শেষের পাতা

কেন বারবার বাঁধ ভাঙে?

পিয়াস সরকার, কয়রা, খুলনা থেকে

২৮ মে ২০২১, শুক্রবার, ৯:১৭ অপরাহ্ন

ভাঙা বাঁধের দিকে অপলক চেয়ে থাকা। খুলনার কয়রা থেকে ছবিটি তুলেছেন জীবন আহমেদ

ছোট পিচঢালা রাস্তা। এক পাড়ে কপোতাক্ষ নদ আরেক পাড়ে রিয়াদুল ইসলামের বাড়ি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাড়ির দিকে। ধীরে ধীরে পানি ঢুকছে বাড়িতে। করার কিছুই নেই। বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে পানি। গ্রাস করে নিচ্ছে আবাস।

সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার দশালিয়া গ্রামে রিয়াদুল ইসলামের বাড়ি। তিনি বলেন, প্রায় বছর গ্রামে পানি ঢোকে। বাঁধ দেই আমরা। এই বাঁধ দিয়ে তো আর স্রোত আটকানো যায় না ছেলেকে কোলে নিয়ে রাস্তার ধারে বসে ছিলেন ঝুমা দাস। চারিদিকে পানি আর পানি। অপেক্ষা জোয়ার শেষ হবার। একই উপজেলার মঠবাড়ি গ্রাম। গ্রামের ভেতর বাড়িগুলোর মাথা শুধু উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি সব পানিতে নিমজ্জিত। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সচল ছিল গ্রামের সড়কটি। কিন্তু ঘণ্টা পেরিয়ে জোয়ার আসতেই রাস্তায় হাঁটু পানি। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাতে প্রায় ৮টি ক্ষতের সৃষ্টি হয় যা দিয়ে ঢুকতে থাকে পানি।

সুন্দরবনের তীর ঘেঁষা কয়রা উপজেলা। আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে রেখেছে কপোতাক্ষ নদ। এই নদই যেন সকল কষ্টের কারণ। গতকাল সকালে নদের তীরে ক্ষয়ে যাওয়া বাঁধ সংস্কার করছিলেন প্রায় ৪০ জন নারী-পুরুষ। তাদের মাঝে জোসনা বেগম বলেন, প্রত্যেক বছর বাঁধ ভাঙে। আর অল্প কয়টা ত্রাণ দেয়। আমরা ত্রাণ চাই না আমরা বাঁধ চাই।

দশালিয়া গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, বাঁধ দেও নইলে বিষ দেও। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই একটা বাঁধের জন্য সারাটা জীবন কষ্ট করলাম। কত নেতা আইলো গেল বাঁধ আর হইলো না।
মঠবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, পানি তো ঢুকবেই এই রাস্তায় গত ৩০ বছরেও একটু মাটি পড়েনি সরকারিভাবে।

বাঁধের জন্য কান্না সর্বত্র। কপোতাক্ষ নদের হাত থেকে নিজেদের গ্রাম বাঁচাতে ঝড়ের শঙ্কা মাথায় নিয়ে বাঁধ সংস্কার করেন এলাকাবাসী। দশালিয়া গ্রামের লোকেরাও বাঁধের কাজ নিজেরা করলেও ঠেকাতে পারেনি পানি।

গতকাল সরজমিন দেখা যায়, কপোতাক্ষ দিয়ে দশালিয়া গ্রামে পানি ঢুকছে। এতে প্লাবিত হবে ৩০-৩৫টি গ্রাম। যেখানে বাস করেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। আর মঠবাড়ি এলাকায় চোখের পলকে প্লাবিত হয়ে যায় সব, ভেঙে পড়ে সড়ক ও যোগাযোগ।

কিন্তু কেন ভাঙে এই বাঁধ? এর জবাবে সকলের উত্তর বাঁধই বানানো হয় না ভাঙবে কি? এ ছাড়াও তারা প্রতিটি বাঁধে নিজেরা নিজেদের রক্ষায় বাঁধ তোলেন, মাটি ফেলেন, সংস্কার করেন। শহিদুল ইসলাম নামে এক বাসিন্দা বলেন, দেশে সকল উন্নয়ন হয় খালি বাঁধটাই হয় না। শুধু তাই নয় এই যে মাটি ফেলা, বালুর বস্তা ফেলা এইটুকু যে সরকার করে সেটাও বন্যা আসলে এর আগে তো করে না। নিজেরা বাঁধ দিলে তো আর পানির সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না। এখন পানি উঠছে ওরা বস্তা দিতেছে। এইটুকুই করবে আগে যদি করতো তাওতো এত খারাপ অবস্থা হতো না।

