বিশ্বজমিন

বড় পোশাক ব্র্যান্ডগুলোর এখনও বাংলাদেশের শ্রমিকদেরই প্রয়োজন 

অ্যাডাম মিন্টার

১৫ মে ২০২১, শনিবার, ৩:২২ অপরাহ্ন

করোনাভাইরাস লকডাউনের দ্বিতীয় মাসে পা রেখেছে বাংলাদেশ। এরফলে বন্ধ আছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণ-পরিবহন এবং বেশিরভাগ কর্মস্থল। কিন্তু, দেশটির গার্মেন্টস উৎপাদকদের লবিংয়ের কারণে এর মধ্যেও সচল আছে পোশাক কারখানাগুলো। সেখানে দৈনিক কাজে যোগ দিচ্ছেন লাখ লাখ শ্রমিক। যদিও অনেক শ্রমিকই মজুরি কর্তন বা সময়মতো তা পরিশোধ না করা এবং অপর্যাপ্ত কোভিড সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ তুলেছে।

অথচ ১১০০ জনেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আট বছর পর এসে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের আরো উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল। কারণ, ওই দুর্ঘটনার পরই বৈশ্বিক পোশাক ব্র্যান্ডগুলো স্থানীয় কারখানার সঙ্গে সুরক্ষা চুক্তি করে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব চুক্তির একটি ২০১৮ সালেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে এবং আরেকটি চলতি বছরের ৩১শে মে শেষ হবে। চুক্তিগুলোর মেয়াদ পেড়িয়ে যাওয়ার জন্য এখন একটি খারাপ সময়। বিশ্বজুড়ে ভাইরাসের আতঙ্ক ও বিনাশে ক্রমাগত ছোট হচ্ছে পোশাক শিল্পের ক্রেতা চাহিদা। যার কারণে কারখানাগুলোকে অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকারেরও সাহায্য করার সামর্থ সীমিত। তাই মালিকপক্ষের এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভার এখন তাই শ্রমিকদের কাঁধে এসেও পড়েছে। এই অবস্থায় বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও রিটেইলারদের সাহায্য ছাড়া শ্রমিকেরা তাদের বহুকষ্টে অর্জিত স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য নিরাপত্তা হারাবে। আলোচিত চুক্তিগুলো এই বিষয়টিই নিশ্চিত করেছিল। এখন চুক্তি শেষ হয়ে গেলে আরো মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। 

বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানি আধুনিক যুগের এক বিস্ময়ই বলা যায়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল শুধুমাত্র কৃষিখাত। ওই সময়ে সবমিলিয়ে পোশাক কারাখানার সংখ্যা ছিল ৯টি। যাদের রপ্তানি আয় ছিল মোট ১০ লাখ ডলার। কিন্তু, পরবর্তী ৩০ বছরে উদ্যোক্তা শ্রেণি, সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তি এবং বিদেশি রিটেইলারদের খরচ সাশ্রয়ী মনোভাব এই খাতের দৃশ্য নাটকীয়ভাবে বদলে দেয়। ২০২০ সাল নাগাদ গার্মেন্টস শিল্পের বাৎসরিক রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৬০ কোটি ডলারে। বর্তমানে ৪ হাজারের বেশি কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক।

তবে রয়েছে কিছু রূঢ় বাস্তবতাও। রানা প্লাজা ধসের সময় সদ্য কাজে যোগ দেয়া একজন শ্রমিকের মাসিক বেতন ছিল ৪০ ডলারেরও কম। কর্মপরিবেশও ছিল মারাত্মক রকমের দুর্ঘটনাপ্রবণ। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আগের আট বছরে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান হাজারো শ্রমিক। কিন্তু, তা সত্ত্বেও পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বাংলাদেশের আকর্ষণ কমেছে এমনটা কখনোই হয়নি। 

বেনেটনের মতো ইউরোপের প্রথম সাড়ির ব্র্যান্ডগুলোকে পোশাক সরবরাহ করতো রানা প্লাজায় অবস্থিত কারখানাগুলো থেকে। তাই ওই মারাত্মক দুর্ঘটনা অনেক কিছু বদলে দেয়। কয়েক দশক ধরে বস্ত্রের দাম কমা নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার যেসব ভোক্তারা মোটেও প্রশ্ন তোলেননি, তারাও এবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন। ভোক্তা বিদ্রোহের এই শঙ্কা দেখা দেয়ায়, দ্রুত পোশাক কারখানার কাজের পরিবেশ উন্নয়নে ব্যস্ত হয় পোশাক শিল্প। এরপর কারখানা পরিদর্শন, অবকাঠামো মেরামত এবং ফ্যাক্টরি উন্নইয়নের যৌক্তিক সুরক্ষা মান যুক্ত দুটি চুক্তিও হয়। 

