অনলাইন
বার্তা সংস্থা এপি’তে কর্মরত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের করুণ বয়ান
ফারেস আকরাম
১৮ মে ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৪৯ পূর্বাহ্ন
শুক্রবার সকালে গাজা উপত্যকার উত্তর দিকে অবস্থিত আমাদের খামারবাড়ি ছিন্নভিন্ন গাছ আর এবড়োখেবড়ো ধাতুর স্তুপ বানিয়ে রেখে গেছে এক ইসরাইলি বিমান হামলা। ইসরাইলি বোমা পড়ে উঠোনে গর্ত হয়ে গেছে। রেখে গেছে ধ্বংসাবশেষ। আবারও সংঘাত শুরু হয়েছে।
প্রথম গাজা যুদ্ধে আমি শিখেছিলাম যে, আমাদের ঘন সাইট্রাস বাগান শহুরে জীবনের ঘনবসতি ও সমস্যা থেকে কিছুটা নিস্তার দিলেও, সেগুলো আদৌ কোনো আশ্রয়ের জায়গা ছিল না। এর আগে ২০০৯ সালে ৩রা জানুয়ারি এক ইসরাইলি বিমান হামলায় আমার বাবা আকরাম আল-ঘৌল মারা যান। যুদ্ধ চরম রূপ নেওয়ার পরও গবাদি পশু ও মুরগিদের দেখভাল করা এবং গাছগুলোর যত্ন নেওয়ার জন্য জোর করে খামারে থেকে গিয়েছিলেন তিনি।
ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার তিনটি যুদ্ধ ও অসংখ্য লড়াইয়ে সবমিলিয়ে আমার ছয় জন আত্মীয়, তিন জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বেশ কয়েকজন সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবার সহিংসতায় ঘর হারানো, সন্তান হারানো বা প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের মর্মবেদনা নিয়ে আমি সাংবাদিক হিসেবে প্রতিবেদন লিখি। প্রতিবার আমি ভাবি, ‘ওই ব্যক্তির জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম।’ বোমা, ড্রোন আর কামান যখন পুরনো ব্যথা ও ভয় জাগিয়ে তোলে, আমি তখন কাজের মাঝে আশ্রয় খুঁজি।
গাজা শহরে একমাত্র এসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) কার্যালয়টিতে আমি কিছুটা নিরাপদ বোধ করি। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর কাছে উঁচু ভবনগুলোর কো-অর্ডিনেট আছে। আচমকা সেগুলো বোমায় ধসে পড়ার আশঙ্কা কম। গাজার মানুষের সাথে কথা বলা, যে ভূখণ্ড থেকে তারা বের হতে পারবে না, সেখান থেকে তাদের গল্প বাইরে ছড়িয়ে দেওয়াই আমাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। এখানে কী ঘটছে তা পুরো বিশ্বকে জানিয়ে আমি খানিকটা সান্ত্বনা পাই।
কিন্তু এই কাজেরও মূল্য দিতে হয়। সাম্প্রতিক সহিংসতার বিস্ফোরণ আমার মানসিক শক্তি শুষে নিয়েছে। আবার ২০১৪ সালের মতো সহিংসতা নিয়ে কাজ করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। ওই বছর গাজার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতায় ২ হাজার ২০০ জন ফিলিস্তিনি মারা গিয়েছিল। আমি আবার ওই নির্ঘুম, নারকীয় বোমা হামলা, রক্তাক্ত হাসপাতাল ও লাশভর্তি মর্গের সাত সপ্তাহে ফিরে যাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু হয়তো আমার কাছে ফিরে যাওয়া ব্যতিত কোনো উপায় নাও থাকতে পারে।
এখন ভয়াবহ এই রাতগুলোয় আমি একা থাকায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিরাপদে কানাডায় বাস করে। চলতি সপ্তাহের এই যুদ্ধের মাঝে গাজায় ঈদুল ফিতর উদযাপন হচ্ছে। আমার মেয়েরা এখন আর বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে না। বোমা পড়ার সময় চিৎকার করে উঠে না। আতঙ্কে অন্ধকারে জড়ো হয়ে থাকে না। তারা এখন চকলেট খায়। নতুন জামা পরে।
