বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪২)

‘ওদের মূল উদ্দেশ্য, রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার চরিত্র হনন করা’

স্টাফ রিপোর্টার

৫ মে ২০২১, বুধবার, ১১:৩৬ পূর্বাহ্ন

মঙ্গলবার ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৫২
ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগ দেয়া হলেও বিএনপির অফিস এখন অবধি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। পুলিশের বিরাট বহর নিয়ে গিয়ে কার্যালয়ে আগত হাজার হাজার কর্মীর অনুপ্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে। সরকারের ধারণায় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃতাধীন অংশ নয়- সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত মান্নান ভূঁইয়ার অংশই হলো বিএনপির মূলধারা। এ সরকারকে নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক ভাবার কোনো কারণ নেই।

বুধবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৫৩
পাঁচ মাস আগে এই দিনে আমার বাড়ি আক্রমণ করেছিল সরকারি বাহিনী, তার পরদিন সকালে আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অন্যত্র।
এখন আমাকে বিনা বিচারে নিবর্তনমূলক আটকাদেশের ভিত্তিতে আটক রাখা হয়েছে। এভাবে বিনা বিচারে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ দিনের পর দিন কাটাচ্ছে কারাগারের অভ্যন্তরে। জরুরি আইনে জামিনের অধিকার হরণ এবং আপিল বিভাগ সেই দমন আইন বহাল রাখায় সুবিচারের সকল পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
দাঁতের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম পিজি হাসপাতালে। আমার পাণ্ডুলিপি টাইপ করাতে এই যাতায়াত খুবই কাজে লাগে। এতে আমি আমার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি পাচার করে দিয়ে টাইপ করা অংশ পুনঃসংশোধনের জন্য ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি। অনেক ঝুঁকি নিয়ে ডা. হেলাল এই হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় আমাকে সাহায্য করে।
ব্যারিস্টার খোকনকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের অফিসারেরা অব্যাহত হুমকির মুখে রেখেছে। প্রাণের ভয়ে শহীদ এখন আর আমার ধারে কাছে আসতে সাহস পায় না। আর কেউ না হলেও এই খোকন এবং শহীদ সবসময় আমার বিপদের দিনে আমার পাশে থেকেছে। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা আর যোগাযোগ রাখতে পারছে না আমার সাথে। আমি এখন একান্তভাবে নিঃসঙ্গ এবং এই নিঃসঙ্গ অবস্থায় লড়াই করেই জিততে হবে আমাকে।

বৃহস্পতিবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৫৪
গতকাল হাইকোর্ট ডিভিশন আমার আটকাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে মুক্তিদানের নির্দেশ দিয়েছে। আর কোনো আইনগত বাধা না থাকায় আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি দেওয়ার কথা। বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা দলবেঁধে এসেছে আমাকে অভিনন্দন জানাতে, অন্যান্য সেল থেকেও আমাকে শুভকামনা জানানো হচ্ছে। অতীতে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ আসার সাথে সাথেই একই দিনে আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হতো। স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম বছরগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারে অধিষ্ঠিত থাকাকালে কম্যুনিস্ট নেতা শান্তি সেনের স্ত্রী অরুণা সেনের আটকাদেশ অবৈধ হিসেবে রায় দিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশ পাবার পর তার আইনজীবী হিসেবে আমি একই দিনে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য গিয়েছিলাম। আমার সাথে ছিলেন সাপ্তাহিক হলিডের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান ও বিশিষ্ট কলামিস্ট ও বিজ্ঞ লেখক বদরুদ্দীন উমর ।
কিন্তু আজ আমি নিজেই শঙ্কাগ্রস্ত। দিন বদলেছে- বিশেষ করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিয়মের ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আমি নিশ্চিত যে, সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে বা দায়ের করবে নতুন কোনো মামলা যাতে করে আমি মুক্তি না পাই।
রাজনীতিবিদেরা আশার ওপর ভর করে কারাগারে দিন কাটায়। তারা সেখানে বসে ক্রমাগত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাদের অনুমান পর্যালোচনা করেন। বন্দিজীবন থেকে মুক্তি লাভই তখন হয়ে থাকে তাদের জীবনের একমাত্র আকাক্সক্ষা, জীবনের ন্যূনতম চাহিদা এবং প্রধান ও প্রাথমিক অগ্রাধিকার।