গতকাল দেউলিয়া বাজার এলাকার সড়কে হাতে হাত মিলে সড়কের ধারে বালুর বস্তা ফেলছিলেন এলাকার যুবকরা। প্রায় ১০০ জন তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী গাজী হাফিজ বলেন, দেশে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণে দুর্নীতি হয়। আর কয়রা এলাকায় বাঁধই হয় না। বাঁধ নির্মাণের আগেই দুর্নীতি।
বাঁধ কেন ভাঙে? এই প্রশ্নের জবাবে সবাই বাঁধ নির্মাণ না হওয়াকে দায়ী করেন। তাদের সকলের দাবি স্থায়ী বাঁধ চাই। এরপরও বেশকিছু বিষয়ের জবাব মেলে। ষাটোর্ধ্ব দোকানদার মো. আলিম বলেন, এখানে প্রচুর ঘের রয়েছে। এই ঘেরের চাষের জন্য পাইপ দিয়ে মাটি থেকে লবণাক্ত পানি উঠানো হয় যার ফলে গোটা এলাকার পানি লবণাক্ত হয়। লবণাক্ত পানির টেমপার থাকে না, তাই অল্পতেও ভেঙে যায়। আবার বাঁধের খুঁটি হিসেবে কাজ করে গাছ। কিন্তু অতিরিক্ত লবণের জন্য গাছও বেড়ে ওঠে না এসব বাঁধে। একে মাটির টেমপার নাই দুই এই মাটিতে গাছ হয় না।
সুলতানা বিবি বলেন, বাঁধের নিচ দিয়া পানি টানার পাইপ বসাইছে ঘেরওয়ালারা। বাঁধে অসংখ্য পাইপের ফুটার জন্য বাঁধের শক্তি কমে যায়।

২০১০ সালের বন্যায় কোলের নাতিকে পানিতে হারিয়েছেন রুমা আক্তার। তিনি বলেন, বউটার কোল থেকে পড়ে গেল আর বাচ্চাটা মারা গেল। তাওতো বাঁধ হয় না। প্রতিবছর মহিলা মানুষ হয়ে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে চলা লাগে। এই লজ্জা আমার না অই অফিসে বসে থাকা লোকগুলার হওয়া উচিত।
এই এলাকায় বাঁধ ভাঙার প্রধান কারণ বাঁধ নির্মাণ না হওয়া। কিন্তু কেন হয় না বাঁধ নির্মাণ? এই প্রশ্নের জবাবে দশালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার নিজের বাড়িতে হাঁটু পানি। আমার চিংড়ির ঘেরে পানি। আমাদের লাখ লাখ টাকার চাষ নষ্ট হলো। কিন্তু বাঁধ হয় না। আমি উপর মহলের একাধিকবার আবেদন করার পর বাজেট শেষ, এ সমস্যা ও সমস্যা ইত্যাদি কারণ দেখায়।

মঠবাড়ি গ্রামের সড়ক দুইভাগে বিভক্ত। পাকা সড়ক থেকে বেরিয়ে ইট বিছানো সড়ক। এরপর একটা গেছে সোজা দক্ষিণ দিকে আরেকটা পশ্চিমে। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আলিমুল ইসলাম বলেন, ওরা (পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনা) ইটের রাস্তার বাঁধ দিছে একপাশে। বাকি দুই রাস্তার খোঁজ নেই। চারপাশ থেকে পানি আসলে এই ইটের রাস্তার বাঁধ তো ভাঙবেই। তিন দিকের পানির চাপ কীভাবে নেবে এই রাস্তা। এই রাস্তার দরকার কি? লুঙ্গি মাথায় দিলে তো আর সম্মান বাঁচে না। তার সঙ্গে থাকা অলিয়ার ইসলাম দক্ষিণ দিকের সড়কটি দেখিয়ে বলেন, ভাঙবে না? এই রাস্তায় গত ৩০ বছরেও একটু মাটি ফেলায় নাই।

বাঁধ ভাঙার প্রশ্ন না করে, প্রশ্ন করা উচিত বাঁধ কেন হয় না। কারণ এখন যেটা দেখছেন যা ভেঙে পানি ঢুকেছে এটা বাঁধ না। এটা মানুষের জীবন রক্ষার কবচ। যা তারা নিজেরা বানিয়েছে। আমরা চাই স্থায়ী টেকসই বাঁধ। এমনটাই দাবি তুলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রক্তিম খান। সড়কের উপর মাটি দিয়ে উঁচু করতে করতে তিনি বলেন, এটা বাঁধ হলে মাটির দলা দিয়ে উঁচু করা লাগতো না কারণ বাঁধ আমাদের হয়ে এই কষ্টটা করতো। বারবার বাঁধ ভাঙে এটা ভুল কথা। বাঁধ ভাঙবে তখন যখন বাঁধ নির্মাণ হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী পরিচালক মো. শাহজাহান হোসেন বলেন, পানি রক্ষায় আমরা জনগণের মাঝে বিনামূল্যে প্লাস্টিকের বস্তা, জিও বস্তা দিচ্ছি। যাতে তারা স্বেচ্ছা শ্রমে হলেও বাঁধ রক্ষা করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, বাঁধ নির্মাণের নির্দেশনা এলে অবশ্যই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এখন এই মুহূর্তে আমরা চলমান ক্ষতি নিরসনে কাজ করছি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ বছরে যে তহবিল বরাদ্দ হয়েছে তা দিয়ে প্রায় ৩-৪ হাজার মাইল টেকসই উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করা যেতো, অথচ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে সবচেয়ে কম বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে এবং বরাদ্দকৃত তহবিল যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status