প্রথম পাতা

শিক্ষা ঝুঁকিতে ৫৯ লাখ শিক্ষার্থী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১১ মে ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:৩৪ অপরাহ্ন

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের ৫৯ লাখ ২০ হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ন্যূনতম শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত। পাশপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় প্রাইমারিতে ১৯ শতাংশ, মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত পড়াশোনার বাইরে আছে। এ সময় শিক্ষার ব্যয় গ্রামীণ পরিবারে ১১ গুণ ও শহুরে পরিবারে ১৩ গুণ বেড়েছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন পিপিআরসি’র নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- বিআইজিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন। এপ্রিল ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ সাল পর্যন্ত গত এক বছরের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। ছয় হাজারের অধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এ সমীক্ষা করা হয়েছে।
সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়, ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও ৬১ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী পড়াশোনার ক্ষতি এড়াতে কোচিং ও গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়ালেখা চালিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। এ সময় শিক্ষার ব্যয় গ্রামীণ পরিবারে ১১ গুণ ও শহুরে পরিবারে ১৩ গুণ বেড়েছে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী প্রতি মাসিক ৫০০ টাকা করে মোট ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা নগদ সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে পিপিআরসি এবং বিআইজিডি। এতে আরো বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির আগে মাধ্যমিকে ২১ শতাংশ ও প্রাথমিকে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে যেত। গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তিতে থাকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের মাঝে ঝরে পড়ার হার বেশি। যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তাদের সমস্ত রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে।
এই দুই সংস্থা জানাচ্ছে, করোনা শুরু হওয়ার পর মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছেন। যারা অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে তাদের অধিকাংশের বসবাস শহরাঞ্চলে। মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এ সুবিধা থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।
মহামারিতে দেশে দারিদ্র্যের রূপ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তা জানতে পিপিআরসি এবং বিআইজিডি যৌথভাবে দেশজুড়ে তিন ধাপে টেলিফোন জরিপ করে। এই গবেষণার তৃতীয় ধাপের দ্বিতীয় অংশ হলো- ‘কোভিড ইমপ্যাক্ট অন এডুকেশন লাইফ অব চিলড্রেন’।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনা পরিবারগুলো, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর আরো বেশি অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করছে। ছাত্রদের পড়ালেখার যে ক্ষতির কথা সমীক্ষায় উঠে এসেছে বাস্তবে ক্ষতি হয়েছে তার চেয়েও বেশি। তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া না হলে তারা ড্রপআউটের ঝুঁকিতে পড়বে।
ইমরান মতিন বলেন, স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের একটি অংশের পড়ালেখা ঝুঁকিতে আছে। স্কুল খোলার পর শিক্ষার্থীরা যেন তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে তার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা রাখতে হবে।
গবেষণায় বাবা-মায়েদের চারটি বেসিক চিন্তার বিষয় তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো- শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাওয়া। শিক্ষার খরচ তুলনামূলক বৃদ্ধি পাওয়া। স্কুল কবে খুলবে সেটি নিয়ে চিন্তা। পড়াশোনায় পাশাপাশি চাকরি নিয়ে চিন্তা। তবে করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ চললেও এ মুহূর্তে স্কুল খুলে দিলে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের প্রায় সকল শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী।
কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে সন্তানদের শিক্ষায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, যা তারা বাড়াতে চান না। বাধ্য হয়ে এ ক্ষতির কিছুটা কমাতে কোচিং সেন্টারে সন্তানদের পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে নিয়মিত খরচের তুলনায় বর্তমানে শিক্ষায় খরচ ১১-১৩ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।
অভিভাবকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের সন্তানদের শিক্ষায় আগ্রহ কমছে। আর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ‘অটো পাস’ এর কারণে ভবিষ্যতে চাকরি জীবনে গিয়ে সন্তানরা কোনো সমস্যায় পড়েন কি-না, তা নিয়েও তারা ভীষণ উদ্বিগ্ন।
এ গবেষণায় আরো উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিত্র। দেখা গেছে, ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক পীড়ায় ভুগছেন। শহুরে বস্তিতে ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ৬২ শতাংশের ভেতর মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ বেশি। তাদের মধ্যে হঠাৎ করে রেগে যাওয়া, বাইরে বের হতে ভয় পাওয়া এবং হিংস্র আচরণ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে, যা সহিংসতা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধের কারণে তিনটি প্রধান সংকট আমাদের সামনে এসেছে। এগুলো হলো- শিখন ঘাটতি, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের বৈষম্য। তাই আমাদের পরামর্শ হচ্ছে- এ তিন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত।
হোসেন জিল্লুর বলেন, করোনার পর শিক্ষার পুনরুদ্ধারের জন্য অতিরিক্ত কার্যক্রম ও ক্লাসের বাইরের শিখন কর্মসূচিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শুধুমাত্র শিক্ষা থেকেই দূরে সরে যাবে না- অদক্ষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। দেশে প্রচলিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের উপবৃত্তি কর্মসূচিকে শিক্ষা খরচ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলেও মত দেন তিনি।
শহরের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিখন ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। মেয়ে শিক্ষার্থীর ২৬ শতাংশ এবং ছেলেদের ৩০ শতাংশ রয়েছে এ ঝুঁকিতে। দরিদ্রের মাঝে যারা অতি দরিদ্র, সেইসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থীর করোনার সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় স্কুল ছেড়ে দেয়ার শঙ্কা রয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status