প্রথম পাতা

মার্কেট-সড়কে বিপদ সংকেত

নূরে আলম জিকু

১০ মে ২০২১, সোমবার, ৯:২৫ অপরাহ্ন

গতকাল ফার্মগেটের চিত্র ছবি: শাহীন কাওসার

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে দেশজুড়ে চলছে কঠোর লকডাউন। এরই মধ্যে শর্তসাপেক্ষে খুলে দেয়া হয়েছে শপিংমল, দোকানপাট। চলছে গণপরিবহন। ঈদের কেনাকাটায় মার্কেটগুলোতে নেই তিল ধারণের ঠাঁই। দোকানপাট, শপিংমল, হাট বাজার, গণপরিবহনে মানুষের উপস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে লকডাউন চলছে। বাড়ি ফেরা ও কেনাকাটার আনন্দের কাছে ফিকে হয়ে গেছে সংক্রমণের ভয়। দেশে করোনা সংক্রমণ এখনো উদ্বেগজনক অবস্থায়। এরমধ্যে আবার দেশে ভারতের বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়েছে সম্প্রতি। এই ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক। এমন অবস্থায় সড়ক এবং মার্কেটের চিত্র এক ভয়ঙ্কর বিপদ সংকেত বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

শর্ত সাপেক্ষে চালু হলেও গণপরিবহনে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধের কথা বলা হলেও আইন অমান্য করে রাতের বেলায় চলছে অহরহ। বিভিন্ন পরিবহন ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। অনেকে প্রাইভেটকার, ভাড়া করা গাড়ি, পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে ঢাকা ছাড়ছেন। এদিকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় ঝুঁকছেন ফেরিতে। অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল পদ্মা ও মেঘনা পাড়ি দিচ্ছেন ছোট ছোট নৌকায়। এক একটি নৌকায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন থাকছে না স্বাস্থ্যবিধি, তেমনি ঝুঁকি রয়েছে প্রাণহানিরও। কোথায় মানা হচ্ছে না সরকারের বিধিনিষেধ। মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছেন না কেউই। এতে মার্কেট ও সড়কপথে থাকা মানুষজনের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ দ্রুত ঘটাতে পারে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, লকডাউনের মধ্যে যেভাবে মার্কেট, বিপণিবিতানে মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে এবং যে হারে ঢাকা ছেড়ে ঘরমুখী হচ্ছে মানুষ তাতে ঈদ ও ঈদ-পরবর্তী সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মার্কেট কিংবা সড়কপথের কোথায়ও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো মুহূর্তে আরেকটি করোনার ঢেউ দেখা দিতে পারে।
এদিকে দেশে শনাক্ত হয়েছে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। ‘বি.১.১৬৭’ নামে পরিচিত ভারতীয় ধরনটি এরই মধ্যে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে চলছে এর তাণ্ডব। দিল্লি ও মহারাষ্ট্র প্রায় লণ্ডভণ্ড। ভারতে প্রতিদিনই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ায় নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান ঘুরে দেখা যায়, জমে উঠেছে রাজধানীর শপিংমলগুলো। ঈদের কেনাকাটায় মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব কিংবা বিধিনিষেধ। এখনো মাস্ক ছাড়া কেনাকাটা করছেন অনেকেই। সপরিবারে ভিড় করছেন কেউ কেউ। থাকছেন বহুক্ষণ। নিম্নআয়ের মানুষের ভরসা ফুটপাথ। সেখানেও নেই  স্বাস্থ্যবিধির বালাই। রাস্তার পাশে অস্থায়ী দোকানে যে যেভাবে পারছেন কিনছেন সাধ্যমতো। এতে একজন অন্যের সঙ্গে শরীর ঘেঁষে কেনাকাটা করছেন। রাজধানীর বৃহত্তম শপিংমলগুলোতে যেন উৎসব চলছে। গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে মার্কেট করছেন তারা। প্রতিটি দোকানে রয়েছে ভিড়। ভিড় ঠেলে কেনাকাটায় ব্যস্ত নগরবাসী।

পান্থপথের একটি অভিজাত বিপণিবিতানের বাইরে দেখা যায় ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে জীবাণুনাশক টার্নেলের মধ্য দিয়ে ভিতরে ঢুকছেন শপিংমলে আসা লোকজন। তবে বাইরে লাইন মেনে চললেও ভিতরের চিত্র উল্টো। প্রতিটি লেভেলে রয়েছে ক্রেতার সমাগম। এস্কেলেটরগুলো ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এস্কেলেটরে উঠতে নামতে মানুষের ভিড় বেড়েছে। সেখানে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। আগের তুলনায় মাস্ক পরার প্রবণতা কয়েকগুণ বাড়লেও ঠিকমতো মাস্ক পরছেন না অনেকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে  উপচে পড়ছে মানুষের ভিড়। সন্ধ্যা নাগাদ তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।