মাঝে মাঝে তাদের অনুপস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠলে তাদের বিদেশ পাঠিয়ে নিজে এই অবরুদ্ধ উপত্যকায় আটকে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস করেছি। তাদের দেখতে যেতে হলে (অনুমতি নেওয়ার জন্য) আমায় কয়েক মাস ধরে নানা প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু চলতি সপ্তাহের মতো সময়গুলোয় যখন আমার মা ও বোনের জন্য উদ্বিগ্ন থাকি, তখন ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিশ্চিতভাবেই স্বস্তি অনুভব করি। আমার মা ও বোন গাজায় থাকেন। অন্তত আমার মেয়েরা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ঝুঁকিতে নেই।
আমি জানি তাদের হৃদয় এখনো এখানেই পড়ে আছে। শুক্রবার আমি বোমা হামলায় ধ্বংস হওয়া খামারের ছবি শেয়ার করার পর আমার ৯ বছর বয়সী মেয়ে কান্নারত অবস্থায় আমায় ফোন দিয়েছে। তিন বছর আগে খামারে একটি দেবদারু গাছ লাগিয়েছিল। বোমা হামলায় সেটি ভেঙে গেছে।
আমার বাবার মতো আমিও গাজাতেই বড় হয়েছি। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন সীমান্তের ঠিক কাছেই, ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরপর পালিয়ে আসা হাজারো ফিলিস্তিনির মতো। এক দশক পর তিনি উপত্যকাটির উত্তরাংশে বেইত লাহিয়ায় সাইট্রাস রোপন করা শুরু করেন।
বাবা চাইতেন সীমান্তের যতটা কাছাকাছি থাকা যায়- তার আসল গ্রামের কাছাকাছি, যেটা এখন ইসরাইলের অংশ। এ চাওয়া থেকেই এ ভূখণ্ডের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকাগুলোর একটিতে খামার তৈরি করেন তিনি। ছাদ সমান উচ্চতা থেকে তাকালে সামনেই দেখা যায় ইসরাইলি সীমান্ত। বেষ্টনী আর সেনাভর্তি টাওয়ার নিয়ে অশুভ কোনো ভিস্তার মতো।
বিশ্বের কাছে এখন গাজা যেভাবে পরিচিত- জীর্ণ, ইসরাইলি-মিসরিয় অবরোধের শিকার, সবসময় সংঘাতে জর্জরিত- আমার শৈশবের গাজা এমন ছিল না। মানুষজন এখন এটা শুনলে বিশ্বাসই করতে পারে না যে, কিশোর বয়সে, শতকের শুরুর দিকে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূত্রপাতের আগ দিয়ে আমি গাজার বিমানবন্দর (হ্যা, বিমানবন্দর) থেকে বিমানে করে ইস্তাম্বুলে একটি সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় ফিরে আসতে পারতাম।
এখন হাজারো ফিলিস্তিনিকে রাফাহ নামের লোহার গেট পেরিয়ে মিসরে ঢুকার অনুমতির জন্য বিকট এক লাউডস্পিকারে তাদের নাম শোনার জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। রাফাহ দিয়ে প্রবেশের পর উত্তর সিনাইয়ে আইনবর্জিত মরুভূতি দিয়ে পথ পারি দিতে হয়।
ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ যখন বিশ্বের নজর কাড়তে শুরু করলো, আমি তখন আমার টিভি প্রযোজক চাচা মারওয়ান আলঘৌলের সাথে সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়লাম। ক্যারিয়ারজুড়ে স্বদেশের জন্য একাধিকবার আশা জেগে উঠেছে আমার মাঝে। ২০০৫ সালে ইসরাইল সেনা প্রত্যাহারের পরপরই ভূখণ্ডটিতে ব্যাপক ত্রাণ আসতে শুরু করে। রাফাহ খুলে দেয় মিসর। আমিও কিছুটা স্বাভাবিক জীবন-যাপনের কথা ভাবতে করতে শুরু করি।