শুক্রবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৫৫
শেষ পর্যন্ত আমার আশঙ্কাই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাদক মামলায় আমি জামিন পাওয়ার পর এ সংক্রান্ত কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট কোর্ট ও সরকারি বিভাগে যাওয়ার কথা ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট তাতে সই দেওয়ার পর সেই জামিন কার্যকর হওয়ার নিয়ম রয়েছে। সবগুলো আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে সময় লাগতে পারে বড়জোর আধঘণ্টা। কিন্তু এরই মধ্যে সামরিক এজেন্সি থেকে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্দেশ গেছে যাতে করে আমার ছাড়পত্র দিতে দেরি করা হয়, যাতে ইত্যবসরে সরকার নতুন একটি মামলা দিয়ে আমার মুক্তি রদ করে দিতে পারে। সাধারণত এ ধরনের জামিন কার্যকর করার সময় অভিযুক্তের পক্ষে একজন স্থানীয় নাগরিক ও একজন আইনজীবী এই মর্মে একটি বন্ড বা জিম্মাপত্র দেন যে, মামলার প্রয়োজনে যে কোনো সময়ে আসামিকে আদালতে হাজির করা হবে। এক্ষেত্রে ম্যাজিস্টেট নির্দেশ দিলেন যে, আমার নির্বাচনী এলাকার সরকারি কলেজের প্রিন্সিপ্যালকে আমার পক্ষে সেই বন্ড দাখিল করতে হবে।
আমার নির্বাচনী এলাকার কলেজটি ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। ম্যাজিস্ট্রেটও ভালো করেই জানতেন যে, চাকুরি হারানো কিংবা বাইরে অন্য কোনো দুর্গম ও গুরুত্বহীন কলেজে বদলি করে দেওয়ার আশঙ্কায় সরকারি কলেজের সেই প্রিন্সিপ্যাল আমার মতো একজন রাজনীতিবিদের পক্ষে বন্ড দিতে অনীহা প্রকাশ করবেন কিংবা একেবারে অস্বীকৃতিই জানাবেন। এ পদক্ষেপ নেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই ছিল আমার জামিন কার্যকর করার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করা, যাতে করে এর মধ্যে আপিল বিভাগে আপিল করে কিংবা সাজানো নতুন একটা মামলা দিয়ে আনার জামিনে মুক্তির আদেশটি অকার্যকর করে দেওয়া যায়। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে বন্ধ থাকায় আদালত থেকে আমার পক্ষে কোনো কাগজপত্র বের করাও সম্ভব হলো না। এতে করে সরকার ও জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়ে তার সদ্ব্যবহারে সক্ষম হলো।
আজ রমজানের প্রথম দিন রোজা রাখা শুরু করেছি।

শনিবার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৫৬
বেশ কয়েকটি পত্রিকায় খবর বের হয়েছে যে, আমি যেন মুক্ত হতে না পারি সে লক্ষ্যে আমার বিরুদ্ধে সরকার নতুন মামলা দায়ের করার উদ্যোগ নিয়েছে।
রমজান মাসকে উপলক্ষ্য করে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়েছে। সেই সাথে কোনো কোনো জেলায় বন্যার প্রাদুর্ভাব ঘটায় জনগণ আরেক দুর্গতির শিকার হয়েছে।
সরকারের এটা অনুধাবন করা দরকার যে, নির্দেশ বা সতর্কবার্তা জারি করে কিংবা সন্ত্রাসী কায়দায় বা হুমকি দিয়ে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ ধরনের চাপ যত বাড়বে, মজুদদাররা ততই তাদের মজুদের পরিমাণ বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য ক্রমশ বাড়াতে থাকবে। ১৯৭৪ সালে এ প্রক্রিয়ায় আমরা একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছি। জনগণ ইতিমধ্যেই অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে শুরু করেছে। সেনাবাহিনী প্রধান কিংবা প্রধান উপদেষ্টার এ ধরনের শঙ্কাজনক পরিস্থিতি মোকাবিলার বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা নেই, নেই বন্যা, খাদ্য সংকট মোকাবিলার মতো ব্যবস্থাপনা কৌশলের কোনো জ্ঞান।
বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
সেনাপ্রধান আবার ত্রাণ সাহায্য নেওয়া শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টার আর সম্মান থাকলো কোথায়?

রবিবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৫৭
গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের অভাবে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। গত ৯ মাসে গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নমূলক কোনো কাজ হয়নি। জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রাণ সপতার গ্রামীণ অর্থনীতিই সবচেয়ে কঠোর সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। এ সময়টাতে ভিজিএফ, ভিজিডি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, টেস্ট রিলিফ, সড়ক বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ ইত্যাদি ছিল প্রায় বন্ধ। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম চলে গেছে সাধারণ গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সরকারের ভয়ে সংবাদপত্রগুলোও এসব খবর প্রচার করতে সাহস পাচ্ছে না।
প্রায় দু’মাস হয়ে গেল জেলখানায় কেউ আমাকে দেখতে আসেনি।

সোমবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৫৮
আমার আশঙ্কাই আবার সত্যে পরিণত হয়েছে। সরকারি এজেন্সির নির্দেশে আমার জামিন কার্যকরণে বিলম্বের সুবাদে বেইল বন্ড দাখিল করে মুক্তি পাওয়ার আগেই দুর্নীতি দমন কমিশন আমার বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযােগ এনে মামলা দায়ের করেছে। যে, আমি আইন বহির্ভূত পন্থায় তাদের উদ্ভাবিত মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও কল্পিত ব্যয় প্রদর্শন করিনি অথচ আইন অনুযায়ী আমার শুধু সম্পত্তি, দায়দেনা ও আয়ের বিবরণী জমা দেওয়ারই কথা, ব্যয়সংক্রান্ত কোনো হিসাব দেওয়ার কোনো বিধান নেই।
যাই হোক, ওদের মূল উদ্দেশ্য হলো, রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার চরিত্র হনন করা ও আমাকে বের হতে না দিয়ে জেলখানায় আটকে রাখা। আইনে বিধান থাকা সত্ত্বেও আমাকে এ নিয়ে কোনো আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করতে না দিয়ে এবং এতদসংক্রান্ত কোনো শুনানি না দিয়ে আইনগত অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে আমার পরবর্তী একমাত্র করণীয় হলো মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতের হাইকোর্ট ডিভিশনে আবেদন করা ও অনির্দিষ্টকাল যাবৎ দুঃসহ কারা যন্ত্রণা ভোগ করা।

(চলবে..)

আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৯)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৯)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৯)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪১)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status