শেষের পাতা

মর্মান্তিক

শুভ্র দেব

৬ মে ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:২৫ অপরাহ্ন

সুনিতা রানী দাস (৫০) পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন ঢাকার বাসাবো এলাকার বৌদ্ধ মন্দিরে। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করে যা পেতেন তা দিয়ে স্বামী, তিন সন্তান, ছেলের বউ ও নাতিকে নিয়ে সংসার চালাতেন। অভাব- অনটনের সংসারে একমাত্র অর্থের যোগানদাতা হলেও ভালোই কাটছিল দিনকাল। নিজে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন তাই বিভিন্ন স্থানে তার জানাশোনা ছিল। বড় বোনের ছেলে দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন। তাই সুনিতা মাসির কাছে তার আবদার ছিল একটা চাকরি খুঁজে দিতে হবে। গুরুত্ব দিয়েই ভাগ্নের সেই আবদার রাখতে চেয়েছিলেন সুনিতা। শান্তিনগরের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপও করে রেখেছিলেন। কথা ছিল বুধবার সকালে ভাগ্নে সুজিতকে নিয়ে ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করাবেন। তাই মঙ্গলবার রাতেই সুজিতকে নিয়ে আসেন তার মানিকনগরের কাজিরবাগ ঋষিপাড়ার ভাড়া বাসায়। বুধবার ভোরে সুজিতকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিনগরের উদ্দেশ্যে রিকশায় করে রওনা দেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে মতিঝিল বিআরটিসির বাস ডিপোর সামনে আসার পরপরই প্রাইভেটকার থেকে ছিনতাইকারী সুনিতার ব্যাগ ধরে টান দিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। হেঁচকা টানে চলন্ত রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে মাথায় আঘাত পান সুনিতা। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা সুনিতাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বুধবার ভোর আনুমানিক সাড়ে ছয়টার দিকে বিআরটিসি’র মতিঝিল বাস ডিপোর সামনে যখন ঘটনাটি ঘটেছে তখন ওই এলাকায় যানবাহন ও মানুষের চলাচল ছিল না। সুনিতার বড় বোনের ছেলে ও প্রত্যক্ষদর্শী সুজিত দাস মানবজমিনকে বলেন, আগের দিন রাতেই আমি ডেমরা থেকে মাসির বাসায় আসি। ভোর ৬টার দিকে মানিকনগর থেকে রিকশায় করে শান্তিনগরের দিকে যাচ্ছিলাম। রিকশার ডানদিকে আমি ও বামপাশে মাসি বসেছিলেন। আমাদের বহনকারী রিকশাটি যখন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে দিয়ে আসছিল তখন একটি প্রাইভেটকার আমাদের পেছনে আসছিল। বাস ডিপোর সামনে আসার পরে আমাদের রিকশাটি রাস্তার ডান পাশে চলে যায়। এই সুযোগে প্রাইভেটকারটি বাম পাশে এসে পেছনের সিটে বসে থাকা ছিনতাইকারী মাসির ব্যাগ ধরে টান দেয়। তারা টান দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। আর মাসি টান খেয়ে রিকশা থেকে পাকা রাস্তায় পড়ে সংজ্ঞা হারান। সুজিত বলেন, আমি তখন অনেকটা বোকা বনে যাই। কি করবো, না করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরে মাসিকে নিয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। করোনা হাসপাতাল হওয়াতে সেখান থেকে বলা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে। তড়িঘড়ি করে ঢামেকে নিয়ে গেলে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সুজিত বলেন, পুরো রাস্তা মাসি আমাকে বুঝাচ্ছিলেন যেখানে কাজে যাচ্ছি সেখানে যেন মনোযোগ দিয়ে কাজ করি। তারা যেভাবে বলেন- সেভাবে যেন করি। মাসে ৬ হাজার টাকা বেতনে আমার চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন।
নিহত সুনিতার বাড়ি টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে। তার স্বামীর নাম সুজন দাস। তাদের ঘরে সুমন দাস, রাজু দাস, জিসান দাস নামের তিন ছেলে রয়েছে। এরমধ্যে মেজ ছেলে রাজু দাস বিয়ে করেছেন। তাদের ঘরে একটি সন্তানও রয়েছে। পরিবারের সবাইকে নিয়েই দুই রুমের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। স্বামী কর্মহীন। ছেলেরা টুকটাক আয় করেন। তারা অল্প কিছু টাকা পরিবারে ব্যয় করতে পারে। পরিবার চালাতে হতো সুনিতাকে। বৌদ্ধ মন্দিরে  থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ করতেন সুনিতা। পাশাপাশি একটি বাসায় কাজ করতেন। দুই জায়গায় কাজের টাকা দিয়েই সব কিছু সামলাতেন।
সুনিতার স্বামী সুজন দাস মানবজমিনকে বলেন, প্রতিদিন সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে সুনিতা কাজের উদ্দেশ্যে বের হতো। কিন্তু গতকাল সুজিতকে শান্তিনগরের হাজী সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ভোর ৬টার দিকে রওনা হয়। অন্যদিন দেরিতে বাসা থেকে বের হয় তাই সবার সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু কাল ভোরবেলা বের হওয়াতে কারো সঙ্গে কথা বলেনি।  
মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন মোল্লা মানবজমিনকে বলেন, ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় করে ওই নারী শান্তিনগরের দিকে যাচ্ছিলেন। রমজান মাস হওয়াতে ভোরবেলা সড়কে মানুষের আনাগোনা ছিল না। বিআরটিসি’র বাস ডিপোর সামনের রাস্তার পুরো দুই পাশে বাস পার্কিং করা ছিল। এ ছাড়া ডিপোর সামনে ঘটনা ঘটেছে অথচ সেখানে কোনো সিসি ক্যামেরা নাই। তাই গাড়ি শনাক্ত করা যায়নি। ঘটনাস্থলের অদূরে থেকে আমরা ফুটেজ সংগ্রহ করে শনাক্তের চেষ্টা করছি।
ডিএমপি’র মতিঝিল জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (সম্প্রতি এডিসি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) জাহিদুল ইসলাম সোহাগ মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাস্থলের খুব কাছাকাছি কোনো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ মেলেনি। একটি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে যেটি দিয়ে গাড়ির নম্বর শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে গাড়ি ও ঘাতকদের শনাক্তের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এ ঘটনায় সুনিতার পরিবার মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status