কিন্তু দুই বছর পর গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় যোদ্ধা গোষ্ঠী হামাস। পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপ হতে শুরু করে। এই দলটি গাজার উপর স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে অবরোধ জারি করে রাখা ইসরাইলের মোকাবিলা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
এখন আমার প্রতিদিনকার কাজ হচ্ছে, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যকার সংঘাতের অন্তহীন ট্র্যাজেডি রেকর্ড করা। গাজার বাসিন্দারা আমার প্রায়ই অভিজ্ঞতার বদলে আশা তুলে ধরতে বলে। ভালো কোনো ভবিষ্যতে বিশ্বাস করতে বলে। তিন যুদ্ধে জর্জরিত হওয়ার পর, আমি তাদের উপদেশ শোনা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন কেবল দূরে কোথাও ভিন্ন কোনো জীবনের কথা ভেবে আশা খুঁজি।
এ সংঘাতে কোনো পরিবর্তন আসে না। ইসরাইল ও হামাসের এই সহিংস গোলকধাঁধায় আরো অনেককিছুই স্থির হয়ে থাকে। ২০১৪ সালে এক ইসরাইলি বোমা হামলায় আমার চাচার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি ধৈর্য্য সহকারে আংশিক ক্ষতিপূরণের অপেক্ষা করতে থাকেন, আবার বাড়ি নির্মাণের জন্য। তিন বছর পর ইন্সটলমেন্ট আসতে শুরু করে। তিনি বেশিরভাগটাই মেরামত করতে পেরেছিলেন।
বৃহস্পতিবার রাতে এক ইসরাইলি ট্যাংকের ছোড়া গোলা সেটিতে আবার আঘাত হেনেছে।
(ফারেস আকরাম বার্তাসংস্থা এপি’র একজন সাংবাদিক। গাজায় এপি’র যেই কার্যালয়ে বসে তিনি কাজ করতেন, সেই কার্যালয়ে এই লেখা প্রকাশের পরদিনই বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।)
প্রথম গাজা যুদ্ধে আমি শিখেছিলাম যে, আমাদের ঘন সাইট্রাস বাগান শহুরে জীবনের ঘনবসতি ও সমস্যা থেকে কিছুটা নিস্তার দিলেও, সেগুলো আদৌ কোনো আশ্রয়ের জায়গা ছিল না। এর আগে ২০০৯ সালে ৩রা জানুয়ারি এক ইসরাইলি বিমান হামলায় আমার বাবা আকরাম আল-ঘৌল মারা যান। যুদ্ধ চরম রূপ নেওয়ার পরও গবাদি পশু ও মুরগিদের দেখভাল করা এবং গাছগুলোর যত্ন নেওয়ার জন্য জোর করে খামারে থেকে গিয়েছিলেন তিনি।
ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার তিনটি যুদ্ধ ও অসংখ্য লড়াইয়ে সবমিলিয়ে আমার ছয় জন আত্মীয়, তিন জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বেশ কয়েকজন সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবার সহিংসতায় ঘর হারানো, সন্তান হারানো বা প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের মর্মবেদনা নিয়ে আমি সাংবাদিক হিসেবে প্রতিবেদন লিখি। প্রতিবার আমি ভাবি, ‘ওই ব্যক্তির জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম।’ বোমা, ড্রোন আর কামান যখন পুরনো ব্যথা ও ভয় জাগিয়ে তোলে, আমি তখন কাজের মাঝে আশ্রয় খুঁজি।