দুপুরে ইজি ফ্যাশনের কেনাকাটা করতে আসছেন মো. আযাদ মিয়া। তিনি বলেন, সকালে ঈদের বোনাস পেয়ে মার্কেটে চলে আসলাম। আগে এমন ভিড় সাধারণত চাঁদ রাতে দেখা মিলতো। এখন আগেই দেখতে পাচ্ছি। মার্কেটে এসে বোঝার উপায় নেই যে দেশে করোনাভাইরাস নামে কিছু আছে। মাস্ক পরে থাকলেও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে কেনাকাটা করছেন সবাই। কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে পারলেই খুশি। ক্যাশকাউন্টারের সামনেও মানা হয়নি দূরত্ব বিধি। নঈম নামের একজন বিক্রয়কর্মী  বলেন, মাস্ক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না। তবে ক্রেতারা সাধারণত স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাচ্ছেন না। তারা আমাদের কথা না শুনেই ভিতরে ঢুকে পড়েন। কেউ বাইরে অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন না। এতে আমাদের কিছু করার থাকে না।

একই চিত্র রাজধানীর নিউ মার্কেটে। নিউ মার্কেট এলাকার ফুটপাথে বেড়েছে বেচাবিক্রি। অনেকাংশে ক্রেতাদের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার হাঁটার মতো পরিস্থিতিও নেই। প্রতিটি দোকানে ক্রেতা সমাগম। স্বাস্থ্যবিধি নড়বড়ে। মাস্ক ছাড়াও কেনাকাটা করছেন তারা। ঘুরছেন এক দোকান থেকে অন্য দোকানে। নাজমা ফ্যাশন নামের এক দোকানি মানবজমিনকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানাবে কে? এটা কার দায়িত্ব। আমরা বিক্রি করবো নাকি ক্রেতার স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করবো। ঈদের কেনাকাটায় মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে আমাদের ক্ষতি নেই। এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানে ঢুকতে বললে ক্রেতা রাগ করে চলে যান। রাহি ফ্যাশনের এক বিক্রয়কর্মী জানান, মার্কেট খোলার পর থেকে এভাবেই বেচাবিক্রি করে আসছি। কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে শুনিনি। এছাড়া মানুষ ভিড় ঠেলে কেনাকাটা করছেন। কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানেন না। রাজধানীর মৌচাক মার্কেটেও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। গত কয়েকদিনের তুলনায় বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। ছোট ছোট দোকানে ক্রেতাদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। সরজমিন দেখা যায়, মার্কেটে ক্রেতা-বিক্রেতা অনেকেই পরেন না মাস্ক। মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। শিহাব উদ্দিন নামে এক বিক্রেতা বলছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কেনাকাটা করতে আসছেন লোকজন। অনেকেই ঘুরতে আসছেন। কেউ কেউ পুরো পরিবার নিয়ে কেনাকাটা করছেন।

এদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা যায়, ভিড় বেড়েছে। কেউ বেরিয়েছেন কেনাকাটায়। কেউবা ঢাকা ছাড়ছেন। গণপরিবহনে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। বাসের হেলপার ও কন্ডাক্টর ভঙ্গ করছেন বিধিনিষেধ। কারো মুখে নেই মাস্ক। পাশাপাশি সিটে যাত্রী নিয়ে চলাচল করতেও দেখা গেছে। নেই জীবাণুনাশক দ্রব্য।

শিকড় বাসের কন্ডাক্টর সবুজ মিয়া মানবজমিনকে বলেন, অধিকাংশ মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে যাচ্ছেন। এতে তারা পাশাপাশি সিট নিচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বললেও তারা সেসব বিষয়ে কর্ণপাত করছেন না। এলিফ্যান্ট রোড বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন, আয়েশা আক্তার। ৪ বছরের ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় যাবেন তিনি। কথা হলে তিনি বলেন, যেভাবেই হোক ঈদ বাড়িতে করতে হবে। গত ঈদে বাড়ি যেতে পারিনি। এবার যাচ্ছি। দূরপাল্লার বাস নেই, কীভাবে যাবেন জানতে চাইতে তিনি বলেন, শুনেছি ভেঙে ভেঙে যাওয়া যায়। এখন গাবতলি যাবো। সেখানে গেলে যে কোনো একটা উপায়ে যেতে পারবো।

এদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের টেপরা এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়েছে বিজিবি। শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে আগের তুলনায় ভিড় কমেছে। তবে থেমে নেই ঘরমুখী মানুষের চলাচল। মানুষ বিকল্প পথে ছুটছেন নিজ গন্তব্যে। ঘাটে ফেরিতে উঠতে না পেরে অনেকেই ছোট ছোট লঞ্চ, ট্রলার ও মাছ ধরার নৌকায় পার হচ্ছেন। ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস ও মালবাহী ট্রাকে করে দলবদ্ধ হয়ে সড়কপথে বাড়ি যাচ্ছেন অনেকে। এতে রক্ষা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status