এরমধ্যে সবচেয়ে সফল চুক্তি ছিল, ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক চুক্তিটি। ক্রেতা ব্র্যান্ড এবং ইউনিয়নগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিতে উভয়পক্ষকেই নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানের পরিচালনা পর্ষদে সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব দেয়া হয়। অবশ্য এতে সরাসরি কারাখানা পর্যায় যুক্ত ছিল না। তবে এর মাধ্যমে কোনো সরবরাহক কারখানা স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা মানসম্মত কিনা এবং উন্নয়ন ও মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করছে কিনা- তা বিবেচনা করে ক্রেতা ব্রান্ডগুলোর ক্রয় অর্ডার দেয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি কাঠামো এবং প্রয়োজনীয় ছুটিও ছিল উন্নয়ন শর্তের অংশ। এই সমঝোতা হওয়ার প্রথম পাঁচ বছরেই প্রায় ১ হাজার ৫০০ কারাখানায় এক লাখের বেশি নিরাপত্তা উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।

চুক্তির অর্জন দারুণ হলেও, অ্যাকর্ডকে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবেই প্রণয়ন করা হয়েছিল। এখন কোন ধরনের ব্যবস্থা একে প্রতিস্থাপন করবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ। তবে কারখানা প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে একটি নতুন কাঠামো প্রণয়নে গত বছর ব্র্যান্ড ও ইউনিয়নগুলো একটি নতুন চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হয়। সেখানে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে কারাখানা পরিদর্শন ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারের দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টিও ছিল। পুরোনো চুক্তিগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ব্যবস্থাটি কার্যকরের সময় এগিয়ে আসছে। কিন্তু এখন ক্রেতা ব্র্যান্ড এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলো আশঙ্কা করছে, ব্র্যান্ডগুলো বাধ্যতামূলক অঙ্গীকার না করলে কারাখানার মালিকেরা এই চুক্তি থেকে পিছিয়ে আসতে পারে। 

মহামারির আগে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প সংক্রান্ত মার্কিন সিনেট কমিটির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশের কারাখানা শ্রমিক ও শ্রম ইউনিয়নগুলোর ক্রমাগত হুমকি এবং নির্যাতনের মুখে থাকার বিষয়টি। এখানে সব ধরণের উন্নয়নের পরেও, এখনও শত শত কারখানায় অভাব রয়েছে জরুরি বহিঃগমন পথের, স্মোক অ্যালার্ম এবং অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রপাতির মতন মৌলিক সুরক্ষা ব্যবস্থার। মহামারি সেই অবস্থার আরও অবনতি করেছে। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোও কারাখানা মালিকদের ব্যয়বহুল কোভিড সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। অথচ তারাই আবার ৪০ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল অথবা স্থগিত করেছে। ফলে কারখানাগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। কিন্তু তার জন্য নগদ অর্থ বা অন্য কোনো রকম সহায়তা প্রদান হয়েছে একেবারেই কম।

অ্যাকর্ড চুক্তি নবায়নে এপর্যন্ত ব্র্যান্ডগুলো খুবই কম আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং গার্মেন্টস শিল্প কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগপর্যন্ত অন্তত এই সুরক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে তাদের আগ্রহী হওয়া উচিৎ। একবার চুক্তিটির নবায়ন হলে পরবর্তীতে এটি ধাপে ধাপে আরও বিস্তৃত চুক্তির মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। সেখানে ব্র্যান্ডগুলো তাদের সরবরাহকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা মান বজায় রাখাকে বাধ্যতামূলক করতে পারবে। আবার একইসঙ্গে কারখানা প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা যাবে। এসব কর্তৃপক্ষ মিলিতভাবে কারাখানা পরিদর্শন ও তদারকির দায়িত্বে থাকবে। বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো যখন কর্মপরিবেশ নিরাপদ করার বিষয়ে মনোযোগী হয় না তার পরিণতি কী হতে পারে রানা প্লাজা সেই শিক্ষাই দিয়েছে। এমন ঘটনার মধ্যে দিয়ে এ ধরণের আর কোনো শিক্ষা কেউই নিতে চায় না।

(লেখাটি ব্লুমবার্গে প্রকাশিত কলামিস্ট অ্যাডাম মিন্টারের কলাম থেকে অনূদিত)

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status