গাজা শহরে একমাত্র এসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) কার্যালয়টিতে আমি কিছুটা নিরাপদ বোধ করি। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর কাছে উঁচু ভবনগুলোর কো-অর্ডিনেট আছে। আচমকা সেগুলো বোমায় ধসে পড়ার আশঙ্কা কম। গাজার মানুষের সাথে কথা বলা, যে ভূখণ্ড থেকে তারা বের হতে পারবে না, সেখান থেকে তাদের গল্প বাইরে ছড়িয়ে দেওয়াই আমাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। এখানে কী ঘটছে তা পুরো বিশ্বকে জানিয়ে আমি খানিকটা সান্ত্বনা পাই।
কিন্তু এই কাজেরও মূল্য দিতে হয়। সাম্প্রতিক সহিংসতার বিস্ফোরণ আমার মানসিক শক্তি শুষে নিয়েছে। আবার ২০১৪ সালের মতো সহিংসতা নিয়ে কাজ করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। ওই বছর গাজার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতায় ২ হাজার ২০০ জন ফিলিস্তিনি মারা গিয়েছিল। আমি আবার ওই নির্ঘুম, নারকীয় বোমা হামলা, রক্তাক্ত হাসপাতাল ও লাশভর্তি মর্গের সাত সপ্তাহে ফিরে যাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু হয়তো আমার কাছে ফিরে যাওয়া ব্যতিত কোনো উপায় নাও থাকতে পারে।
এখন ভয়াবহ এই রাতগুলোয় আমি একা থাকায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিরাপদে কানাডায় বাস করে। চলতি সপ্তাহের এই যুদ্ধের মাঝে গাজায় ঈদুল ফিতর উদযাপন হচ্ছে। আমার মেয়েরা এখন আর বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে না। বোমা পড়ার সময় চিৎকার করে উঠে না। আতঙ্কে অন্ধকারে জড়ো হয়ে থাকে না। তারা এখন চকলেট খায়। নতুন জামা পরে।
মাঝে মাঝে তাদের অনুপস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠলে তাদের বিদেশ পাঠিয়ে নিজে এই অবরুদ্ধ উপত্যকায় আটকে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস করেছি। তাদের দেখতে যেতে হলে (অনুমতি নেওয়ার জন্য) আমায় কয়েক মাস ধরে নানা প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু চলতি সপ্তাহের মতো সময়গুলোয় যখন আমার মা ও বোনের জন্য উদ্বিগ্ন থাকি, তখন ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিশ্চিতভাবেই স্বস্তি অনুভব করি। আমার মা ও বোন গাজায় থাকেন। অন্তত আমার মেয়েরা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ঝুঁকিতে নেই।
আমি জানি তাদের হৃদয় এখনো এখানেই পড়ে আছে। শুক্রবার আমি বোমা হামলায় ধ্বংস হওয়া খামারের ছবি শেয়ার করার পর আমার ৯ বছর বয়সী মেয়ে কান্নারত অবস্থায় আমায় ফোন দিয়েছে। তিন বছর আগে খামারে একটি দেবদারু গাছ লাগিয়েছিল। বোমা হামলায় সেটি ভেঙে গেছে।
আমার বাবার মতো আমিও গাজাতেই বড় হয়েছি। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন সীমান্তের ঠিক কাছেই, ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরপর পালিয়ে আসা হাজারো ফিলিস্তিনির মতো। এক দশক পর তিনি উপত্যকাটির উত্তরাংশে বেইত লাহিয়ায় সাইট্রাস রোপন করা শুরু করেন।
বাবা চাইতেন সীমান্তের যতটা কাছাকাছি থাকা যায়- তার আসল গ্রামের কাছাকাছি, যেটা এখন ইসরাইলের অংশ। এ চাওয়া থেকেই এ ভূখণ্ডের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকাগুলোর একটিতে খামার তৈরি করেন তিনি। ছাদ সমান উচ্চতা থেকে তাকালে সামনেই দেখা যায় ইসরাইলি সীমান্ত। বেষ্টনী আর সেনাভর্তি টাওয়ার নিয়ে অশুভ কোনো ভিস্তার মতো।
