মত-মতান্তর

পর্যালোচনা 

ভোটার তালিকা হস্তান্তর  অসাংবিধানিক

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

৫ জুন ২০২১, শনিবার, ৫:৪০ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের সংবিধানের নির্দেশনা মোতাবেক ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, ভোটার তালিকা সংক্রান্ত নির্দেশ এবং ভোটার তালিকা নিয়ন্ত্রণসহ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত।
সুতরাং প্রজাতন্ত্রের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা নির্বাহী বিভাগের কোন মন্ত্রণালয়ের অধীন ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বা এ সংক্রান্ত কোন নির্দেশনা বা ভোটার তালিকা সংরক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণে কারো কোন সাংবিধানিক এখতিয়ার নেই।

নির্বাচন সম্পর্কিত গোটা পদ্ধতি অর্থাৎ ভোটার তালিকাসহ গোটা নির্বাচন যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ তদারকির জন্য সংবিধান একটি স্বাধীন সংস্থা গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে যা হচ্ছে 'নির্বাচন কমিশন'। তা সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ নিশ্চিত করেছে এবং ১১৯ অনুচ্ছেদ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতার আওতায় নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ হবে অবৈধ।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় থাকা ডিজিটাল ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয় পত্রের কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের হস্তান্তর করার বিষয়টি একেবারেই 'বেআইনি' এবং 'আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত'।
সরকারের নির্বাহী বিভাগ সংবিধান এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রশ্নে কত উদাসীন তা প্রমাণিত হয়েছে এই ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে।

 এ প্রকল্প শুরু হয়েছে ভোটার তালিকা তৈরির পরিকল্পনায়। প্রথমে 'ভোটার আইডি' পরে জাতীয় পরিচয় পত্র যুক্ত করা হয়। নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতায় ডিজিটালের এই অগ্রযাত্রায় ইতিহাস রচিত হয়েছে। ৮ কোটির বেশি ভোটারকে ছবিসহ আইডি দিয়ে এক বৃহত্তম তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলেছে নির্বাচন কমিশন।
 'ভোটার তালিকা' এবং 'জাতীয় পরিচয় পত্র' (এনআইডি) একটি সমন্বিত ও অবিচ্ছেদ্য প্রজেক্ট। এ মুহুর্তে এদের বিচ্ছিন্ন করার কোন অবকাশ নেই। এই প্রজেক্টের তত্ত্বাবধান শুধুমাত্র পরিচালিত হবে নির্বাচন কমিশন দ্বারা।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে যে চিঠি দিয়েছে তা সংবিধানের সাথে চরমভাবে সাংঘর্ষিক। নির্বাচন কমিশন বরাবর চিঠিতে বলা হয়েছে জাতীয় পরিচয় পত্র আইন ২০১০, সংবিধানের১১৯(২) অনুযায়ী পাসকৃত তা উদ্ধৃত করে জাতীয় পরিচয় পত্র প্রস্তুত, তদারকি জারি করা সব দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে 'সরকার' শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা সহ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে পরিচয় সংক্রান্ত কাজ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। এই আইন সংবিধানের দৃষ্টিতে বেআইনি।

প্রথমত এই আইন কোনক্রমেই সংবিধানের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করতে পারবে না। সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি  ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে..অর্থাৎ ভোটার তালিকা প্রস্তুত, তত্ত্বাবধান নির্দেশ নিয়ন্ত্রণসহ সবকিছু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। 
সুতরাং ভোটার তালিকা সম্পৃক্ত বা সমন্বিত কোন প্রকল্প নির্বাচন কমিশন ছাড়া অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হতে পারবে না।

সরকার অবশ্যই 'জাতীয় পরিচয় পত্রে'র কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত করতে পারবে, কিন্তু ভোটার তালিকার সাথে সম্পৃক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেনা। দেশে টাকার এবং অপচয়ের কোনো অভাব নেই। সুতরাং জাতীয় পরিচয় পত্রের জন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ করাই হবে সরকারের জন্য সুবিধাজনক। 

ভোটার তালিকার সাথে যুক্ত নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অর্পণ করার সরকারের এ উদ্যোগ  কমিশনকে নখ দন্তবিহীন অস্তিত্বহীন কমিশনে রূপান্তর করবে।

সংবিধানে ১১৯(২) অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন 'জাতীয় পরিচয় পত্রে'র কাজ সম্পাদন করারও দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং তা করছেও। কারণ ১১৯(২)-এ  বলা হয়েছে উপরিউক্ত দফা সমূহ নির্ধারিত দায়িত্ব সমূহের অতিরিক্ত দায়িত্ব সংবিধান বা অন্য কোন আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে, নির্বাচন কমিশন সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব হচ্ছে১১৯(১)
(ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন;
(খ) সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন;
(গ) সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন; এবং
(ঘ) রাষ্ট্রপতির পদে এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করিবেন।
ভোটার তালিকা এবং নির্বাচনের নির্ধারিত কাজের বাইরে নির্বাচন কমিশন 'জাতীয় পরিচয় পত্রে'র অতিরিক্ত কাজ করতে পারে তা সংবিধানের ১১৯(২) নির্দেশনা রয়েছে। মূল দায়িত্বের বাইরে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সমূহ সম্পাদন করে দেয় সংবিধানের ১১৯(২) দুই মোতাবেক।

দীর্ঘদিন নির্বাচন কমিশনের অধীনে পরিচালিত একটি প্রকল্প স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানান্তর করার প্রশ্নে অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। 
রাতের আঁধারে এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন থাকার প্রয়োজনীয়তা ও শেষ হয়ে গেছে। তবু নির্বাচন কমিশনের এই বিষয়ে করণীয় হতে পারে:
(১)  ভোটার তালিকা সমন্বিত কোন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন ছাড়া অন্য কোন মন্ত্রণালয় তত্ত্বাবধান বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সংবিধানের ১১৯ মোতাবেক ভোটার তালিকা সম্বলিত কোন প্রকল্প অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করার সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি প্রদান করতে পারেন। 

(২) উচ্চতর আদালতে সংবিধানিক প্রশ্নের মীমাংসার উদ্যোগ নিতে পারেন। ‌

বিশ্ব ব্যাংক এবং দাতা দেশ  নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব উদ্ভাবিত প্রকল্পে সহযোগিতা করেছে। সুতরাং এ প্রকল্পের উত্তরাধিকার নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের প্রকল্প হঠাৎ করে  অন্য মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হলে দাতাদের বিনিয়োগের নৈতিক উদ্দেশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

২০০৭ সালে নির্বাচন কমিশন এর তত্ত্বাবধানে এই কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ১৩ বছর ধরে যথেষ্ট দক্ষতার সাথে নির্বাচন কমিশন বিশাল আয়োজন সম্পন্ন করে যাচ্ছে। সরকার যদি ভোটার তালিকা হস্তান্তরের এই উদ্যোগ থেকে সরে না আসে তাহলে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং তত্ত্বাবধানের দায়িত্বটুক কেড়ে নিলে নির্বাচনের কফিনে শেষ পেরেকটির মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সমাধি রচিত হবে। তারপর সরকার নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন করে উজ্জ্বল কীর্তির স্বাক্ষর রাখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে!

লেখক; গীতিকার
[email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status