে, অস্ট্রেলিয়ার অগ্রাধিকারের এলাকা হবে উত্তর-পূর্বে ভারত মহাসাগর। কিন্তু এই এলাকাটি অস্ট্রেলিয়ার জন্য নিরাপত্তা অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে অনুন্নত। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজ প্রকাশিত এক নতুন রিপোর্টে এই অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থ যাচাই করে দেখা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ক সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি করতে হবে।

ডেভিড ব্রিউস্টার-এর প্রতিবেদনটির বাকি অংশ এখানে তুলে ধরা হলো- কমপক্ষে এক দশক ধরে, দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ভারতের প্রতি যথার্থই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু এখন সময় এসে গেছে ওই কৌশলকে আরো বিস্তৃত করে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোকে তার আওতায় আনার। এর অংশ হতে পারে বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করা। স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথমে যেসব দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম অস্ট্রেলিয়া। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যথাযথভাবে উন্নত করতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া।

বাংলাদেশের সঙ্গে ‘কানেকশন’ উন্নত করা হতে পারে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বিদ্যমান ও উদীয়মান মধ্যম পর্যায়ের শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ। বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের পরিপূরক হতে পারে এই সম্পর্ক। একই সঙ্গে বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার প্রভাবের কিছুটা প্রশমিত করতেও সহায়ক হবে তা। বাংলাদেশে কৌশলগত উল্লেখযোগ্য সমতা আছে অস্ট্রেলিয়ার। তাতে প্রতিফলিত হয় অর্থনৈতিক সুযোগ বা সম্ভাবনা এবং উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগর থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য হুমকি।

এশিয়ায় বড় অর্থনৈতিক সফলতার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। কয়েক দশক ধরে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এই দেশটি পরিণত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে। কোভিড-১৯ সঙ্কটের আগের বছরগুলোতে এখানে বার্ষিক অর্থনৈতিক গড় প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা প্রায় ৭ ভাগ থেকে ৮ ভাগ। এই দেশটি হতে পারে এশিয়ার অর্থনীতির নতুন ‘টাইগার’ এবং অস্ট্রেলিয়ার একটি মূল বা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার।

বিদেশি চাপের প্রতি ভারসাম্য বজায় রেখে উন্নয়ন সাধন করছে বাংলাদেশ। তাই এই দেশটির স্থিতিশীলতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে সমর্থন করতে হবে আমাদের স্বার্থের জন্যই। বঙ্গোপসাগরের পাড়ে ভারত ও চীনের মধ্যে একটি নিভ্রবিন্দুতে (ফালক্রামে) অবস্থিত বাংলাদেশ। এখানে ভারত ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি কোয়াডে বাংলাদেশের যোগ দেয়ার সাহস দেখানো নিয়ে হুমকি দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। কিন্তু সেই হুমকিকে ঢাকা পাত্তাই দেয়নি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের এমন গর্জন হয়তো অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঢাকার মূল্যকে আরো বাড়িয়ে দেবে। একই সঙ্গে এর ফলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

এ অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার আরো নিরাপত্তা বিষয়ক স্বার্থ আছে। এর মধ্যে আছে জলবায়ু পরিবর্তন, মানব ও মাদক পাচার এবং ভয়াবহ কট্টরপন্থার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। এসব ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার ওপর বড় রকম প্রভাব ফেলতে পারে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতি নিধনের ফলে কমপক্ষে ১০ লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এতে অনিয়ন্ত্রিত এই জনগোষ্ঠীর মুভমেন্ট এবং সহিংস উগ্রপন্থায় ঝুঁকে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

সামনের বছরগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বিরূপ আবহাওয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে বড় রকমের প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে স্থান ত্যাগ করতে হবে এবং সৃষ্টি হবে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা।

মিয়ানমারে প্রলম্বিত হয়েছে গণঅসন্তোষ। এই অবস্থা মাদক পাচার এবং শরণার্থী মুভমেন্টের বড় একটি ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় আফিমের সবচেয়ে বড় উৎস হলো মিয়ানমার। এখন মেথামফেটামিনও যাচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারে আইনশৃংখলা ভেঙে পড়লে এসব মাদক দ্রব্যে সয়লাব হয়ে যাবে অস্ট্রেলিয়ার মার্কেট।