বিশ্বের কাছে এখন গাজা যেভাবে পরিচিত- জীর্ণ, ইসরাইলি-মিসরিয় অবরোধের শিকার, সবসময় সংঘাতে জর্জরিত- আমার শৈশবের গাজা এমন ছিল না। মানুষজন এখন এটা শুনলে বিশ্বাসই করতে পারে না যে, কিশোর বয়সে, শতকের শুরুর দিকে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূত্রপাতের আগ দিয়ে আমি গাজার বিমানবন্দর (হ্যা, বিমানবন্দর) থেকে বিমানে করে ইস্তাম্বুলে একটি সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় ফিরে আসতে পারতাম।
এখন হাজারো ফিলিস্তিনিকে রাফাহ নামের লোহার গেট পেরিয়ে মিসরে ঢুকার অনুমতির জন্য বিকট এক লাউডস্পিকারে তাদের নাম শোনার জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। রাফাহ দিয়ে প্রবেশের পর উত্তর সিনাইয়ে আইনবর্জিত মরুভূতি দিয়ে পথ পারি দিতে হয়।
ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ যখন বিশ্বের নজর কাড়তে শুরু করলো, আমি তখন আমার টিভি প্রযোজক চাচা মারওয়ান আলঘৌলের সাথে সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়লাম। ক্যারিয়ারজুড়ে স্বদেশের জন্য একাধিকবার আশা জেগে উঠেছে আমার মাঝে। ২০০৫ সালে ইসরাইল সেনা প্রত্যাহারের পরপরই ভূখণ্ডটিতে ব্যাপক ত্রাণ আসতে শুরু করে। রাফাহ খুলে দেয় মিসর। আমিও কিছুটা স্বাভাবিক জীবন-যাপনের কথা ভাবতে করতে শুরু করি।
কিন্তু দুই বছর পর গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় যোদ্ধা গোষ্ঠী হামাস। পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপ হতে শুরু করে। এই দলটি গাজার উপর স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে অবরোধ জারি করে রাখা ইসরাইলের মোকাবিলা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
এখন আমার প্রতিদিনকার কাজ হচ্ছে, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যকার সংঘাতের অন্তহীন ট্র্যাজেডি রেকর্ড করা। গাজার বাসিন্দারা আমার প্রায়ই অভিজ্ঞতার বদলে আশা তুলে ধরতে বলে। ভালো কোনো ভবিষ্যতে বিশ্বাস করতে বলে। তিন যুদ্ধে জর্জরিত হওয়ার পর, আমি তাদের উপদেশ শোনা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন কেবল দূরে কোথাও ভিন্ন কোনো জীবনের কথা ভেবে আশা খুঁজি।
এ সংঘাতে কোনো পরিবর্তন আসে না। ইসরাইল ও হামাসের এই সহিংস গোলকধাঁধায় আরো অনেককিছুই স্থির হয়ে থাকে। ২০১৪ সালে এক ইসরাইলি বোমা হামলায় আমার চাচার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি ধৈর্য্য সহকারে আংশিক ক্ষতিপূরণের অপেক্ষা করতে থাকেন, আবার বাড়ি নির্মাণের জন্য। তিন বছর পর ইন্সটলমেন্ট আসতে শুরু করে। তিনি বেশিরভাগটাই মেরামত করতে পেরেছিলেন।
বৃহস্পতিবার রাতে এক ইসরাইলি ট্যাংকের ছোড়া গোলা সেটিতে আবার আঘাত হেনেছে।
(ফারেস আকরাম বার্তাসংস্থা এপি’র একজন সাংবাদিক। গাজায় এপি’র যেই কার্যালয়ে বসে তিনি কাজ করতেন, সেই কার্যালয়ে এই লেখা প্রকাশের পরদিনই বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।)