এসব হুমকি মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক অংশীদার হিসেবে ক্রমবর্ধমান হারে বাংলাদেশকে প্রয়োজন হতে পারে অস্ট্রেলিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা সম্পর্ক খুবই হাল্কা। সরকারি পর্যায়ে সামরিক সফরের ঘটনা বিরল। এমনকি কোনো প্রতিরক্ষা বিষয়ক আবাসিক প্রতিনিধিও নেই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আরো বিস্তৃত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।

ন্যূনতম ব্যয়ে এই সম্পর্কের সূচনা করা যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে দৃষ্টি দিয়ে এসব কাজ শুরু করতে পারে। সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে, নির্বাচিত ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের নৌসীমানায় নিরাপত্তা সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে, সহযোগিতামুলক আঞ্চলিক সংযুক্তির মধ্যে সুযোগ খুঁজতে পারে।

বাংলাদেশে আছে বিপুল সংখ্যক, পেশাদার এবং সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলা সেনাবাহিনী। যদিও বাংলাদেশে আছে একটি গণতান্ত্রিক বেসামরিক নেতৃত্বাধীন সরকার, তবুও জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার জন্যই শুধু সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক নয়, একই সঙ্গে তারা মূল্যবান একটি উপাদানও।

বর্তমানে কলম্বোতে অবস্থানরত অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টার মাধ্যমে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা অনুকূল নয়। বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য, পূর্ণাঙ্গ যোগাযোগ ও এক্ষেত্রে আরো সুযোগ, সম্ভাবনা আবিষ্কার করার জন্য বাংলাদেশেই অস্ট্রেলিয়ার একজন প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়ন করার কর্মসূচির আলোকে প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রযুক্তি ও উদ্বৃত্ত সরঞ্জাম সরবরাহকারী হিসেবে এটা হতে পারে অস্ট্রেলিয়ার জন্য এক সুযোগ। এখানে অস্ট্রেলিয়ার একজন প্রতিরক্ষা বিষয়ক আবাসিক উপদেষ্টা থাকলে এ অঞ্চলে নিরাপত্তা উন্নয়নে অস্ট্রেলিয়ার দৃশ্যমানতা উন্নত হবে।

আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সামরিক শিক্ষাকে দীর্ঘদিন ব্যবহার করছে অস্ট্রেলিয়া। তাই অস্টেলিয়ান ওয়ার কলেজ, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজ অথবা অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশিন রিসোর্সেস অ্যান্ড সিকিউরিটি’তে বাংলাদেশের সিনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য আমরা সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি বেতন দেয়ার ভিত্তিতে। বাংলাদেশি ও অস্ট্রেলিয়ান শান্তিরক্ষী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কর্মকর্তাদের বিনিময়ের মাধ্যমেও নেটওয়ার্ক উন্নত করা যেতে পারে।

ভবিষ্যতে উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরে ইন্দো-প্যাসিফিক এন্ডেভার কর্মকা-ের অংশ হিসেবে এক বা একাধিক অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজ বন্দর সফর করতে যেতে পারে।

নির্বাচিত নৌসীমানা নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে টার্গেটেড সক্ষমতামূলক কর্মসূচি নিতে পারে অস্ট্রেলিয়া, যেখানে সরাসরি স্বার্থ আছে অস্ট্রেলিয়ার। নৌ সীমানায় সচেতনতা, অনুসন্ধান, উদ্ধার ও বন্দরের নিরাপত্তায় অস্ট্রেলিয়া তার অভিজ্ঞতা এবং বিশেষজ্ঞ শক্তি প্রদর্শন করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে মূল্যবান বিশেষজ্ঞ সরবরাহ দিতে পারে অস্ট্রেলিয়া।

২০২১ সালে ইন্ডিয়ান ওশিন রিম এসোসিয়েশনের চেয়ারের ভারগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এটা নৌসীমানায় নিরাপত্তা, ব্লু ইকোনমি এবং পরিবেশগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি সমন্বিত উদ্যোগের সুযোগ এনে দিতে পারে। এ অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার নবায়িত স্বার্থের বিষয়ে একটি ব্যবহার উপযোগী মাধ্যম হতে পারে বিমসটেক। এটি উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক গ্রুপের জোট।

দক্ষিণ এশিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং কয়েক বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম ফোকাস ভারত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যদি এই অঞ্চলে সম্ভাবনা ও ঝুঁকির বিষয় বিবেচনা করি তাহলে ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশিগুলোরও আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আঞ্চলিক সম্পর্ক এবং বাড়তি অন্যান্য সুযোগ এনে দিতে পারে বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কের উন্নয়ন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status